সোমবার, ৫ জুলাই, ২০২১

দেবদাস আচার্যের সাক্ষাৎকার

 মুখোমুখি দেবদাস আচার্য

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজদীপ ভট্টাচার্য   

  




রাজদীপ ~ নমস্কার দেবদাস বাবু। প্রথমেই বারাকপুর স্টেশন পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমরা যারপরনাই আপ্লুত।

দেবদাস ~ বেশ বেশ, ঠিক আছে, বলো।

রাজদীপ ~ একটি বিষয়ে ধোঁয়াশা প্রথমেই কাটানো প্রয়োজন, আপনার জন্মসাল বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম দেখতে পাই। যদি আপনি এ বিষয়ে আলোকপাত করেন।

দেবদাস ~ আসলে সরকারি নথিতে আমার জন্ম ১৯৪২ সালে ৩ জুলাই। সেসময়ে বাবা স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে কিছুটা আন্দাজে এরকম লিখেছিলেন। কিন্তু মায়ের কাছে আমি শুনেছি আমার জন্ম ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে। মানে শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে।

রাজদীপ ~ তাহলে দেশভাগের সময় আপনার বয়স ছয় পেরিয়েছে। পূর্ববঙ্গের স্মৃতি কিছু মনে পড়ে এখনো?

দেবদাস ~ তা অনেকটাই মনে আছে। আমি এক আত্মজৈবনিক গদ্য 'দেবদাসের জীবনপ্রভাত'এ লিখেছি অনেকদিন আগে। ১৯৮০-৮১ সালে পরমা'তে তা প্রকাশ পেয়েছে। 'অবভাস' তাকে বই করে ছেপেওছে। আমাদের বাড়ি ছিল কুষ্টিয়া জেলার আলমডাঙ্গা স্টেশনের কাছে বন্ডবিল গ্রামে। গ্রামটি স্টেশন থেকে দুই-তিন কিঃমিঃ দূরে। বাবার সাথে হেঁটে স্টেশনে যেতাম বেশ মনে আছে। বাড়ির উঠোন থেকে পেয়ারা গাছে চড়ে দূরে রেলগাড়ি যাওয়া দেখতাম।



রাজদীপ ~ কবি দেবদাস আচার্যকে নয় একজন বরিষ্ঠ মানুষ হিসেবে আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই, কারণ এই প্রশ্ন করার সুযোগ খুব কমে এসেছে। স্বাধীনতা যেদিন এলো সেই দিনটির কথা আপনার কিছু মনে পড়ে?

দেবদাস ~ তা বেশ মনে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭। সেই তেরোই আগস্ট রাত বারোটায় গ্রামের স্কুলে পতাকা তোলা হয়েছিল। পরদিন ভোরবেলা স্বাধীনতা উৎসবে আমার ঠাকুরদাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমিও সেই সাথে গিয়েছিলাম। মনে আছে ওখানে কয়েক বস্তা সাদা বাতাসা রাখা ছিল। অনুষ্ঠান শেষে আমাকেও একমুঠো বাতাসা দেওয়া হয়েছিল। মানুষজনের মনে তখন খুব উল্লাস। অথচ পরবর্তিকালে আর কোনোদিন সেখানে ফিরে যেতে পারিনি। এত কাছে তবু যাওয়া হয়নি।

রাজদীপ ~ দেশভাগের পরে দর্শনা হয়ে সবাই রানাঘাটে চলে আসলেন, তাইতো?

দেবদাস ~ হ্যাঁ, ট্রেনে রানাঘাটে আসার পরে বাড়ির মেয়েরা পাশের ছোট হোটেলের ঘরে রইল। আমরা দেড়দিন মত রানাঘাট প্ল্যাটফর্মেই পড়েছিলাম। সেখান থেকে বীরনগর। অবশেষে বছর দেড়েক পরে কৃষ্ণনগরের কাছে রাধানগরে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা হল। সেই থেকে আমি এখানেই আছি।

রাজদীপ ~ পড়াশোনা শুরু হলো কৃষ্ণনগর এ. ভি. স্কুলে?

