কবি দেবদাস আচার্য'র সার্বিক কবিকৃতি আধারিত বহুকৌণিক আলোচনা
''অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে''
সজ্জ্বল দত্ত
১ .
" It was the hour before the God's awake "-- SAVITRI : Sri Aurobinda .
একজন সার্থক কবির কবিতা নিয়ে আলোচনার প্রধান ক্ষেত্রটি সর্বদাই হওয়া উচিত এই কোটি কোটি বছরের আলোজলোচ্ছ্বাসময় জীবনধারার মধ্যে, মানবসভ্যতার এই অনন্ত যাত্রাপথের মধ্যে তার কবিতা ঠিক কতখানি " সময় " জুড়ে অবস্থান করছে । সময় তথা কালখণ্ডর এই বিস্তার ঠিক ঠিক নির্দিষ্ট করতে পারলে তার মধ্যেই স্বাভাবিকভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যায় কবির কবিতার দর্শন । ফলতঃ বিশ্লেষণ তারপর অনেকখানি সহজ হয়ে ওঠে । কিন্তু " কালখণ্ড " ঠিক ঠিক চিহ্নিত করার কাজটিই যে কঠিন বড় । কী সময়ের বিস্তার ? কতটুকু কে বলা যায় কালখণ্ড ? কোনো টাইম পিরিয়ড ? অমুক খৃষ্টাব্দ থেকে অমুক খৃষ্টাব্দ ? শ্রীমদ্ভাগবতে শ্রী ভগবান অর্জুনকে বোঝাচ্ছেন ব্যক্ত-প্রকাশিত আমরা সবাই অব্যক্ত দ্বারা পরিবৃত । তবে আমার দু'পাশে কী ? ধূ ধূ অন্ধকার? নাকি আদিঅন্তহীন এক প্রান্তর, যে প্রান্তরে আমি সামান্য এক পথিক মাত্র ?
এই আলোচনায় আলোচ্য কবি দেবদাস আচার্য । কিন্তু তার আগে জীবনানন্দর কবিতায় এই মহাসময়ের শুরু ও শেষ এর একটু খোঁজখবর করা যাক ।
"চারিদিকে বেজে ওঠে অন্ধকার সমুদ্রের স্বর,
নতুন রাত্রির সাথে পৃথিবীর বিবাহের গান !
ফসল উঠিছে ফ'লে -
রসে রসে ভরিছে শিকড় ;
লক্ষ নক্ষত্রের সাথে কথা কয় পৃথিবীর প্রাণ !
সে কোন্ প্রথম ভোরে
পৃথিবীতে ছিল যে সন্তান
অঙ্কুরের মতো আজ জেগেছে সে
জীবনের বেগে !
আমার দেহের গন্ধে পাই তার শরীরের ঘ্রাণ,
সিন্ধুর ফেনার গন্ধ
আমার শরীরে আছে লেগে !
পৃথিবী রয়েছে জেগে চক্ষু মেলে -
তার সাথে সে-ও আছে জেগে ! "
( " জীবন " : ধূসর পাণ্ডুলিপি )
আর মোটামুটিভাবে বিস্তৃতির একটা চূড়ান্ত পরিণতি কি এটা হতে পারে ?
" হেরিলাম দূরে বালুকার পরে
রূপার তাবিজ প্রায়
জীবনের নদী , কলরোলে বয়ে যায় ।
কোটি শুঁড় দিয়ে দুখের মরুভূ
নিতেছে তাহারে শুষে ,
ছলা-মরীচিকা জ্বলিতেছে তার
প্রাণের খেয়াল-খুশে ।
মরণ-সাহারা আসি
নিজে চায় তারে গ্রাসি " ! -
কিন্তু এর পরের চারটে লাইন ? .... পরের চারটি লাইনে তো কালের মহাবিস্তৃতির মধ্যে ধ্বংসের পরেও কবি চরম চরম আশাবাদী -
" তবু সে হয় না হারা
ব্যথার রুধির ধারা
জীবনমদের পাত্র জুড়িয়া তার
যুগ যুগ ধরি অপরূপ সুরা গড়িছে মশলা " ।
(" জীবন-মরণ দুয়ারে আমার " : ঝরা পালক)
অর্থাৎ মানবপ্রাণকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে নিয়ে সময়ের বিস্তার কবি জীবনানন্দর কবিতায় অনাদি অনন্ত ! অনেকটা এই ধরনের - সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় ... সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় ... সৃষ্টি ...
