শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১

সজ্জ্বল দত্ত'এর কবিতাগুচ্ছ

 


সজ্জ্বল দত্ত'এর কবিতাগুচ্ছ 





( আমার বাড়ির সামনে ছোট্ট একফালি মাঠ , 

তারপর আর একটা বাড়ি । সাজানো গোছানো বন্ধ  , 

কেউ থাকে না সেখানে । কেউ থাকে ? ) 



তালা - ১ 


... তারপর লাগাতার লোহাঝালাই ফুলকি 

কখনো হালকা কখনো জোরালো রঙ 

                                  আগুনে ফুটছে ছবি 

যতটা সময় শুধু লাগিয়ে ঘোরাতে চাবি 

                                   অন্য ত্রিসীমানা -- 

খাবার 

বাসস্থান 

নড়াচড়া হাবভাব 

সবটা কেমন যেন 


ফাঁকা বাড়ি ঘুরিফিরি ...


পাঠক বন্ধু হে মেলাও আপন খাতা 

খবর পেয়েছিলাম গোটা বারো বছরে 

ফট্ করে একদিন কালীপুজো সাপবাজি 

গোড়ায় আগুন দিলে কেউটে লম্বা কালো 

সামনে গ্রীলের গেট ফাঁক গলে তলা দিয়ে ...

পেণ্ডুলামের মতো দুলছে বন্ধ তালা 

নির্বিকার হেঁটে গেছি 

সোজাসুজি এগিয়েছি 

হাতে মোটা রিঙ-এ বাঁধা চাবি 




বেডরুম - ১ 


সাপ বেরিয়েছি ফের অ্যাসিড তুচ্ছ করে 

পারি না গো বন্ধুরা 

এমন কি জন্য দেখি কেন হয় 

কিলবিল করি গোটা ধবধবে বিছানা জুড়ে 

ওপরে উঠতে থাকি 

সত্যি পারিনা ... জ্বালা ... 

পাকিয়ে দড়ির মতো 

দোমড়াই মোচড়াই 

জিভটা ঠেকিয়ে সোজা উঠতেই থাকি ... ঘুরি

নদী সাঁকো সমুদ্র সূর্যোদয় পাহাড় পর্বত টিলা 

নীল বিষ ঢেলে যাই 

জঙ্গলে ফণা তুলি 

আছড়াই ছোবলাই 

গোটা দাঁতে ভাঙা দাঁতে 

এদিক ওদিক দেখে তৈরি গর্তে জলদি 

শান্তি কিছুক্ষণ 

শীতঘুম 




বেডরুম - ৩ 


সদ্য গোঁফের রেখা হালকা দাড়ি গালে 

লম্বামুখ তেজী টাট্টুঘোড়া আরামে উপুড় হয়ে

আমি তার পিঠে বসেছি এলিয়ে শুয়ে পড়েছি 

উনুন জ্বলছে ... লাগাম ধরেছি শক্ত হাতে 

খুরের ঠকঠক শব্দ ছোটার তালে তালে কোমর 

রাস্তা ছুটছে আগুনের দিকে ... 

দৃশ্য পাল্টালো ... 

সামান্য কাঁপছে ছবি 

একটু আগে খাওয়া মুঠোয় মাটনরোল 

কাগজ খুলে যাচ্ছে 

চারপাশে চিলিসস কাঁচালঙ্কা পেঁয়াজ নুন 

চিলিসস দখল নিচ্ছে বোতল বোতল নামছে

ঘিরে ধরছে চতুর্দিক 

আর কিছু মনে নেই 




স্নানঘর 


সাবান ভাসছে ভুতুড়ে সাবান 

হাওয়া থেকে ম্যাজিকের মতো নাচছে শূন্যে

এপাশে ওপাশে গোল হয়ে 

ঘুরেফিরে বাঁয়ে ডানে 

আরো নীচে আড়াআড়ি সরছে নামছে 

ঢেউ খেলতে খেলতে লম্বা মেঝের দিকে 

আবার ওপরে উঠে 

সাবান ভাসছে ফাঁকা ঝিরিঝিরি ফেনাজলে

কেউ কোথথাও নেই 

একা হাতে বিছানায় লম্বা ধারালো ফলা 

সামনে পিছনে সামনে পিছনে 

ছুরিতে মাংস কাটছি 

রক্তে ফিনকি 

আগুন উড়ছে চোখ জ্বলছে ভেতর পুড়ছে 

আ : কী আরাম দেখি ঝাঁকি মেরে আলো আয় 

সাবান ভাসছিল ঝর্ণা টানছিল 

অন্ধকার ফালাফালা 

স্নানঘর ধোঁয়ায় ধোঁয়া 




কিচেন 


আবছা ওভেনের নীল শিখা 

ভীষণ আবছা ... 