দেবদাস ~ ঠিক বলেছ। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ঠিকই, কিন্তু কয়েক মাস ক্লাস করে আর এগোতে পারলাম না। কারণ কৃষি দপ্তরে চাকরি পেয়ে গেলাম ইতিমধ্যে।

রাজদীপ ~ আপনার সাহিত্যজীবনে আসি এবার। যতদূর জানি আপনি গদ্য দিয়ে জীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে কবিতায় আসা।

দেবদাস ~ হ্যাঁ, তা বলা যায়। তবে প্রথম দিকে স্কুলে কবিতা, গদ্য সবই লিখেছি। কলেজে যখন পড়ি আমার গল্প স্থানীয় লিডিং পত্রিকাগুলিতে ছাপা হতো। তবে সাথে সাথে কবিতাও লিখেছি। দুটোই পাশাপাশি চলছিল। পরে এসে জুটল নাটক, ১৯৬৫ সাল নাগাদ।

রাজদীপ ~ প্রাথমিকভাবে প্রত্যেকের একটা নাড়া বাঁধা হয়। আপনার ক্ষেত্রে বৃন্দাবন গোস্বামীর আড্ডাই কি সেই আশ্রয় ছিল?

দেবদাস ~ হ্যাঁ, তবে তারও আগে সুশান্ত হালদারের একটি ছাপাখানা ছিল 'মুদ্রণী' নামে। আমি যখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন 'হোমশিখা' নামে একটি পত্রিকায় আমার গল্প ছাপা হয়েছিল। একদিন সামনে দিয়ে যাচ্ছি সুশান্তবাবু ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন যে অমুক গল্পটি আমার লেখা কিনা। বললাম। শুনে খুব প্রশংসা করলেন। আমাকে ওনার ওখানে যেতে বললেন। ওনার কাছেও আলোচনা হতো। যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন একটা উপন্যাস লিখে ফেলেছিলাম। একটা প্রকাশনী সংস্থা ছাপতে চেয়েছিল কিছু টাকার বিনিময়ে। তাই আর হয়নি। এর পরেও আমি দুটি উপন্যাস লিখেছিলাম। ছাপাও হয়েছিল। একটার নাম মনে আছে 'পাখিরা পিঞ্জরে'। তবে এই দুটি উপন্যাসের আর কোনো অস্তিত্ব আমার কাছে নেই। তাছাড়া অনেক গল্প লিখেছি বিভিন্ন পত্রিকাতে। সে সব হারিয়ে গেছে। তবে সম্প্রতি 'মতিগতি' বলে একটি গদ্যের বই প্রকাশ পেয়েছে। সেটা খানিকটা গল্পগাছা টাইপের। ১৯৬৫ সাল নাগাদ বৃন্দাবন গোস্বামীর 'সেতু' সংস্থার জন্য একটি নাটক লিখি। সেটা অভিনয় হল। এরপর আইপিটিএ এর স্থানীয় সংস্থার জন্য নাটক লেখা শুরু করলাম। ১৯৬৭ থেকে ৭২ পর্যন্ত টানা ওদের জন্য 'হাতুড়ি',  'চাকা', 'মহাভারতের কথা' প্রভৃতি অনেক নাটক লিখেছি। তার মধ্যে ১৯৭১ সালে কৃষ্ণনগর রবীন্দ্র ভবনের আমার লেখা 'মেঘ মেঘ' নামে একটি নাটক করি। সেটা ছিল শ্রুতিনাটক। তখন সুধীর চক্রবর্তী তাঁর নাম দিয়েছিলেন স্বরাভিনয়। এমন শ্রুতিনাটকও তখন অনেক লিখেছি। তবে সে সব হারিয়ে গেছে। আমি কিছুই রক্ষা করতে পারি না। আমার তখন একসাথে সব চলছে গল্প-কবিতা-নাটক। কোনটা আঁকড়ে ধরব তার ঠিক নেই।



রাজদীপ ~ এবার বলুন অরুণ বসুর ভূমিকা আপনার জীবনে।

দেবদাস ~ অরুণ বসু 'অজ্ঞাতবাস' নামে পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সেবার এসেছিলেন কৃষ্ণনগরে একটি কবিতার আসরে। সেই অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ার জন্য আমিও নাম দিয়েছিলাম। যাই হোক উদোক্তারা আমাকে পড়ার কোন সুযোগ না দিয়েই মাইক গুছিয়ে ফেললো। আমি প্রতিবাদ করলাম। কিন্তু তারা আমাকে কবি বলে মানতেই রাজি নয়। (দীর্ঘ হাসি) তা এসব দেখে অরুণ বাবু আমাকে বললেন যে "আপনি কি কবিতা পড়তে চান?" আমি বললাম "হ্যাঁ, সে তো চেয়েছিলাম। কিন্তু পড়তে দিচ্ছে কোথায়!" উনি বললেন "আপনি পড়ুন, আমি শুনবো"।

