শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১

ঈশাণী রায়চৌধুরী'র কবিতাগুচ্ছ

 ঈশাণী রায়চৌধুরী'র কবিতাগুচ্ছ




চন্দ্রাতপ


আলিঙ্গন- আড়াল  দেব ভালবাসা হলে...

     মন ভারি নরম লাজুক, 

 আলতো আদরে থাক   

     চাকভাঙা - সুখ।

 নিষিদ্ধ তকমা দিলে? উঁহু, 

চাঁদও তো ঢেকে রাখে মেঘ ,

   চুমুর চকোর অভিলাষে।


পানপাতা পুড়ে যায় আগুন দহনে। 

ছায়া থাক বোরজের নিরালা কোণায়...

      চোখের আগুন  বড় নির্মম 

         আগলাও বুকে করে...

     ভালবাসা লেগে থাক ঠোঁটে 

    চোখে মুখে, আঠালো আশ্লেষ!

    

 মাটিতে প্রসব নামে জলের নরমে।

     ভ্রুণের মতন কাঁচা গন্ধ

     পাখির পেটের ঘন গরমে

     রোঁয়া তোলে নিপুণ  বিশ্বাস ।

মা নিষাদ ত্বমগম ! প্রেম চায় পাতার আড়াল।

শ্রাবণ আড়াল করে রাই-সই, কৃষ্ণ-কিশোর কাছে এলে।

ঋতুমতী মাটির গভীরে শস‍্য নামে 

          বৃষ্টির বীর্যপাত হলে !




হয়তো

  

 নিঃশব্দ অশ্রুপাত হলে -

 সবাই শুনতে পায়না, ভাবে

 শিশির হাঁটছে দূর্বাডালে।


পাতার আড়ালে কুঁড়ি ফোটার

তোড়জোড় করলে ভাবে

মনখারাপের সোঁদা সুগন্ধ!


  বলতে পারো ভাবনা

    কেন দৃষ্টিহীন!

রেখে চলে যায় জলের

     ওপর আবছা ঋণ!




আরণ্যক 


চল আজ তুমি-আমি অরণ্যে হারাই...

আঙ্গুলে আঙ্গুল জুড়ে, চোখে মেখে চোখ

ডালপালা ছেঁড়া রোদে ভিজি কিছুক্ষণ 

ঘাই হরিণীর ডাকে মদালসা মন।


শুকনো পাতায় পায়ে এস্রাজ  বাজে ...

কোথাও দূরের বনে মাদলের হাঁক 

তোমার গভীর শ্বাস পাতার পিরিচে

মহুয়ার নেশা ঢালে আদিবাসী নাচে।


দেহাতি মেয়ের মত তাগড়াই লতা

বুকেপিঠে জড়িয়েছে

প্রেমপ্ৰিয় গাছ

এক গাছ বাঁধা হলে আরেক গাছের

হাতখানা ধরে থাকে বেণীর বাঁধনে

এখানে স্বাধীন প্রেম লোকলাজ নেই...

এখবর এ বনের পাতারাও জানে।


এরপরে ছায়া কিছু ঘন হয়ে এলে... 

এই বন শিহরণ... এই রস  মেখে

চুপিচুপি শুয়ে পড়ি পাতা পিঠে রেখে ।

এ আকাশ এই ঘাস এই ফিসফাস...

পাশাপাশি তুমি-আমি আর মহাকাল ।

কোন কথা বাকি নেই শুধু অনুভব... 

আলো হাওয়া মেখে পাখি নৃত্যে মাতাল।


হঠাৎ চমকে বুঝি শিকড় গজালো

তোমার ও শরীর জুড়ে ডালপালা এল

আমি - তুমি-অরণ্যে নেই কোন ফাঁক

অস্তরবি বুনে দিল আলোর সোহাগ! 



শঙ্খ লাগাই 


আলতাপেড়ে মন এয়োতির মত লাজুক.....

কলমিলতার কচি শরীরে গা শিউরোনো নরম।

আমাকে ঐ জলজ যৌনতায় আশ্লেষে বাঁচতে দাও !

বারুদের বীভৎস নরক আসঙ্গ থেকে বাঁচাও।

ওগো আমি চোখ ধুয়েছি জোছনার তরলে...

