রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০২৩

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে"

সজ্জ্বল দত্ত



 ৭ . 

        " And miles to go before I sleep 
          And miles to go before I sleep " 

পাঠ্যসূচিতে যখন রবার্ট ফ্রস্ট এর এ' কবিতা পড়েছিলাম , মনে আছে প্রায়ই প্রশ্ন আসত , লাইনটি দু'বার ব্যবহারের তাৎপর্য কী ? উত্তরটাও পড়তে পড়ত প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল আমাদের । জ্যোৎস্নাময় আলোমাখামাখি বনভূমির নিবিড় সৌন্দর্য কবিকে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করলেও সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে এই মুগ্ধতা কবির বেশিক্ষণ উপভোগ করার সময় নেই , তাকে যেতে হবে । লাইনটি প্রথমবার ব্যবহারের তাৎপর্য সেই সন্ধ্যায় কবিকে বিশ্রাম নেওয়ার আগে তখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে । লাইনটি দ্বিতীয়বার ব্যবহারের অর্থ জীবনের শেষবিশ্রাম নেওয়ার আগে তখনও বহু বহু পথ অতিক্রম করতে হবে কবিকে । 
 পাঠ্যবইয়ে পড়া এই লাইনদুটি উদ্ধৃত করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল কবি দেবদাস আচার্যর "উৎসবীজ" এর একেবারে শুরুটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল , তাই ।   

" আমার বাঁ হাতে আছে গোল ছোট একটি পৃথিবী
  এর মায়া-রূপে মুগ্ধ , দাঁড়িয়েছি ক্ষণিক প্রহর 
  অশান্ত যাত্রার পথে , এই সৌরজগতের দেশে । 
  বহুদূর নক্ষত্রের পথ ধরে এসেছি এখানে , 
  অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে থমকে দেখি
  উজ্জ্বল মণির দীপ্তি মহাজাগতিক অশ্রুকণা " 
 
পাশ্চাত্যের কবি বহু বহু মাইল হাঁটার পথে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন চন্দ্রালোকিত বনভূমির নিবিড় সৌন্দর্যের সামনে । আর এই বাংলার কৃষ্ণনগরের খোড়ে নদীর ধারে বসবাস করা আধুনিক কবি দেবদাস আচার্য অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে দেখছেন গোল ছোট একটা পৃথিবী, তার মুগ্ধ করা মায়ারূপ, উজ্জ্বল মণির দীপ্তি মহাজাগতিক অশ্রুকণা । 
একদিন হঠাৎ যে গ্যাসীয় পিণ্ডটি সূর্যের থেকে ছিটকে বেরিয়ে তার প্রবল আকর্ষণে চারপাশে ঘুরতে শুরু করেছিল , আজ একেবারে ঠাণ্ডা সেই পিণ্ডের মধ্যে বসে দু'হাত দু'পা আর সাদাকালো চুলে ভর্তি মাথা নিয়ে বিচিত্র এক প্রাণী হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে , দুঃখ আনন্দ শোক তাপ হাসি কান্না নিয়ে আঁকছে লিখছে খেলছে গাইছে , চন্দ্রজয়ের পর সূর্যজয় করা যায় কিনা খতিয়ে দেখছে । ... এই যে অনন্ত অনন্তকাল , এই কালের মহাসমুদ্রে ভেসে যেতে যেতে কবির প্রার্থনা -- শুধু এই জল , আলো , স্থিতি আর প্রাণবায়ুর মধ্যে আরো কিছুকাল যেন থেকে যেতে পারেন । আরো...আরো...কিছুকাল ! এই কবি দেবদাস আচার্য । কোটি কোটি বছরের পৃথিবীর মাটির সঙ্গে যিনি নাড়ির যোগাযোগ টের পান আর সেখানেই ভাসিয়ে দিতে চান নিজের সত্ত্বাকে । দেবদাসের কবিতার সবচেয়ে বড় কথা জীবনদর্শন তার কাছে স্বাভাবিক কবিতা , তাই পাঠকের সেই দর্শনের গভীরে পৌঁছানোর কাজটি অত্যন্ত সহজ বলে মনে হয় । 
সাহিত্য , সমাজ , দর্শন , অর্থনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই টিঁকে থাকার প্রধান শর্ত হচ্ছে বহু বহু বছরের চলমান জীবনপথে সে সংক্রান্ত সৃষ্টি বা তত্ত্ব এই প্রবহমানতার বা বয়ে চলার কোনো প্রাথমিক কার্যকারণ ফলাফল ইত্যাদির ওপর আলোকপাত করতে পারছে কিনা এবং সেই আলো স্রষ্টার একেবারে হৃদয়ের গভীরতম অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসছে কিনা । কবি দেবদাস আচার্যর কাব্যগ্রন্থগুলো একের পর এক পাঠ করলেই তার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি একেবারে চরমতম পারদর্শিতায় পরিস্কার হয়ে ফুটে ওঠে । 
শেষবেলায় আবার একটু খোলা যাক "সুভাষিতম" এর পাতা । 

