শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০২৩

দ্বিতীয় পর্ব: অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

          

''অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে''

সজ্জ্বল দত্ত



   ২ . 


             মানুষের মূর্তিই কালক্রমের প্রতিধ্বনি
 
        " সে নিড়িনি চালায় শস্যে , বিদে দেয় , 
          খুঁটে তোলে আগাছা 
                   #            #          # 
          সে যায় মাঠে , যখন কাকপক্ষী ওঠে 
         সে যায় মাঠে , তার বৌ ঢেঁকিতে ধান কোটে 
         যখন মোষের শরীর ছুঁয়ে সারা মাঠে 
                            অন্ধকার নামে 
         সে ফেরে বাড়ি, মোষের পিঠে চেপে 
                  #               #           # 
        সে বিদে দেয় মাঠে , আর ফসল ডাঁসা হলে 
        কাকতাড়ুয়া পুঁতে দেয় ,
        গরুর খুলি ঝুলিয়ে দেয় ক্ষেতে । 
       সে পগার কেটে জল আনে গেঁড়ে-গর্ত থেকে 
       তার মেয়ের মতো ঘাগরা দুলিয়ে 
                             ফসল খেলা করে ,
       আলের ওপর দৌড়ায় সে বনবিড়ালের মতো, 
      সে নিড়িনি চালায় শস্যে , বিদে দেয় .... " 

এই ছবিতে যে শ্রেণির মানুষের মূর্তি , তাকে নিয়ে যুগ যুগ ধরে লেখা হয়েছে কবিতা , তৈরি হয়েছে অসংখ্য শিল্পকর্ম । দেবদাস আচার্যর " মানুষের মূর্তি " নামে একটি কাব্যগ্রন্থ থাকলেও এই লাইনগুলো কিন্তু তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি "র একটি কবিতার । এখন কথা হচ্ছে , কালক্রম কিসের প্রতিধ্বনি করছে এই জিজ্ঞাসার কোন উত্তর দেবদাসের এই কাব্যগ্রন্থে আছে কিনা । " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি "র প্রকাশকাল ১৯৭০ , তারপর " মৃৎশকট " ১৯৭৫ , তারপর " মানুষের মূর্তি " ১৯৭৮ । কালক্রম ... ও মৃৎশকট এর কবিতার উদাহরণ পাঠক আগে পেয়েছেন , এবার " মানুষের মূর্তি "র একটা-দুটো কবিতার কথা শোনা যাক । 

         ১ . " আমার বাবা সেলাইকল চালান 
               এবং তার ঘামে ভিজিয়ে দেন রুটি 
               সেই রুটি খেয়ে আমাদের এত স্পর্ধা 
               যা সব কুলি-কামি'দের থাকে "। (স্পর্ধা)    
                                                
         ২ . "ঐ আমার বাবা হেঁটে যাচ্ছেন , 
                ধুকড়ি গায়ে 
                তাঁর হাঁটু অবধি ধুলো 
                তাঁর চলার পথে বেজে উঠছে 
                শঙ্খ, ঘন্টা, খিদে, শ্রম -- "  ( বাবা )         