     সেই সময় কবিতা অত গুছিয়ে রাখতাম না। যাহোক ভাঁজ করা কাগজে গোটা চারেক কবিতা ছিল। বার করে পড়লাম। অরুণ বাবু বললেন "যাক, আজকে তাহলে আপনার কবিতা শুনতেই এসেছিলাম"। উনি চারটে কবিতাই নিয়ে নিলেন। ওনার পত্রিকায় ছাপলেন। এরফলে আমার একটা কবি পরিচিতি তৈরি হলো। এভাবে লিটল ম্যাগাজিন আমায় কবি বানিয়ে দিলো। অন্যান্য সম্পাদকও কবিতা চাইতে শুরু করলেন। এজন্য অরুন বসুর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। উনিই স্থির করে দিলেন আমার পথ।

রাজদীপ ~ আপনার কবিতায় বিস্তারিত প্রবেশের আগে আরেকটা বিষয় জানতে চাই। আপনি চোখের সামনে খাদ্য আন্দোলন, নকশাল আন্দোলন দেখেছেন। এইসব ঘটনা আপনার লেখায় কি প্রভাব ফেলল?

দেবদাস ~ হ্যাঁ, প্রভাবতো পড়েইছে। 'কালক্রম ও প্রতিধ্বনি' নামের মধ্যেই সেই ছায়া আছে। কাল বা সময়ের প্রতিধ্বনি। তখন যুগটা ছিল প্রতিবাদ-প্রতিরোধের। যুগের সেই প্রতিবাদী চরিত্র আমার প্রথম বইতে গভীর প্রভাব রেখেছে। বুঝতে পারছ, তখন হাংরি জেনারেশনের প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অরুণ বসুর অজ্ঞাতবাসেই সুনীল গাঙ্গুলী একটি গদ্য লিখেছিলেন। তাতে মোদ্দাকথা তিনি বলেছিলেন যে বাংলা কবিতা তিনশ সাড়ে তিনশো শব্দে আটকে গেছে। নতুন শব্দ নতুন ভাষা তৈরি হচ্ছে না। আমি আমার কবিতায় সেই শব্দ আনতে চাইলাম। 'কালক্রম ও প্রতিধ্বনি'র 'সে নিড়িনি চালায় শস্যে' বা 'আমার জলের পোকা' এই কবিতাগুলি দেখবে। তাদের ভাষা, বিষয় ভাবনা - এসব বাংলা কবিতায় নতুন।
"এক শানকি পান্তা আনে মেয়ে তার গামছা দিয়ে বেঁধে / ঠিলেয় করে জল, সরায় করে কাছিমের ডিম / সে মধু ভাঙে গাছ থেকে, মধু দিয়ে পান্তা ভাত খায় / সে পান্তা খায় আর হুলুই দেয় গরু-বাছুর দেখে / তার মেয়ের নাকছাবির মতো ফসল রমরম করে। "

রাজদীপ ~ আপনার লেখা ধারাবাহিকভাবে পড়লে আমরা খেয়াল করি যে একদম প্রথম দিকে 'কালক্রম ও প্রতিধ্বনি' নির্ভেজাল মানুষের কথা বলে। 'মৃৎশকট'এ সেই ক্যানভাস বড় হয়ে যায়। এই পৃথিবী, নক্ষত্রলোক কবিতায় ঢুকে পড়তে থাকে। আবার 'মানুষের মূর্তি'তে ফিরে আসে চারপাশের খেটে খাওয়া মানুষেরা। আপনার বাবা-মা। পুনরায়  'আচার্যের ভদ্রাসন'এ আপনি সেই বিশ্বসংসারের ডাক শুনতে পেলেন। এরপরের কাব্যগ্রন্থ 'তর্পণ' থেকে শুরু হলো তীব্র আত্মখনন। এভাবে মাটির কাছাকাছি জীবন, মহাপৃথিবীর ডাক এবং নিজেকে খনন --এই তিনটি চেতনাস্রোত মিলেমিশে নির্মাণ হলো কবি দেবদাস আচার্যের। এ বিষয়ে আপনার কি মনে হয়?

