নিলয় নন্দী'র কবিতাগুচ্ছ
★ পিয়ানো
সেই যে শেষবার গীর্জায় পিয়ানো শুনেছিলাম, আর কাঁটার মুকুট থেকে ঝরে পড়েছিল পাখির পালক, সেই থেকে আমি পাখিদের ভাষা শিখে নিচ্ছি প্রাণপণ। হে পিতা, পালকেই লিখে রেখেছিলে উড়ানমন্ত্র। যে কুড়িয়ে নিয়েছিল পালক, তার ডানা গজিয়েছিল নাকি সে ঢুকে পড়েছিল সুদৃশ্য খাঁচায়, তার হিসেব রাখিনি। আমার দৃষ্টি ছিল পিয়ানোর দিকে। রিলেশন কর্ড, মাদার নোট আর লক্ষণরেখা। যে মেয়েটি ছবি আঁকে পায়রা বা পালক, আমি তার পাশে গিয়ে বসি। পাখিটিও ডানা মুড়ে বসে। পিয়ানো আবেশ। কুসুম, তোমার চোখের নীচে ধারালো চঞ্চু। ঠোঁট রাখি। অকারণ রক্তপাত। পিয়ানো না বিউগল ঠাহর পাইনা।
এখনো শিক্ষানবিশ। এখনো অসমাপ্ত পাখির বর্ণমালা।
★ মনে রেখো
এই আলস্য দিনলিপি মনে রেখো। এই জানালা, লেবুগাছ, ছাতারের দলবল, ভেজা পাজামা, আর লেলিহান অ্যাশট্রে পেরিয়ে লালমাটি, মনবাউলের আখড়া আর সহজিয়া শ্রীখোল, ভোলবদলের প্রস্তাব।এই ছেড়ে যাওয়া আমাকে মানায় না, তবু যাই। বাজারের ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে মাধুকরীতে বেরোই। আহা রাধে অঙ্গ, মোমের শরীর, কলঙ্কে ডুবে মরি। চাঁদ পিছলে যায়। ধরি চাঁদ, না ছুঁই চন্দ্রিমা। কানের কাছে তীব্র স্বরে কেউ নামগান গায়। "অকলঙ্ক নামে কলঙ্ক রটিবে, দয়াময় বলে কেউ ডাকিবে না"...তোমার ওই লালপাড়, এত দহন! জ্বলেপুড়ে খাক। বৈরাগ্য অঙ্গার। ও রাধে, ও বোষ্টমী, সংসারে ফিরে গেলে তুমি বুঝি পুড়ে খাবে ঘনচোখ! চলো, ফের নামগান হোক।
যারা মনে রাখে তারা পোশাকের রং ফিরেও দেখে না
★ দংশন
ডার্ক চকোলেট ছুঁড়ে দিয়ে সে চলে গেছে মনাস্ট্রির দিকে। বুকের ভিতর ঘন্টা পড়ে তথাগত স্তব। আমি চকোলেটে কামড় বসাই। দংশনে মিশে থাকে পাপ। এত সহজে পাপ বলে ফেলার মত তাড়াহুড়ো না থাকলেই ভাল হতো। টেস্টবাডে বাদামী ধারাপাত। বিষদাঁতে কোকো। শান্তির খোঁজ পেতে তখনো পাহাড়ি বাঁক, অপেক্ষার চূড়া। বেসামাল হাওয়ায় পতাকার দিকভুল। শরীরের সাথে লেপটে আছে সাদাকালো খুঁত। সে আমাকে ডুবিয়ে রেখে গেছে লোভে, পার্থিব পতনের ঘোলাজলে। আমি চেয়ে আছি অপসৃয়মান, ঘন্টা বাজছে, ধ্বনি প্রতিধ্বনি। পাঁক মুছে নিচ্ছেন তিনি। বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি...
মেঘের গায়ে চকোলেট মুছে ফেলার আগে
একবার পিছন ফিরে তাকিও
★ চিলেকোঠা
আমি তাকে চিলেকোঠায় খুঁজে বেড়াই।
বাক্সপ্যাঁটরায়, তাকে, খাটের নীচে, কার্ণিশে সর্বত্র
মনে হয়, যেন ভূতে পেয়েছে আমায়
লাফ দিয়ে জড়িয়ে ধরি, সোহাগ করি, আঁচড়াই কামড়াই
তারপর আনখশির চুম্বনপ্রস্তাব...
খবরের কাগজ গড়িয়ে পড়ছে
ভেঙে যাচ্ছে নৌকা, দাঁড়, অস্থির প্রতিবিম্ব
শিউরে উঠছে শরীর...