তার সামনে শাড়িতে প্যাঁচানো 

             গোটা চকচকে কাগজ শরীর 

ঘাড় ... গলা ... কাগজের হাত নড়ছে 

নিঃশব্দে দ্বিতীয় মূর্তি 

একটু লম্বা 

দুটো ছায়া নড়াচড়া 

কিছুটা স্পষ্ট এখন 

এক বার্ণারে ডিম ফুটছে দুটো 

আর একটায় কেটলি তাতছে 

ডান হাত বুলোতে থাকি আমি 

             বাঁ হাতের কাঁধ অবধি নিজের 

সমস্ত আঙুল তালুর চামড়ারস 

           সামনের রাইটিং প্যাডের কাগজে 

ওপর নীচ মাঝখান 

সাদা ফর্সা তেলতেলে 

নীচ থেকে ওপরে ফের ওপর থেকে নীচ 

পেনসিল ছুলে দিচ্ছে অদৃশ্য কেউ একটা 

তীক্ষ্ম ছাল ছাড়ানো শিস 

তেল মশলা লঙ্কাবাটায় ঝালঝাল 

               কবিতা লেখার শুরু 

আবছা কিচেনে শুরু আমিষরান্না 




স্যামসঙ গ্যালাক্সি 


... সঙ্গে সঙ্গে সামনের গ্লাসভরা পেট্রলে 

                 বারুদ গুলতে থাকি 

মাঝরাতে আশ্চর্য রিংটোন  

ও বাড়ি কলিং 

নিমেষে চাঙ্গা জেগে স্বপ্নে আমি 

চোঁ চোঁ করে মেরে দিই গ্লাসের তরলটুকু 

কথায় শব্দে এ'বাড়ি ও'বাড়ি ছায়া 

ছায়াপথে ভাসতে থাকি 

বাপ মা বইপত্র বুলির তোতাপাখি 

                  বগলে জাপটে ধরে 

কালোগর্তে ফুটন্ত গ্যাসে 

                  উন্মাদ পুড়তে থাকি 

হাত পা ছুঁড়ে নাচতে থাকি জ্বলন্ত নাচ 

মুখ খুলছে ভিসুভিয়াস 

আধপোড়া বেজন্মা শালা 

লাভা ... লাভা ... লাভা ... 




আলমারি 


শাড়িভর্তি আলমারি 

রঙিন রাক্ষুসী 

ও বাড়ি আপনমনে 

ওরে বাবা ভয়ে কাঁটা 

সারাঘরে আলো নেই ওই কোণ গাঢ় নীল 

দেখছে হাঁটছে এগিয়ে আসছে 

খড়ের পুতুল আমি নিজস্ব বিছানা জুড়ে 

আলমারি দিয়ে চাপা 

পিষে যাচ্ছি মরে যাচ্ছি 

শাড়ি সালোয়ার টপ ওপর নীচ ওপর নীচ 

কোন্ সমুদ্রে কোথায় রক্তে নুনবৃষ্টি 

পাল্লা হাট গোদরেজ 

যত গর্ত সুড়ঙ্গপথ উল্টো দুলে দুলে 

বিচুলি উপড়ে ছিঁড়ে নুনের রক্তঢেউ 

                   ঢেউয়ের ওপরে ঢেউ 

দগদগে লাল দাগ 

জ্বলছি জ্বলবো 

কোন্ জন্ম কোন্ কালে 

                  গ্যাসভর্তি লাইটার হাতে 

                  ভেতরে কেউ একটা 

স্বর্গআরাম সিঁড়ি 

চুপচাপ শুয়ে একা হাত পা শরীর 

ভয়ফয় পালিয়েছে 

আলমারি উল্লাস প্রচণ্ড নিঃশ্বাস 

শাড়ি দলবলে টানা খড়ের পুতুল দাহ 




ড্রেসিং টেবিল 


মদনং স্তবস্তুতি 

বারোটায় প্রস্তুতি 

চিরুণি কোমর চুল 

লাল নাইটি সাদা ফুল 

ম্যাগিহাতা উঁচু হাত 

বগলে বাঘের পাত 

হাতে ঘাত প্রতিঘাত 

হায় রে জগন্নাথ 

ঘড়িতে বারোটা দশ 

গ্লেসিয়ার ফেটে ধ্বস 

ক্ষিতি অপ তেজ বায়ু 

ও বাড়িতে ডোবে স্নায়ু 

কবি শিল্পী দাঁড়কাক 

বগলে বিদগ্ধ বাঘ 

জানলা-জানলা পথ 

' ভালো ' ভাসছে ভাসে ' সৎ ' 