দেবদাস ~ একদম ঠিক। আসলে 'আচার্যর ভদ্রাসন' এর আগে পর্যন্ত আমি সহজে রিয়াক্ট করতাম। যা দেখতাম তাই লিখতাম। একটি বইয়ের ব্লার্বে লিখেছিলাম "জীবন আমাকে যা দিয়ে থাকে আমি  তাই কেবল জীবনকে ফিরিয়ে দিতে পারি। এর বেশি শিল্প আমি পারি না, এর বেশি অঙ্গীকার আমি করিনি"। তখন আমি খুব অবজেক্টিভ। আমার তখনকার লেখায় দেখা যাবে, ফুলকপি হাতে কেরানি আসছে। মানে আমার কবিতা তখন উঠে আসছে প্রত্যক্ষ জীবন থেকে নেওয়া বোধ হতে। হতদরিদ্র-দরিদ্র-সংগ্রামী জীবনের কথা বাংলা কবিতায় ছিল না। "আমি যত কবি কামারের, মুটে-মজুরের"- এই বলে কবি চলে গেছেন। স্পর্শ করতে পারেননি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় কিছু ছোঁয়া আছে। কিন্তু এই প্রান্তিক জীবনকে বাংলা কাব্যে প্রতিষ্ঠার কাজ ইতিপূর্বে হয়নি। আমি বাস্তব জীবন থেকে উঠে আসা নির্যাস আমার কবিতায় ধরার চেষ্টা করেছি।



      এই বাস্তব জীবনের বাইরে ছিল আমার ধ্যানের জীবন। এই সময়ে খড়ে নদীর ধারে একটা বাড়ি করে আমি চলে আসি। মূল শহরের বাইরে এই নির্জনে চলে আসার পরে আমার মনে হলো সেই চর্যাপদের সাধকদের কথা। যারা নগরের বাইরে নির্জনে সাধনরত থাকতেন। আমারও মনে হলো, আমাকে ঘিরে রয়েছে হাজার বছরের আবহমান বাংলা। যার কোন পরিবর্তন হয়নি। একটা জনজাতি, যারা শুয়োর পোষে। একটা শ্মশান রয়েছে। সেখানে কাপালিক আছেন। বড় আকাশ। বিশাল চাঁদ। অনেক আলো। গাঢ় অন্ধকার। শহরের ভিড়ে এমন দেখা যায় না। কিন্তু এই উপান্তে বসে সবই যেন বড় মনে হত, অখন্ড মনে হত। ফলে আমার মধ্যে অদ্ভুত অনুভূতি হল। আমি নিজের ভিতরে সেই চর্যাপদের ধ্বনি খুঁজে পেলাম। তারই প্রকাশ ঘটল 'আচার্যের ভদ্রাসন'এ। এ একপ্রকার জীবন সাধনা, যার স্বাদ অন্যরকম।

রাজদীপ ~ এরপর আপনার বাবার মৃত্যু আপনার কবিতায় ছায়া ফেলল --

দেবদাস ~ আমার বাবা চলে গেলে ১৯৯২ সালে। এর ফলে ধীরে ধীরে আমার অন্তর্গত মন আরও বিকশিত হল। 'আচার্যের ভদ্রাসন' থেকেই হচ্ছে, তবে এ সময়ে অন্তর্দর্শন আরো প্রকট হল। তার ফলেই এল 'তর্পণ'।

রাজদীপ ~ প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যের প্রতি তাগিদ কীভাবে এবং কেন উপলব্ধি করলেন?