এ যাবৎ যা যা অতীব শারীরিক ঠিকানা চিলেকোঠা
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে, রান্নাঘরে ঢোকে
হলুদ লংকা মাখে আঁচলে মোছে
আমিও মুখ মুছি যেখানে সেখানে
তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই...
তুমিই তো মদিরা প্রণয়, খেলাচ্ছলে শেখাও বজ্রপাত।
★ প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক
প্রসঙ্গ বদলে যায়
টগবগে প্রেমপত্রে বিপ্লবের ঝান্ডা ওড়ে
অপাংক্তেয় কোনো রক্তিম বুলেট মুখ থুবড়ে পড়লে
নন্দর মা ঝাঁপ খোলে দোকানের, রুটি বানায়
চোলাই ঠেকে বেজে যায় তালপাতার ভেঁপু
বাড়ির কাছেই কোথাও ব্রক্ষ্মকমল ফোটে
বাতাস বয়ে যায় নির্ভার...
যে মুহূর্তে প্রেমকে মনে হয় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম
আর বিপ্লবকে গোলাপের ইনকিলাব
তখনই খিচুড়ির গন্ধ বেরোয়
অভিমানের বুকে ঝাঁট পড়ে
রোদের গায়ে উড়ে বেড়ায় কিচিরমিচির
মগজাস্ত্রে উৎসব বিনয়ী আলিঙ্গন
আলিঙ্গনের প্রসঙ্গ এলেই শ্লোগানের প্রসঙ্গ আসে
শহরের প্রসঙ্গ ও। ডাকপিয়ন আসে।
ফের বিলি করে প্রেমপত্র...
★ যতিচিহ্ন
থেমে যাওয়া অনিবার্য ছিল।
তোলপাড় হয়ে যাচ্ছি ঝড়ে
হাত বাড়িয়ে বুঝে নিচ্ছি বৃষ্টির সম্ভাবনা
শিকড়ের মায়া এড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছে পাখি
ভিটেমাটি ছেড়ে পথে বেড়িয়ে পড়েছে মানুষ
বুকে ভর দিয়ে হেঁটে আসছি।
থামতে চাইছি, পারছি না
কমা, সেমিকোলন, ড্যাশ কেউ থামাতে পারছে না
আমাদের কঙ্কাল দুলছে, দুলছে শূন্য ভাতের থালা
অদূরে স্থবির সমুদ্র ব-দ্বীপের জটলা
বৃষ্টি এসে গেলে বলয়গ্রাস ভেঙে যাচ্ছে পানপাত্র
ভয় হয়। থেমে যাওয়ার ভয়। অ্যানিমিক ভয় যেন।
ভোকাট্টা ডেকে ওঠে কেউ। বাতিল লাটাই হয়ে
ঝুলে থাকি ল্যাম্পপোস্টে। চরৈবেতি আমার জন্য নয় শুধু একান্তে ছাদ আর দেয়াল মেরামতির কথা ভাবি।
★ দুপুর ভিয়েন
এখন হেমন্ত। দুপুর ঝিমিয়ে এলে কমলা রঙের রোদ গুড়ের জিলিপি দাঁত দিয়ে ছিঁড়ি। আলজিভে টসটস রসের ভিয়েন। ছাদ মাদুরে রেললাইন সমান্তরাল। কোথাও পাহাড় জেগে আছে। কোথাও বা জাহাজ মাস্তুল। তবু পাহাড়ের সাথে সমুদ্রের দেখা হয় না আর। অনৈতিক দাঁড়িপাল্লায় উঠে বসি, নামি। নীরা উড়ে যায়। পৈতৃক বাগানে ফল খসে পড়ে টুপটাপ। আমি আমশাখে নীরার পাশে গিয়ে বসি। চুমু খাই। দুপুর ভিজে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে ছোটখাটো ভুলচুক। মুদ্রাদোষ ঠোঁট ফুলে ফুলে ওঠে। চিহ্নিত অঙ্কের সমাধান চেয়ে বসে প্রতিবিম্ব। পেট্রোলের দাম বাড়লে আবার ভাবতে বসি কতদূর গুরুদোংমা! পথ ছোট হয়ে আসে। দুপুর দীর্ঘ হয়। আমিও ছাদজুড়ে সাজিয়ে রাখি অক্সিমিটার, অক্ষয় মালবেরি...
