শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১

ইন্দ্রাণী পাল'এর কবিতাগুচ্ছ

 ইন্দ্রাণী পাল'এর কবিতাগুচ্ছ 





অভিবাদন


অস্তিত্বহীনতার ওপারে আমাদের দেখা হয়েছিল

আমি তখন শরীর থেকে বর্ম অস্ত্র ঢাল খুলে ছুঁড়ে ফেলছি।

সহজ লোকের মতো জীবন আমাদের নয়

আমাদের পৃথিবী এক ট্রামের তলা থেকে ঘষটাতে ঘষটাতে

অন্য এক ট্রামের তলায় পিষ্ট হতে আসে।

জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ হয়ে খেলতে নেমেছি

সবার সব প্রশ্নের উত্তরে নীরবতা লিখি।

যে আমাকে দিনরাত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আমি তাকেই

বাহবা দিই, হাত তুলে অভিবাদন জানাই আর

না-হওয়া কবিতাগুলোর ভেতর থেকে গোপন আস্কারা

                                            টের পেতে থাকি।




ঘুড়ি


বস্তুত একটি সবুজ রঙের ঘুড়ি উড়তে থাকে

তার ছায়া লাট খেতে খেতে এসে পড়ে

শিবমন্দিরের চাতালে

আমি কখনই কিংবদন্তির গল্পে বিশ্বাস করিনি

যেভাবে ঘুড়িটা তার ছায়ার স্বতন্ত্র অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না


মানুষে মানুষে দূরত্ব এক ইঞ্চিও নয়

অথচ কী অগম্য এই ব্যবধান!




ছুরি


ফাঁকা এক ডাকবাক্সের ফিসফিস শুনতে শুনতে

হেঁটে চলেছি রাত্রিবেলা। স্বপ্নে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছি বারবার

যখন একটা বিশাল মাথাওলা চাঁদ

এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় সরে গেছে

মুখ আর মুখোশগুলোকে বিদায় জানিয়ে

ভুল রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেছি যজ্ঞের আঙিনায়

কোনো দূরাগত দিব্য উপদেশ আমাকে ছুঁতে পারেনি

মাথার মধ্যে একরাশ চিঠি এলোমেলো পাক খেয়েছে শুধু

অস্বাভাবিকতা আমাকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছিল।




মুখোশ


সেসব মানুষ উড়ে বেড়ায় তাদের বুকপকেটে গোলাপ থাকে

দিনরাত একটা হলদে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকি

সঙ্গী নির্বাচনে ভুল হয়ে যায়।

আমার হাসি আমি উড়িয়ে দিয়েছি চৌরাস্তায়

দিনরাত ঢলোঢলো মুখ নিয়ে অভিনয় করে গেছি:

তুমি কি টালা পার্ক থেকে এক্ষুণি বেরিয়ে আসছো ?


এখন হাওয়াতেও বিষ। ভালবাসাতেও।

আমি কি কোনোদিন এই মুখোশ ছেড়ে বেরোতে পারব না!




মাপ


আমরা সবাই রেস্টুরেন্টে দু'চারটে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে বসি