দেবদাস ~ আমি ষাটের দশক থেকে কবিতাযাত্রা শুরু করেছিলাম। সেই সময়ে লেখকদের মধ্যে একটা দ্রোহ ছিল। বিভিন্ন সামাজিক, রাষ্ট্রিক দমন চলছে চারপাশে। একটা ভাঙ্গনের দশক। তাই এসব থেকেই আমাদের মনে একটা চেতনা গড়ে উঠেছিল যে, যা কিছু প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা আছে তা কবিতা-গল্প-নাটক-থিয়েটার -- যাইহোক এসবকিছুকে ভেঙে একটা নতুন জায়গায় যেতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান বলতে একটা সংস্থা। তারা ব্যবসা করে, তাই সাহিত্যকে তারা ব্যবসার নিরিখে দেখবে। যা চলবে বাজারে তাকে রাখবে, বাকি ফেলে দেবে। আমার তাই মনে হত যে পণ্যসাহিত্য আমি নেব না। সাহিত্যের একটা স্বাধীন বিকাশের ক্ষেত্র থাকবে। কাউকে খুশি করার জন্য সাহিত্য হবে না। তাই কলেজ জীবন থেকেই আমার মনে এই প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানসিকতা গড়ে ওঠে। তাই যা প্রতিষ্ঠিত সত্য, তা সত্য নয়; তার চেয়েও বড় সত্য আছে-- এটাই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। সে অর্থে রবীন্দ্রনাথও প্রতিষ্ঠানবিরোধী। সজনীকান্ত প্রমুখের প্রতিষ্ঠিত ঘরানার বাইরে তাঁর অবস্থান। মাইকেল মধুসূদন প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী। তাই তাঁর 'মেঘনাদবধ কাব্য'এর প্যারোডি বেরোলো 'ছুছুন্দরী বধকাব্য' নামে। তিনি প্রতিষ্ঠিত কাব্যধারাকে প্রবল আঘাত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন "অলীক কুনাট্য রঙ্গে, মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে"। প্রতিষ্ঠান বিরোধীরা গলা উঁচু করে বলে না যে তারা প্রতিষ্ঠানবিরোধী, কিন্তু তাদের কাজে তা প্রকাশ পায়।

      প্রকৃতির নিয়ম প্রগতি। যা আছে তাকে অতিক্রম করে যাওয়া। তাই একে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা যেমন বলা যায় তেমনি স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবেও দেখা যায়। আমি আমার লেখায় বারবার বলেছি যে সঠিক কথাটি 'প্রতিষ্ঠানবিরোধী' নয়, 'অপ্রাতিষ্ঠানিক'। কারণ  চিরকাল প্রতিষ্ঠানবিরোধী কিছু থাকে না। আর আজকের বিরোধী একদিন বর্তমান প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। তাই বিরোধী তখন প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। এজন্য 'অপ্রাতিষ্ঠানিক' বলাটাই শ্রেয়। প্রতিষ্ঠানকে অতিক্রমের মধ্য দিয়েই সাহিত্যের অগ্রগতি। আর তা পণ্যসাহিত্য করে না। একমাত্র লিটল ম্যাগাজিনই পারে অপ্রাতিষ্ঠানিক হতে।

      ১৯৮৯ সালে কৃষ্ণনগরে আয়োজিত 'শতজলঝর্ণার ধ্বনি' খুব সাফল্য পেয়েছিল। বাংলা ও বাংলার বাইরে থেকে বিপুল সমাবেশ হয়েছিল। তখন ধারণা ছিল যে লিটিল ম্যাগাজিন আসলে প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে হাতমস্ক করার জায়গা। আমরা সেই ধারণাকে মুছে দিতে চেয়েছিলাম। বলতে চেয়েছিলাম যে লিটল ম্যাগাজিনই একমাত্র সৃজনশীলতাকে রক্ষা করতে পারবে। নতুন বিকাশের ক্ষেত্র খুলে দিতে পারবে। সেটা 'প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা' বললে তাই। আর আমি তাকে বলি 'অপ্রাতিষ্ঠানিকতা' বা 'প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষতা'।

রাজদীপ ~ এবার 'ভাইরাস' সম্পর্কে শুনতে চাই। 'ভাইরাস' পত্রিকা প্রকাশ করার কথা ভাবলেন কীভাবে?

দেবদাস ~ এখন ভাইরাস শুনলেই ভয় লাগে! (মজার হাসি) সব করোনা ভাইরাস হয়ে গেছে !


রাজদীপ ~ অথচ তখন কবিতার সংক্রমণ ছড়ানোর জন্যই এই নাম দিয়েছিলেন, তাই না?