দেবদাস আচার্যর কবিতার এই " মহাসময়-বিস্তৃতি " খুঁজতে হলে খুলতে হবে ' মৃৎশকট ' এর পাতা ।
শুরু -
" একজন মহাভুজ বহুদর্শী পুরুষ
দিগন্তরেখায় দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করি
জেগে ওঠো অনন্তবীজ ও ডংকার
আমি চক্ষুষ্মান লোকায়ত গাথার মতো বয়ে যাই
স্বপ্নের পৃথিবীতে ।
# # #
আমার ব্যক্তিত্ব থেকে আরো বড়
ব্যক্তিত্বের দিকে যেতে চাই
শরীর থেকে ছড়িয়ে দিতে চাই
বাষ্প , দ্যুতি ও ঝংকার
কিছু রেণু কর্পুরের মতো বিকীর্ণ করে দিতে চাই
এইভাবেই আমি ঘোষণা করি আমার মুক্তিকে "
প্রবহমানতা --
" এই বিরাট ভূগোল বিশাল মানুষের
স্রোতের উচ্ছ্বাস
মানুষের চোখের জল ও রক্তে গড়ে ওঠে পৃথিবীর
স্নায়ুকোষ ও ফুসফুস
সে দাঁড়িয়ে আছে
প্রত্যেকটা মানুষের মাথা স্পর্শ করে
তার পায়ের নীচে উত্তপ্ত ও উজ্জ্বল দিন
ও রাতগুলি
ফুটে ওঠে তার হাতের চেটোয়
একটি নতুন যুগ ও জীবনপ্রণালী
আকাশের উজ্জ্বল তারার মতো ভেসে আসে
সাড়ে চারশো কোটি বৎসরের জীবাশ্ম এই পৃথিবী
জীবাশ্ম এই পৃথিবী , ওঁ , জীবাশ্ম এই পৃথিবী " ।
আর শেষটা হতে পারে বোধ'য় এরকম --
" আমার শরীর সমকালীন বাষ্পে গলে যায়,
শরীরে থাকে শতাব্দীর উল্কি ,
আমার কালো চামড়া আমি দান করে যেতে চাই
অনাগত সভ্যতার জন্যে " ।
কিন্তু তারপর ? তারপর আর কিছু নেই ? আছে তো ! আছে আশা , আছে ফের আপন সত্তায় কালো চামড়ায় মুড়ে ফিরে আসার বাণী ।
" আবার ফিরে তাকাতে হবে এই জনপদের দিকে - দোদুল্যমান ও ঊর্ধ্ব আকাশে গতিশীল এই পৃথিবীর দিকেই । আবার আমি গড়ে উঠতে চাই নিজস্ব মেরুতে দাঁড়িয়ে " ।
নবদ্বীপ থেকে প্রকাশিত " ঋদ্ধ " পত্রিকার একটি সংখ্যায় ( প্রকাশ - ৯ , শীত ১৪০২ ) কবি অরুণ বসু সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে " মৃৎশকট "কে সরাসরি কালজয়ী আখ্যা দিয়েছেন । " ঋদ্ধ "র সম্পাদকের কালজয়ীর বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে অরুণ বসু বলছেন - " জীবনানন্দর পরবর্তী কবিদের মধ্যে একমাত্র দেবদাসের ' মৃৎশকট ' এর মধ্যে এখনই আমি লক্ষ্য করেছি ' কাল ' এর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মত কিছু বৈশিষ্ট্য যা এর বিরাট ক্যানভাস জুড়ে প্রবাহিত হতে দেখি ধ্রুপদী ক্রমবিন্যাসে । ' মৃৎশকট ' এর বিষয় , মর্মবস্তু এবং বিষয়গত ব্যাপ্তি এতই সুদূর এবং বিস্তৃত যে , একে আমার বাংলা কবিতার চমৎকার একটি উন্মোচন বলে মনে হয়েছে - যা মহাকালকে ছুঁয়েই বেড়ে উঠেছে একটু একটু করে " ।
