মীরা মুখোপাধ্যায়'এর কবিতাগুচ্ছ
★ অপেক্ষা
প্রতিদিন আবহাওয়া অফিস বলে
তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যাবে দক্ষিণের প্রাচীন ঝরোখা
আমি সাবধানী তাই ভয় পাই, জানলা বন্ধ করি
সদ্যকেনা পর্দা সরাই
কিন্তু কোথায় !
তুমুল বৃষ্টির জন্য আর ভয় নেই
এখন অপেক্ষা করি।
হাট করে খোলা থাক
তার জন্য ঝরোখাদর্শন
★ বন্ধুর কথা
আমি প্রথম তাকেই দেখি এতো ঝকঝকে
বুদ্ধিদীপ্ত, টানটান এক কবি।
বৈরাগ রঙের দীর্ঘ পাঞ্জাবী ও জিন্স।
রেলের ওপারে থাকে...
কবিরা , বিশেষ করে আমাদের গ্রাম্যশহরে
একটু অগোছালো হবে, খানিকটা এলোমেলো
এরকমই চোখসওয়া
কিন্তু সে তেমন নয়, একেবারে অন্যরকম।
নিজের কবিতা নিয়ে তার খুব মায়া ছিলো, অহংকারও
'মাধবীলতা ' ও একটি 'রবীন্দ্রগানের ' মতো
তার স্মৃতিভারাতুর কিছু
শব্দচয়ন আজ ভারি মনে পড়ছে
সে নেই।
কিন্তু সত্যি কি নেই !
তাহলে কি করে লেখে সজ্জ্বল
"বেরিয়ে পড়েছি আজ অলৌকিক অক্ষরের খোঁজে"
★ বেলান্ত
কি করে এতটা পথ পেরিয়ে এলাম
ভাবলে অবাক লাগে
আজ আর ডাকনামে ডাকবার কেউ নেই
বুড়ি মাগী, আমি নাকি চন্দ্রমল্লিকা ...
হাসি পায়,
বার্ধক্যে কেমন যেন লজ্জা থাকে
স্বীকার করবে না জানি...
প্রোফাইল খুলে দেখো
আমরা সবাই যৌবনের মুখ এঁকে
অনুরোধ লিখে পাঠিয়েছি
★ ভাস্কর্য
সমুদ্রের তীরে বসে
উদাসীন আঁকছিলো ছেলেটি
ঢেউ এতোদূর এসে মুছে দিচ্ছিল না ঠিকই
তবে মাঝে মধ্যে ছুঁয়ে দেখছিল দৃশ্য
একবারই দেখলাম, সেও আঁকছে
সে আঁকছে একজন উদাস শিল্পীকে,
সমুদ্রের তীরে বসে যে আঁকছে
বালি দিয়ে সমুদ্রকেই
★ পথরেখা
যে পথ ধরে এসেছিলাম আমি
সে পথ হয়তো হারিয়ে গেছে একাই
উচিৎ ছিলো চিহ্ন রেখে আসা
সাদা ফুলের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া,
যেমনটি ঠিক যুগলপ্রসাদ দিতো
সন্ধ্যেবেলা সাদা ফুলের দিশা
অন্য কাউকে দেখিয়ে দিতো পথ
সকালবেলা একটু বসতে বলে
বাতাস করতো হাতপাখাটির মতো
যে পথ ধরে এসেছিলাম আমি
সে পথ তো আর ফেরার জন্যে নয়
ফেরার পথে আগুন জ্বলে ওঠে
কেমন আগুন, সেটাই তো বিস্ময়
★ মনখারাপের লেখা
যে নদী পেরিয়ে যাচ্ছি আমি
যে পাথরে বসে
একটু জুড়িয়ে নিচ্ছি
সে স্রোতে, সে শিলার শিরায়
তোমার আভাস মিশে আছে।
হিচ হাাইকিং করে চলে যাওয়া দলটি এখন
শহর পেরিয়ে গেছে,
তুমিও ওদের সাথে...
বৃষ্টি নেমেছে তাই
আমি একা জ্যোৎস্নায় ভিজে
পার হচ্ছি নদী
তোমরা যেদিকে গেছ
ঠিক তার বিপরীত দিকে
★ নস্টালজিয়া
আমাদের এদিকে আগে মাঠ ছিলো
উলুখাগড়ার বন
বর্ষার পর পরই চামর দুলিয়ে দেখা দিতো
আদুরে শরৎ ,
তখন মাঠের ধারে বসে থাকা
আঃ ! সে এক স্বপ্ন যেন...