দেবদাস ~ ঠিক বলেছ, সেই সময় আমার মনে হয়েছিল যে একটা পত্রিকা করলে হয়। এমন একটা কাগজ করব যার ভারে নয় ধারে মূল্য হবে। চার পৃষ্ঠা লিফলেট এর মতো। ভাসিয়ে দেবো মহাকাশে। সে তার গন্তব্যে পৌঁছাবে। যাইহোক নাম এমন দেওয়ার কারণ ভাইরাস অতি ক্ষুদ্র, কিন্তু তার প্রভাব ব্যাপক। আমাদের কাগজও তেমনি হবে। আমাদের সেই ক্ষুদ্র কাগজ মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করবে কবিতার শক্তিতে।

     ভাইরাসের নামপত্র আমারই আঁকা।  আমিই সম্পাদনা করতাম। বন্ধু প্রিয় বিশ্বাস আমাকে কাগজের দাম দিয়ে সাহায্য করতেন। ১৯৭৫ এর ডিসেম্বরে প্রথম সংখ্যা প্রকাশ পায়। এরপর মার্চ ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়মিত ভাইরাস প্রকাশ পায়। তারপর আর্থিক কারণেই বন্ধ হয়ে যায়।

রাজদীপ ~ এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনার কবিতায় সেভাবে কোথাও যৌনতা আসেনি। অথচ সমসাময়িক অন্যান্য কবিদের কবিতায়, হাংরি লেখাপত্রে প্রবলভাবে তা প্রকাশ পেয়েছে। এটা কি আপনি ইচ্ছাকৃত করেছেন, নাকি এটাই আপনার স্বাভাবিক প্রকৃতি?

দেবদাস ~ না, ইচ্ছাকৃত নয়। আমার কবিতায় নিজের স্বভাবকেই আমি উন্মোচিত করে এসেছি। তাই এটা আমার প্রকৃতিগত। তবে দুটো কবিতার নাম এক্ষেত্রে আমি বলতেই পারি, যেমন 'টনিক' আর 'বাণিজ্য সুন্দরীর প্রতি লিরিক'। তবে সেটাও পুরোপুরি বাস্তবিক যৌনতার প্রকাশ নয়, সেখানে একটা অন্য আক্ষেপ আছে।

রাজদীপ ~ ১৯৪১ থেকে এখন ২০২০, দীর্ঘ ৭৯ বছর পেরিয়ে এসেছেন আপনি। আজ পিছন ফিরে তাকালে নিজের জীবনকে কীভাবে দেখেন? কী মনে হয়, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা! কী বলবেন একে আপনি?

দেবদাস ~ এটাই তো বলা মুশকিল। তবে জীবন খুব মোহময়। কত বিচিত্র ভঙ্গিমা তার। কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। জীবন খুব মোহাচ্ছন্ন করে বটে। কিছুতেই হারাতে ইচ্ছে করে না। এ এক ভয়ানক আশীর্বাদ যে আমি এই জীবন পেয়েছিলাম!

রাজদীপ ~ এই মহাশূন্য; এই চৈতন্যময় জগৎ আর  অচৈতন্যের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করেন কোথায়?

দেবদাস ~ আমি বলেছি আমার লেখায়, "আমি তুচ্ছ প্রাণ এক"। মহাব্রহ্মান্ডের মাঝে ভাসতে-ভাসতে আসছি। যেখানে সুযোগ পাচ্ছি বিকশিত হচ্ছি। আমি বিজ্ঞান অত জানি না, অনুভূতি দিয়ে যতটা বুঝি আমার বিস্ময়কর লাগে।

রাজদীপ ~ এখানে আপনার একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। নাম - 'না-থাকার পর থাকাটুকু'।
" উবে যাওয়া কর্পূর যেমন / গন্ধ হয়ে থাকে  / কিছুক্ষণ // ওই কিছুক্ষণটুকুই প্রকৃত কর্পূর // পৃথিবীতে হয়ত আমারও / এ প্রকার উদ্ভাসিত / অল্প কিছুক্ষণ থেকে যাবে / অপসৃত হওয়ার পরও"
       এবার উল্টোটা জানতে চাই আপনার কাছে। মৃত্যুকে কীভাবে দেখেন আপনার দৃষ্টিতে?

