রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০২৩

পঞ্চম পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে"

সজ্জ্বল দত্ত  





৫ . 

নান্দনিকতা

" If anything is beautiful besides absolute beauty , it is beautiful for no other reason than because it partakes of absolute beauty " -- প্লেটোর এই উক্তিকে যদি মেনে নিই তবে অবশ্যই লেখা যেতে পারে শিল্পে এই সৌন্দর্যসৃষ্টি পরম সৌন্দর্যেরই অংশমাত্র । কিন্তু ' সৌন্দর্য ' কথাটাই যে কত গোলমেলে তা বোঝা যাবে একটু বিস্তৃত আলোচনা করলেই । মোটামুটিভাবে ' সৌষম্য ' , ' কারণ ' এবং ' ফল ' অর্থাৎ relation , cause এবং effect এই নিয়ে হচ্ছে ' সৌন্দর্য ' । সৌন্দর্যতত্ত্বের ওপর চারটে প্রধান গ্রহণযোগ্য মত আছে । প্রথম মতটি প্লেটোর ( যেটি ওপরে বলা হয়েছে ) , দ্বিতীয় মতটি হচ্ছে " সৌন্দর্য হল রূপ-সুষমা , এক বিশেষ ধরনের কল্পনা । তৃতীয় মত - সৌন্দর্য তাইই , যা রসাস্বাদনের কারণ , আর চতুর্থ মতে সৌন্দর্য হচ্ছে প্রতিভার সৃষ্টি । এছাড়াও আরো অসংখ্য আপাতগুরুত্বহীন মত এই তত্ত্বকে ঘিরে পাক খাচ্ছে , কিন্তু সে বিষয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন । আমাদের আলোচ্য বিষয় হল দেবদাস আচার্যর কবিতার সৌন্দর্য , তার নান্দনিকতা । 
   সৌন্দর্যের আসল সাফল্য আনন্দমূল্যে আর কবিতায় তা আসতে পারে বিষয়ে , প্রকাশে , আসতে পারে শব্দচয়নে, যতিচিহ্ন ব্যবহারে , এমনকি আধুনিকতম কবি ও আলোচকরা দাবী করছেন কবিতায় পড়ে থাকা ফাঁকা স্পেসও নাকি নান্দনিকতার অন্তর্ভুক্ত । দেবদাস আচার্যর কবিতা যেহেতু প্রধানতঃ ন্যারেটিভ তাই গঠনগত প্রকরণগত সৌন্দর্যের চেয়েও বিষয়গত ও ভাবগত সৌন্দর্যের ব্যাপারটাই অধিক আলোচ্য । যেমন " মানুষের মূর্তি "র কবিতাগুলোর সৌন্দর্য আলোচনা করতে হলে তা করতে হবে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের ধারণা থেকে । সোমনাথ হোড়ের ভাস্কর্য আর দেবদাস আচার্যর " মানুষের মূর্তি " একজাতীয় শিল্পমাধ্যম না হলেও সৌন্দর্যতত্ত্বের দৃষ্টিতে একই জাতের । 

" ছুতোরকাকা র‍্যাঁদা আর তুরপুন হাতে 
              বেরিয়ে পড়েন কাজে 
 করমালি চাচার হাতে ওলন-দড়ি 
 মাধবজেঠু দুটো বলদ আর বিদে নিয়েছেন সঙ্গে 
 আমার বাবাও সাইকেলে চাপেন 
 তার কেরিয়ারে থাকে রুটি আর আলুচ্চড়ি 
        আর কাপড় গামছার বোঁচকা "    ( অনুভব )

কোনরকম ন্যারেটিভ ও লিরিকের মিশ্রণ নয় , পরিস্কার ন্যারেটিভ । রক্তমাংসের মানুষের নয় , হাড়ের মানুষের ছবি । কিন্তু " মানুষের মূর্তি "র এই হাড়ের রাজত্বেও সুন্দর শব্দচয়নে কবিতার সৌন্দর্য কী চমৎকার ধরা পড়ে ! 

 "আমার ছোট্ট আর মিষ্টি মা রুটি ভাজেন 
 এবং তাকিয়ে থাকেন বাবার সেলাইকলের দিকে" 
                                                        ( খিদে ) 