★ প্রেয়ার সং
প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে গেয়ে উঠি, "এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার"। ছাত্ররা চমকে উঠে জনগণমন থামিয়ে দেয়। ছাত্রীরা গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে। বিভূতিবাবু ফিসফিসিয়ে বলেন, "কী হচ্ছে এসব?" " আপনার আমলেরই গান তো। আপনি কখনো সুচিত্রার প্রেমে পড়েননি? " সোমা দিদিমণি ত্যারছা তাকান। ইহাকে কি কটাক্ষ বলে? আমিও কিছু কিছু বুঝি, ও দখিন হাওয়া, প্রার্থনা সংগীতের মানে! জেগে ওঠে জলপ্রপাত। জেগে ওঠে টিফিনবক্স, রং পেনসিল, ক্যারাম করিডোর। বাহার গেয়ে উঠলে রেডিও গেয়ে ওঠে কাছে কোথাও। রেডিও গাইলে ফার্স্ট বয়। গেয়ে ওঠে আচারওয়ালা, আইসক্রিমওলা। পরিচালন সমিতির সভাপতি ভারী মুখে বলে ওঠেন, "এই সক্কালে সন্ধ্যাসঙ্গীত! বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না! " কার্ণিশে দুটি পাখি মুখোমুখি এসে বসে। এখন পড়ার বইয়ে বিকেল রঙের নদী, গৌরী মাঝির দাঁড়। তরণী তোলপাড়।
প্রতিদিন জনগণ গাইবো না আর
বসন্তের প্রথম দিনে "প্রথমত আমি তোমাকে চাই"...
★ কৃষিকাজ
শরীর
নীলরং কলহের পর বিলিয়ে দিয়েছি তোমাকে
মেয়েটি বেহালা বাজাচ্ছিল
চাঁদের আলোয় সেঁকে নিচ্ছিল তার হাত
কার্পেটে পড়েছিল নিতান্ত অগোছালো শয্যাদৃশ্য
প্রতিটি স্বপ্নদোষ প্রিজমের মত বর্ণালী শীৎকার
প্রতিটি বিবাহ যেন মনোজাগতিক বায়োস্কোপ
পুরুষ রং অশ্বারোহী ধেয়ে আসে দ্রুত
টগবগ টগবগ...
কৃষিকাজ শিখে নিলে
আমিও মেয়েটির কানে কানে ধানের শিষের গান গাই
তোমার ভিতরে তুমি একা
আমার ভিতরে আমি একা
তবু কোনো পুরনো গীটার আর অষ্টাদশী লেডিস সাইকেল
জেনে গিয়েছিল বিরহের অন্য নাম শরীর কামনাতাড়িত...
★ শূন্য এবং শৃঙ্গ
একটি শূন্য চেয়ার এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা
চেয়ার শূন্য কেন সে তর্কের মীমাংসা হয়নি এখনো
যে পাহাড়ের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ায়
তার সাথে সম্পর্ক রাখি না...
তবু মোমোশপ থেকে ঘুরেফিরে তাকেই দেখতে থাকি
কাঞ্চনজঙ্ঘা ফিকে হয়ে আসে স্তনশৃঙ্গের পাশে
উপত্যকা বেয়ে নামে দর্শকাম পিঁপড়ের সারি
আমি তো বরফদানা গলনাঙ্ক খুঁজি
গড়িয়ে নামছে দেখো আমাদের প্রাচীন প্রণয়
গড়িয়ে নামছে আচম্বিত অভিঘাত
জলপ্রপাত...
যে পাহাড়ের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়
আমি তাকে দেখেও দেখি না
শূন্য চেয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকি
চেয়ার কেন শূন্য সে কথা ভেবেও ভাবি না
আর্যভট্ট নই, তাই শূন্য আমার বিষয় নয়
কেবল আঙুরফলের কথা ভাবি,
বৃত্ত বা টক যাই হোক...
মেঘে ঢেকে যাওয়ার আগে ব্যালেরিনা পাহাড়ের গান
কবি পরিচিতি ~
কবি ও সম্পাদক নিলয় নন্দী পেশায় শিক্ষক। রাণাঘাট শহরে
বেড়ে ওঠা। তবে বর্তমান নিবাস কল্যাণী, নদীয়া। কবিতা
উচ্চারণ এবং শব্দসন্ধানে ব্রতী। বাতিঘর অনলাইন ব্লগজিন
সম্পাদনা করেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'বাসন্তিকা বাসস্টপ'।
আশ্চর্য... কত লাইনে যে আর্তি পেলাম আবার কত জায়গায় পেলাম সব ভেঙে উপেক্ষা করে যাবার প্রত্যয় আর সব ছাপিয়ে 'গভীরে যাও আরো গভীরে যাও'।বারবার আরো গভীর ভাবে মুগ্ধ হই।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লেখা। ভাবনা কে উস্কে দেয় কত পথে। ধন্যবাদ কবি।
উত্তরমুছুনরাজদীপ ভট্টাচার্য