দেবদাস ~ এইতো! মৃত্যুচিন্তাটাই আমি করতে চাই না (ছেলেমানুষী হাসি)। দর্শনের আলোয় বরং একটু মোলায়েম করে নিই ব্যাপারটা। আমার কবিতায় বলেছি আলোর সরণি বেয়ে চলে যাব। ওই ডাইরেক্ট 'মৃত্যু' শব্দটা আমি পছন্দ করি না।
( কবিতা : আলোর সরণি
একফালি রোদ / ব্যালকনিতে নেমে এল / মনে হল একফালি আলোর সরণি / অনন্ত থেকে নেমে আসা // কেউ নামবেন ওই পথে পৃথিবীতে, ভাবি // নামলেন, ক্ষণকাল / আলোর ইশারা হয়ে // ইশারার টানে ও পথেই / আমিও একদিন / উবে যাব")




রাজদীপ ~ এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দের মৃত্যু দর্শনের তফাৎ আপনাকে কীভাবে ভাবায়?

দেবদাস ~ আসলে ভারতীয় দর্শন কে সম্পূর্ণ আত্মস্থ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে মৃত্যু মানে রূপান্তর। একরূপ থেকে অন্য রূপে যাওয়া। আত্মা অবিনশ্বর। অন্যদিকে জীবনানন্দ দাশ অন্যভাবে প্রবল সেন্সুয়াস। একজন নিবিড়, আত্মমগ্ন, নিজেকে গভীরভাবে ভালোবাসার মানুষ। নিঙড়ে পেতে চান এই পৃথিবীকে। এটা বিদেশি দর্শন থেকে আসা -- " Drinking life to the less"।

রাজদীপ ~ বেশ, এবার আপনার প্রিয় কবিদের নাম শুনি।

দেবদাস ~ সেইভাবে বলা মুশকিল। তবে বড় স্প্যানে যদি বলি তবে তিনজন আমার খুব প্রিয়। তাঁরা আন্তর্জাতিক মানের কবি ; মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশ।

রাজদীপ ~ আর সমসাময়িককালে পছন্দের ছবি?

দেবদাস ~ সমসাময়িক সবাই তো বন্ধু আমার। সেভাবে বলা কি ঠিক হবে! আমি সবাইকেই ভালবাসি, পছন্দ করি। তাদের কবিতায় আমি লালিত হয়েছি।

রাজদীপ ~ আপনি ষাট দশকের কবি। তার পরেও পাঁচটি দশক পেরিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলা কবিতা কতটা এগিয়েছে বা কোথাও আটকে গেছে কি? আপনি এ বিষয়ে কি মনে করেন?

দেবদাস ~ আমি সাদামাটা ভাষায় কথা বলি। দেখ উত্তরণ ঘন ঘন হয় না। তার জন্য সময় লাগে। তবে প্রগতি ক্রমাগত চলে, একটা অন্তর্লীন প্রবাহের মত। সেটা বজায় রয়েছে। ষাট দশকের পরে বাংলা কবিতায় বেশ কিছু বাঁক এসেছে। তাই উত্তরণ আর প্রগতির মধ্যে তফাৎ রয়েই যায়। অলীক কুনাট্য ভরা দীর্ঘ সময় পেরোনোর পরে মধুসূদন বাংলা ভাষার উত্তরণ ঘটিয়ে ছিলেন। এরপর লিরিক কবিতার ধারায় এলেন বিহারীলাল, আর তার চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটল রবীন্দ্রনাথে। তারপরে জীবনানন্দ নতুন ভাষা ও শৈলীতে আবার এক উত্তরণ ঘটালেন। এভাবেই চলে। প্রগতি চলতেই থাকে, আর সহসা দীর্ঘ সময়ান্তরে আসে উত্তরণ।

রাজদীপ ~ এই মুহূর্তে বাংলা ভাষায় কত নবীন কবি অক্ষর সাজাচ্ছেন। একজন সিনিয়র কবি হিসেবে তাদের কী বলবেন?

দেবদাস ~ আমি আর কী বলব! আমি তো তাদের লাইন আপ করে দিতে পারি না। আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই তাদের।

রাজদীপ ~ ব্যারাকপুর স্টেশন পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। এভাবেই সৃষ্টিশীল থাকুন আরো দীর্ঘ সময়। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।

দেবদাস ~ তুমিও ভালো থাকো। আমার অনেক ভালোবাসা জেনো।

★ বারাকপুর স্টেশন পত্রিকা দ্বারা সম্পূর্ণ সংরক্ষিত। এই সাক্ষাৎকারের অন্য কোনো রূপে ব্যবহার অনুমোদন সাপেক্ষ।      




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...