অপেক্ষা করি কখন শূন্যতা এসে গ্রাস করবে

সেইসব অশ্রুমোচনের কথা তোমাকে বলবো না

মেঘে মেঘে ভেসে যায় ভেলা আর আমরা সবাই

স্নো-পাউডার মেখে বিকেলের হাওয়া খেতে বেরোই।

তোমাকে দেওয়া সব কথা রাখতে পারিনি

নক্ষত্র কবেই ঝরে গেছে

আলোকবর্ষ দূর থেকে টেরও পাইনি। তবু বেঁচে আছি


যতদূর চোখ যায় টুকে রাখছি

অতিদূর অন্ধকার ভেদ করে বয়ে আসে হাওয়া।

রাস্তাগুলো ফাঁকা হয়ে এলে

মাথার মধ্যে জ্বলে ওঠে একটা দপদপে আলো

আর আমি লেপের তলায় তোমাকে খুঁজে চলি।

আপাতত ঘষা কাঁচ দিয়ে পৃথিবী দেখি দিব্যি মানিয়ে নিচ্ছে

সবাই ঢুকে পড়ছে যে যার খোলের ভিতরে

যদিও একটা মাপও কারো জুতসই নয়।




হাত


এবছর যত চেনাজানা আছে সব শেষ হবে।

আমরা আবার আদিম হাতের স্পর্শে

                                                     জেগে উঠব।

শরীর জুড়ে উৎসব---

তোমাদের সঙ্গে এখনও দেখা হলো না

এ বছর শীত নামবে খুব তাড়াতাড়ি।




গোধূলি


তারপর ফিরে পাওয়া না-পাওয়ার মধ্যবর্তী সময়টুকু

গড়িয়ে যায় গোধূলির দিকে

লোহার রেলিং থেকে উড়ে যায় একটি দাঁড়কাক

তার ছায়া ঘিরে নীরবতা এসে বসে।


আমরা মুখ বাড়াই উটের গ্রীবায়

যে যার আস্তিনে গোটানো তাস

কে কখন করে দেবে কোন চালে কিস্তিমাত

কেউ আগাম জানে না


এভাবেই আমাদের ঘাসের অন্ধকার গাঢ় হলে

মুছে যায় কাদাজল হিম ঘূর্ণি

আমাদের পরবর্তী গোধূলিরা অপেক্ষায় থাকে

একটি অস্তগামী দীর্ঘ বিকেলের।




পায়রা


চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য শবের মধ্যে

মুখগুলি আলাদা নয়। পাখিরা সব জানে

তেপান্তরের পার থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসা

                                                           রাজপুত্র, সেও


আমাদের মধ্যে এখন শুধুই অবসরকালীন সন্দেহ

অথচ সভ্যতা সেই কবে থেকেই পশ্চাদবর্তী।

নিরবচ্ছিন্ন ছায়ার আড়ালে কোনো সুখ নেই

তবু একটি দুটি পায়রা ঢুকে পড়ে অলিন্দে

            রক্তের ভিতরে টের পাই তাদের ঝটপটানি।




নির্বাসন ভেঙে


একজন্ম ছুটে চলেছি চাঁদের উপর দিয়ে

এই গিরিকন্দর কদম্বমূল নির্জনে দাঁড়ায়

হয়তো দু'একটা কথা বলে হাওয়ার ভেতর

অশরীরী শোঁ শোঁ গলিতে প্রহরারত আদিম কুকুর


তোমারই ছায়ার পাশে গুটিসুটি বসি

দু'একটা শিখা দেখলেই ছুটে যাইনি চন্দ্রাহতের মতন

একজন্ম হেঁটেও হারাতে পারিনি কিছুই

তাই বুকের ভেতর বয়ে বেড়াচ্ছি আস্ত একটা ঘর


এভাবেই বারবার ফিরে আসি দিকচিহ্নহীন

নির্বাসন ভেঙে; ধূ ধূ হেমন্তের দিকে পিঠ করে দাঁড়াই।




মায়ানগরী


আমি আগামীর সমস্ত কথা ভুলে যাব

ভুলে যাব নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোর কথা

কড়িকাঠের দিকে চেয়ে থাকা

              আত্মহত্যাপ্রবণ এক একটি বিকেলের কথা


হয়তো কোনোদিন সোনালী ব্যাঙের মতো লাফিয়ে উঠব

কোণা এক্সপ্রেসওয়েগামী বাসে

আমাদের আরো একটু কাছে সরে আসবে পৃথিবী

আর বিপিনবাবু রোজই হেলতে দুলতে অফিস যাবে


"তোমরা এইদিকে সরে এসো

অ্যাম্বুলেন্সটাকে যাবার রাস্তা করে দাও---"

       বলেছিল মাইক হাতে সুদর্শন যুবা


অথচ আমাদের স্বপ্নে একটাও ডাকটিকিট ঝরে পড়েনি।





কবি পরিচিতি ~ 


কবি ইন্দ্রাণী পাল পেশায় শিক্ষিকা। 

ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। 

বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত। 

প্রকাশিত বই নেই।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...