    ১ ) " কালকে ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত করে 
  প্রতিটি মুহূর্তকে স্বয়ংসম্পূর্ণ অণুতে পরিণত করে 
  অস্তিত্ব রক্ষার নাম 
  জীবন " 

   ২ ) " কিছু কিছু ভোগ-স্পৃহা 
           কিছু কিছু জয়স্তম্ভ 
           কিছু কিছু লৌকিক কিংবদন্তী 
   আমাদের মেধায় ও হৃদয়ে আবর্তিত হয় 
  একটা গতিশীল অখণ্ড শ্বাস-প্রশ্বাস 
  জীবাশ্ম থেকে অতিজীবনের অন্তর্বর্তীকাল জুড়ে 
               প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে 
               একটা অখণ্ড মুদ্রায় 
              নৃত্যরত " 

কালের প্রবহমানতার একেবারে গোড়ার কথা । নয় কি ? আর শুধু বিষয়বস্তুতেই নয় , বলার ভঙ্গিমাতেও খাঁটি কবিতা । কবিতার অতি সামান্য একজন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাঠক হিসেবে মনে হয় , আর কার ক্ষেত্রে কী হবে জানিনা , দেবদাস আচার্যর কবিতা অন্তত সোনার ধান হয়ে মহাকালের নৌকায় উঠবেই , দেবদাসের কবিতায় যে তার সবকটি লক্ষণ বিদ্যমান !
এই গদ্যের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে একজনের কথা না বললে গদ্যটি নাকি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে -- ঘরোয়া কথাবার্তায় দেবদাস-ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু মানুষ বলেছেন আমাকে । যার কথা বলতে চেয়েছেন তিনি কবি মজনু মোস্তাফা। দেবদাস আচার্য তার সাহচর্যে কবিতা লেখার শুরু থেকে প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত যথেষ্ট উপকৃত , বলেছেন অনেকে । 'প্রভাবিত'ও বলেছেন দু'একজন । উপকৃত বা প্রভাবিত যাইই হোন না কেন , এ কথা নিশ্চয়ই ঠিক , তার সাক্ষ্য দেবে কবিতা । যারা বলেছেন ক্ষমা করবেন , মজনু মোস্তাফার কবিতা বিস্তৃত পাঠ করে এরকম ধারণার বিশেষ কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় বলে মনে হয় না । দেবদাসের মৃৎশকট, তর্পণ , উৎসবীজ , আচার্যের ভদ্রাসন , সুভাষিতম কোনো কাব্যগ্রন্থের মূলভাবের সঙ্গেই মজনুর কবিতার কোনো মিল কোথাও চোখে পড়ে না । মজনু তথা নির্মাল্যভূষণের " উনিশ যন্ত্রণা " ভালোভাবে পড়ে "উনিশ যন্ত্রণা"র ভূমিকায় লেখা বার্ণিক রায়ের এই বক্তব্যের সঙ্গেই একমত হওয়া অনেক বেশি সহজ , যে মজনুর কবিতায় বরং র‍্যাঁবোর প্রভাব বেশি চোখে পড়ে । মজনুর কবিতা অনেকখানি স্বপ্ন ও বিশ্বাসভঙ্গের তীব্র দহনজাত বেপরোয়া কবিতা । তার বিষয়ে শব্দপ্রয়োগে র‍্যাঁবোর লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে বেশি । আর দেবদাসের কবিতার জায়গা যে একেবারে অন্যরকম তা এতক্ষণের আলোচনায় পাঠকের কাছে নিশ্চয়ই স্পষ্ট । অবশ্য একথা ঠিক , অনেকসময় একজন কবির কবিতায় আর একজন কবি প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে উপস্থিত থাকেন । আপাতদৃষ্টিতে এই উপস্থিতি ধরা বেশ কঠিন । এইজন্যই কবির ব্যক্তিগত জীবন সবসময় পাঠকের জানার প্রয়োজন আছে । 