প্রকৃতপক্ষেই দেবদাসের কবিতার মতো সময়ের বিস্তারে ভাবনার ব্যপ্তি আধুনিক বাংলা কবিতায় খুব বেশি চোখে পড়ে না । ১৯৭০ এ প্রথম কাব্যগ্রন্থ " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি " প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রসিক পাঠক বুঝতে পারেন এই কবি বিশিষ্ট । তেমন কোন বিস্ময়ে বিস্মিত হওয়া নয় , যেন জগতের সমস্ত রহস্যই তার কাছে পরিস্কার । তার কাজ হল শুধু কাব্যিক উপায়ে তার লিপিবদ্ধকরণ । পড়তে পড়তে মনে হয় একেকটা পর্দা উঠছে আর জীবন তথা মানবসভ্যতার একেকটা দিক পরিস্ফুট হচ্ছে । " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি " কিছুটা সমসময়কে ধরার চেষ্টায় ব্যপ্ত থাকলেও তারপর " মৃৎশকট " এবং " মানুষের মূর্তি "তে এই সমসময় চিরকালীন সময় , এবং সেই ধারাকেই কবি অনেকাংশে বহন করার চেষ্টা করেছেন " নিউরোনগুচ্ছ " , " রোজনামচা " এবং " ঠুঁটো জগন্নাথ "য়ে । যেমন " রোজনামচা "র শুরু হচ্ছে এইভাবে -
" একটু কষ্ট আছে , সামান্য যৌন উত্তেজনা আছে ,
অল্প খিদে আছে , আর কিছু নেই "
পাঠক সমসাময়িকতার সঙ্গে যেই যোগাযোগ স্থাপন করতে শুরু করল , অমনি কয়েক লাইন পরেই ব্যাপারটা দাঁড়াল এইরকম
" শূন্যতা ঘুরছে গাঢ় শূন্যতার মধ্যে একা ,
হালকা অপরূপ আর কিছু নেই " ।
যত এগিয়েছে কবিতা, যত প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ, তত বিবর্তিত হয়েছে দেবদাস আচার্যর কবিতা । আর এই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মূল যেটা উঠে এসেছে সেটা তার কবিতায় ভাবনা ও অনুভূতির ব্যপকতা , 'কাল এর বিরাট বিরাট ব্যপ্তি । যে কথা বলেছেন অরুণ বসু " মৃৎশকট " সম্পর্কে, সে কথা সম্ভবতঃ দ্বিধাহীনভাবে বলে দেওয়া যায় সামগ্রিকভাবে দেবদাস আচার্যর কবিতা সম্পর্কেই ।
( চলবে )
খুবই ভালো লাগল ।পড়তে পড়তে আগৣহ বাডছে।তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ।দেবদাসকে শুভেচ্ছা ।গৌরশংকর বনদোপাধধায ।
উত্তরমুছুনঅপেক্ষায় আছি। এই অংশটুকু সবে কথামুখ নির্মাণ করল। এবং যা বূঝেছি যত এগোবে জমে উঠবে। দেবদাস আচার্যকে আরো চিনতে চাই। দেবাশিস ঘোষ
উত্তরমুছুন" কিছু রেণু কর্পুরের মতো বিকীর্ণ করে দিতে চাই / এইভাবেই আমি ঘোষণা করি আমার মুক্তিকে " - অসাধারণ এই লাইনগুলি আমাকে আবিষ্ট করে দিয়েছে। খুব ভালো লাগছে এই কবিকে নিয়ে লেখা।
উত্তরমুছুনপড়ছি, বড় কাজ করছেন।
উত্তরমুছুনপরের পর্বের অপেক্ষায়।
পঙ্কজ মান্না
চার দশকের বেশি সময়কাল ধরে দেবদাসদার নিয়মিত নিবিড় সাহচর্য পাচ্ছি। তাঁর কবিতাযাপনের প্রতিটি অনুচ্ছেদে মুগ্ধ হয়েছি। তোমার মূল্যবান মূল্যয়নের মাধ্যমে আরো একবার দেবদাস পরিক্রমা সম্ভব হবে, সজ্জ্বল। -রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
উত্তরমুছুনঅত্যন্ত মূল্যবান লেখা পড়ছি। সম্পাদককে অসংখ্য ধন্যবাদ
উত্তরমুছুনশুরু করলাম। মহাকালে প্রবহমান ধ্রুপদী জীবনের প্রকাশ জেনে নেব। কবিতা বিষয়ে অজ্ঞ আমি এইভাবে আপনার কাছ থেকে পাঠ নেবো। 🙏 অনিন্দিতা মন্ডল।
উত্তরমুছুন