যেভাবে জোটাতে রুটি 

খিদেপেটে ছুটোছুটি 

তেমন এ' বাঘের ছোটা 

মহাশূন্যে হাতে ওটা 

দু'পাশে ড্রেসিং কাঁচ 

ভাজা মাছটি ... মুখে লাজ 

বিদগ্ধে ব্রহ্ম বশ 

অনন্ত বারোটা দশ 

উলুধ্বনি বাজে শাঁখ 

জানলা সামান্য ফাঁক 




ছাদ 


ধাপে ধাপে মোটামুটি চল্লিশখানা সিঁড়ি 

শুকনো জামাকাপড় কার্ণিশ থেকে তুলে 

                     একটা একটা হাতে 

হাওয়ায় দাঁড়াই একটু 

ঘাম শুকোচ্ছি 

আগুন বিদ্যুৎ নুন কালকেউটের বিষ 

                      যতটা গভীরে গ্যাছে 

চরাচর শুষে নিলে শরীর শোলার বল 

আরো হালকা ধুলোকণা হাওয়ায় উড়ব যদি

আকাশে বাউলমেলা মিহিশব্দে একতারা 

শিব-শিবাণী সুর কতটুকু দিতে পারি 

বিকেল ফুরোনো রঙে বেশ্যায় ব্রাহ্মণে 

                     সটান তুলে নে দেখি 

                             পাগলা চরণদাস 

টুকরো জড়িয়ে দে উত্তরীয় গেরুয়ায় 

নাইটি জামা জাঙিয়া প্যান্টি ব্রেসিয়ার 

ঢালুপথে ওপারে সূর্য 

শেষ দু'একটা চিল 

জানলা বন্ধ করে কালোপর্দা আধা টেনে 

                              উঠে এসেছি 

নামার সময় হল 

এখনও মে'ন গেট খোলা পড়ে আছে 




তালা - ২ 


যতটা সহজ খোলা বেরিয়ে আসতে কালঘাম

কোথা থেকে  টেনে ধরে গরম জ্বলুনি 

ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ সমানে ও'বাড়ির 

                    ঘরবারান্দা রহস্যরোমাঞ্চ 

তুমুল স্বপ্নঘোর 

ছোট্ট ব্যাসের বৃত্তে পরিযায়ী পাখি আমি 

ক্রমশঃ তলানি আলো 

                    অবশ শব্দতাপ 

পেছনে ছায়াভেতর ঝলসে পুড়িয়ে ফাঁকা 

রক্ত বলছে স্থিরবার্তা এবার 

ষাট... সত্তর...আশি

তালাচাবি ঠোঁটে নিয়ে একদিন সোজা 

                     পাশে বটগাছ মগডালে 

আশ্চর্য সবুজ বৃত্ত বায়ুভর্তি ছবিদেশ 

চারপাশে নীচে কত ফাঁকা বাড়ি খোলা হাট

সাদা ডানা ঝাপটাই 

এবার বিদায় চাবি 

উজ্জ্বল নতুন তালায় হাল্কা মরচে তালায় 

                      অনন্ত সরলরেখা 

                                টানা ইতিহাস লেখা 

চাবি ছুঁড়ে ফেলি সেই মহাপথ গতিস্রোতে 

অপার অন্তরিক্ষ ... সাতঋষি সংসার 

                      আগামীর ধ্রুবতারা আলোয় 




কবি পরিচিতি ~


কবি সজ্জ্বল দত্তের বেড়ে ওঠা নদীয়া জেলার রানাঘাট শহরে। 

পেশায় জীবনবীমা নিগমের কর্মী বর্তমানে বারাকপুর শহরের 

বাসিন্দা। একসময়  'মধুবন' পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এখন 

'বারাকপুর স্টেশন পত্রিকা'র সম্পাদক মন্ডলীর অন্যতম 

গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।


প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : 'স্বাগত শ্রাবণ-জোনাকি', 'পোস্টমর্টেম' এবং 'দাগ'।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...