এই আলোচনা শুরু করেছিলাম কবিতায় মহাসময় তথা কালখণ্ডের বিস্তার দিয়ে , শেষও করব সেই প্রসঙ্গেই । হয়ত কোনোদিন পৃথিবীর বুকে কোনো লণ্ডভণ্ড ঝড় , কিংবা মাটি ফুঁড়ে ওঠা কোনো প্রচণ্ড অগ্ন্যুৎপাত , হয়ত প্রবল সুনামি ঢেউ , তীব্র জলোচ্ছ্বাসে স্থলভাগ জুড়ে ক্ষ্যাপা প্রকৃতির উন্মত্ত তাণ্ডব ! সেইদিন সেই ধ্বংসলীলার সামনে দাঁড়িয়েও , বায়ু অগ্নি জলে মহাপ্রলয়ের মুখে দাঁড়িয়েও এই অসীম ব্রহ্মাণ্ডে কোনো না কোনো মহাপ্রাণের নাভিকুণ্ড থেকে ঠিক উচ্চারিত হবে ' ওঁ ' ! সঙ্গে সঙ্গে নবসৃষ্টিবার্তা , গাছ থেকে পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরে পড়বে ফুল । চারপাশে নরম মিষ্টি হাওয়া , সকালের কাঁচাসোনা-রোদ । সেই রোদ হঠাৎই মিলিয়ে হয়ত আকাশ ভরে উঠবে ঘন কালো মেঘে । অঝোর বৃষ্টিধারায় সুজলা সুফলা হবে মাটি । তারপর একসময় বৃষ্টি থামলে আবার চতুর্দিক আলোয় আলো । সঙ্গে নতুন মানুষ নতুন কাব্যভাষায় , নতুন আঙ্গিকে নতুন শিল্পনৈপুণ্যে , হয়ত নতুন নতুন কবিকে পুষ্পস্তবক মানপত্র সম্বর্ধনায় । 
... আর কবি দেবদাস ? ... ওই যে ওঁচলাকুড়ুনি , ঘুঁটেকুড়ুনি , ছুতোরকাকা , ঘরামিকাকা , ... ওই যে সে , যে নিড়িনি চালায় শস্যে বিদে দেয় খুঁটে তোলে আগাছা ! ... যদি সময়ের মহাস্রোতে ওরা থেকে যায় তবে সেই নবসময়ের প্রেক্ষাপটে দেবদাসও নিশ্চিত থাকবেন অনন্ত সৌরপথ পরিক্রমায় এই পৃথিবীর মাটিতে মানুষের অহংকার নিয়ে , পদস্খলন নিয়ে । ... রক্তমাংসে না হলেও কবিতাসংগ্রহে , নতুন কবির হাতে নতুন পাঠকের হাতে হয়ত কখনো কারো রঙিন কাগজে মুড়ে ভালোবেসে তুলে দেওয়া প্রীতি উপহারে । 

                                 ( শেষ ) 




লেখক পরিচিতি: সজ্জ্বল দত্তের জন্ম ৬ নভেম্বর ১৯৬৮। শৈশব, বেড়ে ওঠা এবং কবিতা লেখার শুরু থেকে জীবনের একটা বড় অধ্যায় কেটেছে চূর্ণী নদী তীরবর্তী রানাঘাট শহরে। পেশায় ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের কর্মচারী সজ্জ্বল দত্ত এখন বারাকপুর শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। বিগত শতকের নয়ের দশকের কবি ও আলোচক সজ্জ্বলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বাগত শ্রাবণ-জোনাকি' ( ১৯৯৭ - দাহপত্র)। পরবর্তীকালে প্রকাশিত - পোস্ট মর্টেম ( ২০০০- এই সহস্রধারা), দাগ ( ২০২০- বারাকপুর স্টেশন প্রকাশনী), অ্যালব্যাম ( প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থের একত্রিত দ্বিতীয় সংস্করণ - ২০২২- সায়ন্তন পাবলিকেশন) প্রভৃতি। কবিতাকেন্দ্রিক 'মধুবন' পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘ আট বছর। বর্তমানে বারাকপুর স্টেশন লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। 
   দেবদাস আচার্য সজ্জ্বলের প্রিয় কবিদের একজন। সাতটি পর্বে প্রকাশিত এই আলোচনায় একদিকে যেমন আলোচ্য কবিকৃতি নিপুণ দক্ষতায় পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে তেমনই আলোচক সজ্জ্বলের প্রজ্ঞাদীপ্ত কলম প্রমাণিত হয়েছে কষ্টিপাথরে। 

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...