এই যে " ছোট্ট আর মিষ্টি মা " এই হচ্ছে শব্দচয়নে সৌন্দর্য । বিরাট কোনো বিষয়ের প্রবাহে গা ভাসালেন না অথচ দুটি শব্দে দুরূহ নান্দনিকতা উঠে এল কবিতায় । 
         " মৃৎশকট " এর কবিতাগুলোয় বিষয়বস্তুকে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যাখ্যা করাই উদ্দেশ্য, ফলে এই কাব্যগ্রন্থের সম্পূর্ণ সৌন্দর্যই প্রকাশমহিমায় । আজ পর্যন্ত মহৎ প্রকাশ বলে যে সমস্ত কবিতা স্বীকৃত হয়েছে তাতে বিষয়ের মহত্ত্বকে প্রকাশ করেই " প্রকাশ " আপন মহিমা লাভ করেছে । " মৃৎশকট "এ এই প্রকাশসৌন্দর্যকে ব্যক্ত করার জন্য রয়েছে অজস্র রূপক , নতুন নতুন শব্দ , একেবারে কাঠখোট্টা গদ্যের স্টাইল আর একেকটি শ্লোকের জন্য অত্যন্ত সীমিত শব্দের ব্যবহার । 

   " একটা সাপ আমি যেতে দেখেছি আমার 
              শরীরের মধ্যে অন্ধকারে 
    তার নীল বিষ গলাধ:রণ করে এই শহরতলীর
              নিম্নবিত্ত বোধের মধ্যে চলাফেরা করি। " 
                                           ( ৬ নং শ্লোক ) 

এইভাবে রূপকের মধ্যে দিয়ে কবিতাটির শুরু তারপর ধীরে ধীরে মিশে গ্যাছে সময়ে এবং অবশেষে সময়উত্তীর্ণতায় আর একইসঙ্গে পাঠক ধীরে ধীরে ডুবে গেছেন ভাবসৌন্দর্যের আনন্দসমুদ্রে । আবার আলংকারিক প্রয়োগের সৌন্দর্যরূপ - " তার মেয়ের দেহের মতো ফসল গড়ে ওঠে মাঠে " । অসাধারণ উপমা ! ফসলের প্রতি কৃষকের যত্ন কবির কলমে কাব্যনান্দনিকতা প্রকাশে কতটা মমত্ব থাকলে এভাবে লেখা যেতে পারে ? 

কবিতায় নান্দনিকতার প্রথম কথা হচ্ছে তাকে দেহে মনে পরিস্কার কবিতা হতে হবে । কবিতা কী ? এ প্রশ্নের কোন প্রামাণ্য উত্তর যেমন এখনও তৈরি হয়নি , তেমনি সিরিয়াস পাঠকের কাছে কোনটা কবিতা আর কোনটা নয় তার একটা ধারণা কিন্তু তৈরি হয়েই আছে , কারণ কাব্যশিল্পের নৈপুণ্য ও প্রকাশদক্ষতা উপলব্ধি করার জন্য পাঠক সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকেন , ইংরেজিতে বললে একটা aesthetic attitude নিয়েই থাকেন । তাই দেবদাস যখন লেখেন - " এক স্থায়ী কাচের শরীরের মধ্যে আমার আত্মা স্থির হয়ে আছে " ( ' অস্তিত্ব ' : ঠুঁটো জগন্নাথ ) , তখন পাঠকের চৈতন্য সাড়া দেয় আর সঙ্গে সঙ্গে কবিতাশিল্প উত্তোরিত হতে থাকে আপন সৌন্দর্যসীমায় । 

      " For all good poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings " - বলছেন কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার ' poetry and poetic diction ' প্রবন্ধে । আর এই প্রবন্ধেই " কবি " সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন " while he describes and imitates passion ... " । ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই দুটি কথাই ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা খেটে যায় দেবদাস আচার্যর কবিতা এবং কবি দেবদাস সম্পর্কে যদি পাঠক ' উৎসবীজ ' কাব্যগ্রন্থটি হাতে নেন এবং তার নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে মাথা ঘামান । নান্দনিকতা কিভাবে অনন্তর ধারণা থেকে ধীরে ধীরে মাটির পৃথিবীর সৌন্দর্যে নেমে আসতে পারে তার আদর্শ উদাহরণ " উৎসবীজ " । ... " আমারই চোখের মায়া নিয়ে তুমি খেলা করো , হে পৃথিবী / আরো কিছুকাল " - এইভাবে শেষ হচ্ছে উৎসবীজ । 

 আলোচনা এগোক । " উৎসবীজ " ছাড়াও " আচার্যর ভদ্রাসন " যে দেবদাসের কবিতার আর একটি অন্যতম প্রধান বাঁক , এ বিষয়ে আশাকরি যেকোনো দেবদাস-পাঠক নিঃসন্দেহ । " আচার্যর ভদ্রাসন " এর নান্দনিকতা বলতে বিষয়বস্তুর এক অন্যধরনের গাম্ভীর্য এবং সেইসঙ্গে কুশলী বর্ণময় এক রহস্যে ঘেরা মনোজাগতিক এফেক্ট তৈরি করা । ঘটনা , ক্রিয়া , চরিত্র , ভাবনা এই সবকিছু মিলিয়ে অন্যধরনের উপস্থাপনা যা অবশ্যই পাঠকমনের চূড়ান্ত নান্দনিক উদ্ভাস ঘটায় । 