গুঁড়ো গুঁড়ো ঠান্ডা সবুজে ভরপুর  পাকস্থলি 

কটা দিন জীবনকে বেঁধে রাখি মধুমঞ্জরী পাকে...

তারপর মেনে নেব নরকাগ্নি তুষ, যদি দাও!

আজ এসো সরীসৃপ প্রেমে শঙ্খ লাগাই !



দেখা হলে


চোখ খুলবো না!

এত স্মৃতির স্লাইড নামবে...

নানা চেহারার ছবি ফুটবে... 

যা দেখতে চাই... চোখের ওপর আঁখিপল্লবে আটকে যাবে ।

সব ছাড়িয়ে... সব জড়িয়ে কিই বা তোমায় দেখতে পাবো!

তার চেয়ে থাক চোখের ভেতর আরেক চোখের লেন্সবন্দী...           

তোমার ছায়া আমার মতো।

নতুন করে আজকে আবার তোমার কাছে হারবো না!


তুমি যা দেখ আমার মুখে সে সুখ যদি খুঁজে না পাই...

আমার চোখে আগের মত সেই  রোমান্স আছে কি ছাই

তার চেয়ে বেশ তোমার সামনে অনুভবেই তোমায় ছোঁব -

চোখের ভেতর আরেকটা চোখ জেগে থাকুক তোমার মুখে

সে চোখ তোমায় রোজ এঁকে নেয় নিজের মনের উড়ান ভরে 

মাটির চোখে দেখতে গিয়ে আলোর আদল যদি হারায়!

সেই ধাক্কা সইবে না গো যে চোখ আছে রক্ত ধারায়!



মন কেমন 


একটা বয়স ছিল যখন মন কেমন করলে জল আসতো চোখে...

জীবনের তাতাপোড়া দিনগুলো সেই জলে ভিজে নরম কাদার মত আগলে রাখত!

ধীরে ফোঁটা ফোঁটা শক্তি জমলো জলে.. 

ছোট কাঁটা উপড়ে ফেলার সাহস জমলো বুকে,

সে এখন দেখতে পায়... ফুটপাতে জরাজীর্ণ মাকে আঁকড়ে  শৈশব...

হুপিং কাশি নিয়ে ভারা বেয়ে উঠছে মজদুর...

নৃশংস  অ্যাসিডে ক্ষতবিক্ষত  মেয়ে !

বিশাল বস্তা নিয়ে আস্তাকুড় ঘাঁটছে অসহায় শিশু!


না আর চোখে জল আসেনা  বরং  আগুন ধরে যায়!

বুকে হাতুড়ির ঘা পড়লে আমি মন কেমনকে

মশালের মত লেলিহান তুলে ধরি!


একটা দুটো.. করতে করতে শেকল বানায় অনেক হাত ।

তাদের চোখে শপথ!

বন্ধু, মন কেমন যদি করতেই হয়... এদের মন দাও!

   মন ভাল হওয়ার আশ্চর্য মলম আছে এদের কাছে!



ভোরের  আলো


ঘাস উঠেছিল বুকের উঠোন জুড়ে -

তখন আমার বয়স ভোরের আলো  ।

কচি  কিশলয় নিজের গন্ধে চুর ,

মন জুড়ে তার বিদ্যুৎ চমকালো ।


তুমি ডেকেছিলে উড়িয়ে দীঘল ভুরু -

শক্ত মুঠিতে ধরেছিলে ফনা বেণী ,

 কি জানি কি দেখে রহস্য মাখা চোখে -

এড়াতে পারিনি জীবনের হাতছানি ।


হঠাৎ সময় ঝাপট মারলো ঝিলে

শুঁষে তুলে নিলো সকালের মিঠে আলো ।

ক্ষীণ হতে হতে ভেসে গেল চেনামুখ 

বেসামাল করে জীবনই তো  ফিরে দিল !


এখন কঠিন সময়ের সাথে ঘর...

পলি জমে জমে ম'রে গেছে সেই নদী।

খুব মেপে বুঝে জীবনের পথে  হাঁটি...

আজকে আমার হারাবার ভয় নেই...

শক্ত হয়েছে পায়ের তলার মাটি ।


জংধরা কিছু দরজা ভাঙছে রোজ 

দখল নিচ্ছে রোদ - জল ভিজে মাটি !

বয়ে যাওয়া দিনে বিঁধে আছে কত ব্যাথা...