     এই দুটো কবিতাংশের ' বাবা ' আর প্রথমে উল্লিখিত কবিতাটির ' সে ' , এই দুইয়ের মধ্যে কোনোরকম কিছু চরিত্রগত মিল ? ... " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি " এই নাম থেকেই স্পষ্ট যে মহাকালের ধারণার ওপর প্রধানতঃ জোর দিতে চেয়েছেন কবি । তারপর " মৃৎশকট " , কোটি কোটি বছর ধরে কালের তথা সভ্যতার বিবর্তনের কথা । তারপর " মানুষের মূর্তি " , আসল যাকে ঘিরে মহাকাল বা সভ্যতার বিবর্তন ধ্বনিত , যা না থাকলে পুরো প্রসঙ্গই অর্থহীন । এই মানুষের মূর্তি ' ছুতোর কাকা'র , 'ন্যুব্জা বৃদ্ধা'র , 'আমার বুড়িমা'র , 'নীল রঙের জামা প্যান্ট পরে রেলের খালাসী গোপেশ্বর কাকা'র , যাদের সঙ্গে নিয়ে কবি দেবদাস আচার্যর হেঁটে যাওয়া অনন্তপথ । হেঁটে যাওয়া মানে কার্পেট বিছোনো রাস্তায় নয় , হাঁটু অবধি ধুলোর রাস্তায় । মাটি আর মানুষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে থাকা কবি এই পথেই ধীরেধীরে অতিক্রম করছেন মহাকালের একেকটি চূড়া।
" ঘুম ও জীবনের মধ্যে রয়েছে এক পরিশ্রম "
  ঘুম ও পতনের সন্ধিক্ষণে নিরীহ মানুষেরা 
  দু'পাশে সাদা দেওয়াল , 
  মাঝখানে পৃথিবীর বয়স হারিয়ে যাচ্ছে " । 
'কালক্রম ও প্রতিধ্বনি'র কবিতার শুরু এইভাবে । আর এই তত্ত্বই পরবর্তীকালে ছবি হয়ে উঠে এসেছে 'মানুষের মূর্তি'র প্রতিটি কবিতার প্রতিটি স্তরে । পরিশ্রমী নিরীহ মানুষ পতনের সন্ধিক্ষণে যুগে যুগে দেশে দেশে । তারা 'ছুতোর কাকা' , 'ঘড়ামী কাকা' , 'গাড়োয়ান পিসেমশাই' বা হয়ত 'পাঁউরুটি হাতে মিস্ত্রীদাদু' , আবার সমষ্টিগতভাবে তারাই এরা যারা ১৯৪০-৪১ সালে বর্মা থেকে দলে দলে ইভ্যাকুয়ায় আসে , তারাই এরা যারা প্রবল বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়ে দু'মুঠো অন্নের আশায় ভিড় করে স্কুলবাড়িতে । দেবদাস আচার্যর কবিতায় এদের মূর্তিই মানুষের মূর্তি , এদের জীবনকাহিনীরই প্রতিধ্বনি করে কালক্রম । সময়ের কালক্রমকে তিনি দেখতে পান এইভাবে : 
  " এই এক সময় বটে , 
     তেজস্ক্রিয় বাতাসে আমরা উড়াই ফানুস 
    আমাদের প্রেতযোনি আমাদেরই বুকের ভিতর
    খোঁড়ে উচাটন , 
    যা ছিল সম্পদ সব 
    তীব্র জারকে খসে ধ্বস হয়ে মিশেছে মাটিতে 
    অথচ আমরা এক ছায়ালোক বৃত্তরচনা করি 
    প্রাণপণ সুতো ছেড়ে ছেড়ে " 
              ( এই এক দুঃসময় ) 
দুঃসময় থেকে ধীরে ধীরে সময়ে আস্থা রাখেন তিনি সত্তর দশকে । " তখন গামবুট পায়ে বিপ্লবী গেরিলার মতো মেঘ নেমে আসে / পৃথিবীর খুব কাছে , প্রায় প্রতিটি ঘরের দরজায় " .... ( ঝড় : সত্তর দশক ) । আর এই বিপ্লবী গেরিলাদের জড়ানো কাব্যরূপ ঠিক কেমন ? " মাঠ ঘাট ঢুঁড়ে ফেরে তীরন্দাজ , / খামারে আগুনধরা শস্যের ওপরে তারা নাচে ! / সমস্ত জগৎজোড়া বাতাস উন্মাদ করা আর এক সময় প্রায় আসে " ... ( হাজার তীরন্দাজ এই দেশ জুড়ে ) । 



   এই হল কালক্রম । আর তার প্রতিধ্বনি করে তারা যারা নিড়িনি চালায় শস্যে, যারা পেরেক ঠুকছেন ভাঙাচোরা আলমারিতে, যারা সেলাইকল চালান এবং তার ঘামে ভিজিয়ে দেন রুটি । কালক্রমের প্রতিধ্বনি করে মানুষের মূর্তিই । মানুষ বলতে তাবৎ খেটে খাওয়া মানুষ । দু'দুটি বিশ্বযুদ্ধ উত্তর নগরসভ্যতার পৃথিবীতেও যাদের জীবনধারা সেই একই স্রোতে , ঘুম ও পতনের সন্ধিক্ষণে । তাদের ছোট ছোট ব্যথা , ছোট ছোট সুখের মুহূর্তগুলি ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে ঘামের সঙ্গে মিশে । তবু তারই মধ্যে তাদের আবেগ প্রিয়জনের জন্য তাদের মমত্ববোধ কবি দেবদাসের কলমে : 
    " সারা দুপুর প্রখর রোদ্দুরের মধ্যে 
             মা সংসারের কাজ করেন 
     আর বিড়বিড় করে মাঝেমাঝেই বলেন - 
    তুই জানিস খোকা , হাটে ছায়া আছে তো ? "

' আজ ' মানে তাদের কথা । ' কাল ' মানেও তাই । আর মহাকাল ? সেই ঘুরেফিরে ' ... তাদের ঘিরে একটু একটু করে বড় হতে থাকি , প্রতিদিন একটু একটু করে ' 

                                          ( চলবে ) 

  

৩টি মন্তব্য:

  1. ভালো লাগল পড়ে। আগামী পর্বগুলির অপেক্ষায় রইলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. ভালো লাগল পড়ে। পরবর্তী পর্বগুলি পড়বার অপেক্ষায় রইলাম। পৃথা চট্টোপাধ্যায়।

    উত্তরমুছুন
  3. মহাকালের চিরন্তন মানুষ মূর্তি। হাঁটু পর্যন্ত ধুলো আর বাজছে শঙ্খ ঘন্টা! মোষের পিঠের পরে আদিম মানব। কবির কথা যেন বোধে আসছে। অনিন্দিতা মন্ডল।

    উত্তরমুছুন

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...