  আরো এগোই । " সুভাষিতম " এ কল্পনা করা হয়েছে আত্মার নিগূঢ় কামনাবাসনার বৃত্তটি , তার বাহ্যসত্ত্বা , জৈবিক সত্ত্বা , মানুষরূপ ধারণ করে তার চলার পথ । 

" আত্ম-রিপুকে লেহন করার নাম জীবন 
  এই সহজ পথ 
  শ্রেষ্ঠ পথ "          ( সুভাষিতম ) 

সুখ-দুঃখ-ভয়-নির্ভয়-হাসি-কান্নাজনিত বাহ্যসত্ত্বা উদ্বেলিত গোটা সুভাষিতম জুড়ে, আর সাথে কাব্যনান্দনিকতা তার শ্রেষ্ঠতম সাফল্যে উত্তীর্ণ অন্তরজাগরণের আনন্দে। কবি দেবদাস নিজে কোন দার্শনিক মতবাদের প্রবক্তা না হলেও দর্শনের তুরীয়লোকে পৌঁছে গ্যাছেন এই কাব্যগ্রন্থে। জগতে ও জীবনে দ্বন্দ্ব আছে সত্য , কিন্তু আসল সত্য রয়েছে দ্বন্দ্বের সমাধানে। "সুভাষিতম"এ কোটি কোটি বছরের চলার পথ এবং তার বিভিন্ন দ্বন্দ্ব, আবার আপনা থেকেই তার সমাধান। ফলতঃ পাঠকের চৈতন্য আবার সাম্য ফিরে পায়। আত্মার সাম্যবোধ, নৈতিকবোধ চরিতার্থ করে এই কাব্যগ্রন্থ পাঠককে বিষয়ে, দার্শনিক উপলব্ধিতে চরম কাব্যনান্দনিক আনন্দদান করে ,সঙ্গে কবি নিজেও যেন এক পরম সত্যের কাছাকাছি চলে যান । 


 একের পর এক কাব্যগ্রন্থে কবির কাব্যিক নান্দনিকতার মাধ্যমে পাঠককে আনন্দদানের ক্ষমতার যেন ক্রমোন্নয়ন ঘটেছে । কথা হচ্ছে , লিরিককে বাদ দিয়ে রোম্যান্সকে বাদ দিয়েও কবি দেবদাস কিভাবে তার কবিতায় এই অপার সৌন্দর্যসৃষ্টি করতে পেরেছেন ? ... পেরেছেন , তার প্রধান কারণ - লিরিকের অভাব থাকলেও দেবদাসের কবিতা মোটেই ইস্তাহারধর্মী পদ্য নয় । তার কবিতায় শিল্পসিদ্ধি ঘটে কারণ পাঠকের কবিতা পড়ে জোরালো একটা প্রতিক্রিয়া হয় । সে প্রতিক্রিয়া ফুলের মত না হতে পারে , ফাগুনের দখিনা বাতাসের মত আবেশজড়ান না হতে পারে , কিন্তু বিষয়ে প্রকাশে এবং সর্বোপরি সারবত্তায় তা পাঠককে কোন এক অজানা মহাসমুদ্রের গভীরে ভাসিয়ে নিয়ে চলে । এই ভেসে যাওয়ার আনন্দই দেবদাস-কবিতার নান্দনিকতার প্রাণ । ... পাঠক কেন ভেসে যায় ? কারণ একদিকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা , অন্যদিকে জীবনের প্রবহমানতার বহু বহু বছরের বিবর্তন এবং সেই প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন, এই দুইই একসঙ্গে শিল্প হয়ে উঠে আসে পাঠকের অন্তরে । কিভাবে ? ... একটা উদাহরণ - 

             " আমার ঠোঁটের সামনে পায়েসের বাটি 
             আর আমি 
             শত চেষ্টাতেও ঠোঁট খুলতে পারলাম না । 
             #                 #                # 
              জিভে জল 
              আত্মবিহ্বল 
               #               #                  # 
               জীবন আমার কাটল এভাবেই " 
                         ( " স্পৃহা " : বিন্দু নয় রেখা নয় ) 

এই কবিতা অনায়াসে বুঝিয়ে দেয়, কেন লিরিককে বাদ দিলেও পাঠকের কাছে দেবদাস-কবিতায় নান্দনিকতার কোন অভাব কোন সময়েই পরিলক্ষিত হয় না । এই আলোচনার গোড়ার দিকে উল্লেখ করা সৌন্দর্য সংক্রান্ত প্রধান চারটে মতের মধ্যে দেবদাসের ক্ষেত্রে বোধহয় চতুর্থটিই সঠিক প্রযোজ্য - " সৌন্দর্য হচ্ছে প্রতিভার সৃষ্টি " । 

                                ( চলবে ) 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...