মনে হতো চারিদিকে সমুদ্র সফেন,
নিজেকে কেমন যেন দ্বীপ মনে হতো
এখন সেখানে বহু বাড়ি উঠছে
কোথাও সমুদ্র নেই, উলুবন নেই
তবু আমরা বসে থাকি
বসে বসে দেখি ওদের বাড়ির প্ল্যান
আধুনিকতর বাথরুমের আয়োজন।
বিকেল হারিয়ে যায় ক্রমে,
উলুবন মিশে যায় মেঘে
আমাদের সাধ্য পেরিয়ে...
★ পস্থিউমাস
হয়তো দিনটা একটি রবিবার
গঙ্গার যেদিকটা দাহভূমি
সেদিকে একজন জল ঢেলে ধুয়ে দিলো
চিতা অবশেষ
হয়তো দিনটা তারা অন্যভাবে কাটাতে চেয়েছে
সপ্তাহে একটা ছুটি...
অথচ কোথায় কি, ফিরতে ফিরতে রাত
লোহা ছুঁয়ে , নিমপাতা দাঁতে কেটে তারা ফিরলো
সেদিনও সকালে ঠিক অন্য অন্য সপ্তাহের মতো
আমার সামান্য একটি লেখা বেরিয়েছে
আমার হলো না দেখা
হয়তো সেদিনও একটা রবিবার...
★ অথ মাধবীলতা
আমাদের জীবন থেকে এতো তাড়াতাড়ি
মাধবীলতার কথা মুছে যাবে ভাবিনি...
আমি তখনও চোখের উপর হাত রেখে
পাখি খুঁজছিলাম একটি কবিতা লিখবো বলে
অথবা মাধবীলতা
মাধবীলতার জন্য উঠোন না থাক
ছোট্ট একটা বারান্দা তো ছিলো !
কিন্তু জীবন থেকে মাধবীলতারা
কবে যেন মুছে গেছে
★ একগুচ্ছ বিষণ্ণ সিম্ফনী
আধো অন্ধকার ভ্যাপসা কুঠুরি ভেদ করে
পুরোনো কবিতাগুলোর কলার ধরে টেনে আনি
কখনও কখনও লিকলিকে নড়া ধরেও,
তারপর বসিয়ে দিই মন্দিরের সামনে
নে, ভিক্ষে কর
দূর থেকে লক্ষ্য রাখি কে কি পাচ্ছে....
ট্যারাব্যাঁকা লেখাগুলোর
সব খুঁত চোখে পড়ে
রাত নামুক, কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে
চোরকুঠুরিতে পুরে দেব
পরদিন আবার বাস টার্মিনাসের সামনে...
কবি পরিচিতি ~
বয়স ষাট। জন্মস্থান কলকাতা। কবি মীরা মুখোপাধ্যায়
বর্তমানে শিমুরালী - নদীয়া নিবাসী। চরম দারিদ্রের জন্য
প্রথানুগ লেখাপড়া বেশিদূর হয়নি। ডাকবিভাগে চাকরি
করেছেন। নির্ধারিত সময়ের দুবছর আগে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে
নেন। কারণ শরীর। লিখতেন অনেক আগে থেকেই, মাঝে
জীবনের কিছু অসহ ওঠাপড়ার জন্য বছর দশ-পনেরো
লেখালিখি বন্ধ ছিল, খানিকটা অভিমানেই।
কবির নিজের ভাষায় - "কিন্তু স্বেচ্ছাবসর নেবার পর একটা
স্মার্টফোন কিনলাম আর পিঁপড়ে মারার ঢংয়ে টিপে টিপে
টাইপ করে লেখা পাঠাতে শুরু করলাম। বা বলা যায় শিং
ভেঙে...। তোমাদের মতো ছেলে ছোকরারা নির্ঘাত হাসাহাসি
করো। এটুকুই, বলার বিশেষ কিছু নেই রে ভাই।"
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ছন্ন সেরেনাদ কিংবা... এবং অরোরা বোরিয়ালিস।
অসাধারণ লেখা। আরও লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম
উত্তরমুছুন