মনখারাপেরা হাপর চালায় বুকে।


তবু জানি ঠিক আসবেই ফিরে তুমি -

ছায়াপথ ধরে অভিসার  সংগমে  ।

আমি আজও আছি পুরোনো গন্ধ মেখে...

স্মৃতিপথ চেয়ে প্রতীক্ষা সংযমী।



রসাতল


যেতে যেতে খানিক রোদ রেখে যাচ্ছে  শেষ বিকেল,

     বিষণ্ণ তবু  রক্তাভ ।

বকের সারির পিঠে তির্যক দিন।


            এই তো সময়!     

টেনে রাখা  বোতামটা ছিঁড়ে গেল। 

এখন সোডার বোতল হয়ে ভেঙে

            যাক অন্ধকার।


      আঃ কি আরাম ! 

     জলের ভেতরে জল 

  লোনা স্বাদে হেঁটে যায়  রাত। 

   ঘুমের থেকে বেছে বেছে সুখ   

    খুঁটে খায় দুঃস্বপ্ন !


 কি নরম রোদের তোয়ালে!

 ভোররাতে শুকতারা

                          নিভুনিভু  হলে

        অন্ধকার ঝাঁট  দিয়ে  

               ডুব দেব                  

        পরম   রসাতলে ।।



রাত কোজাগরী


        খেজুর রসের মত 

হালকা সোনালি ফাঁদ  পাতে    

         কোজাগরী  চাঁদ!             

মধুর তীক্ষ্ম গন্ধে অবশ স্মায়ু -

   জোড়া  মদালসা  ঘোর ।

আকাশে কে হানা দেয়  হিম অবসাদ  মেখে ?                 

        নিশিকুটুম্ব   চোর?        

অদেখা মাকড়সা এক নিশিঘোরে বুনে চলে জাল...

অশ্বিনী কৃত্তিকা রোহিণীরা ধরা পড়ে, জানে মহাকাল।

বাসার দেওয়াল ফুঁড়ে উঁকি দেয় বেহায়া নাগর 

পাখি কাঁপে ডানাজুড়ে মন্ত্রমুগ্ধ 

এ কোন  প্রহর!

রসকলি আঁকে রূপো- জোছনায় 

   রাধিকা সজনী

কোথা গেলে কানু পাই কালো সখা

   মরকত মণি !

নদীর নরমে মেখে জোছনারা পানসি ভাসায় ...    

   ভেসে চলে

   নিরুদ্দেশে...

জলের গন্ধ জুড়ে ধোঁয়া ওঠে অগুরু আবীর...    

   চাঁদচরা গরম বাতাসে।

লক্ষ্মীপ‍্যাঁচার মত সাদা মেঘে স্বর্ণলক্ষী চাঁদ...

    রহস‍্যবিলীন  রসে মুগ্ধ করে 

চরাচর...ভেঙে দেয় বাঁধ।

এসো আজ এ কুহকে তুমি আমি 

    চেতনা নিবিড়।

বুকে তবু জেগে থাক শারদশিশির

     মাখা সোনালি শিবির।



খুদকুঁড়ো 


চাঁদের অমোঘ টানে, ফুলে উঠে 

বুক ভ'রা নদী,

নিজেকে উজাড় করে দিতে চায় যদি...

খুদকুঁড়ো যা ছিল মুঠোভরা ঘাস,

তোর দরজায় দেবে সবুজ বিশ্বাস।

সকালে পায়ের পাতা ছুঁয়ে দিস যদি...

টের পাবি নরম সে মেঘলা সুবাস।  



কবি পরিচিতি  ~


কবি ঈশানী রায়চৌধুরী নিবিড় গ্রামের অনুষঙ্গে বড় হয়েছেন 

তাই  সহজ জীবনে বাঁচেন। কলকাতা  বিশ্ববিদ্যালয়ের 

স্নাতকোত্তর আর ন‍্যাশানালাইজড ব‍্যাঙ্কের কর্মসূত্রে বহু 

মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ। যুক্ত আছেন এন জি ও'র সঙ্গে 

যেখানে মূলত সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ হয়। কবিতা 

ছিল রক্তে এক অন্তর্লীন অনুভব হয়ে। প্রকৃতি , বই  আর 

কবিতা ...এই তিন ভালবাসা। 

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'আমি শুধু আমিই বনফুলে'।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...