প্রণব বসুরায়'এর কবিতাগুচ্ছ
★ মন্ত্র
কিছুটা নিজের মতো, বাকিটা সামঞ্জস্য করে
উঠোনের রোদ ভাগ করে নিই, চিরকাল
রোদ্দুর কখনও সেভাবে আসেনি, তাই
আমাদের ঘর কবে থেকে ভিজে থেকে গেছে
ছাঁটবার আগে নতুন ধান শুকিয়ে নিই উঠোন-রোদ্দুরে
লক্ষ্মীর পা থামে এসে আমাদের মাটির কুটিরে...
আমরাও দ্রব হতে থাকি
মিশে যাই চাঁদের লুন্যাটিক আদুল আভায়
তোমার নাভিতে আজ মন্ত্র দেব বলে
এই দ্যাখো, স্নান সেরে গা-ও মুছিনি...
★ দায়িত্ব
অসমাপ্ত কথা ঝোলে-- গাছ থেকে
যেন এক লাশ, হাওয়ায় দুলছে,
চোখ দু'টি উপড়ে আছে, বীর্য মাখা প্যান্ট এখনও ভিজে
ভিড় জমেছে, মেয়েরা আড়চোখে দেখে, ঘুমে চলে যায়!
যতক্ষণ না পুলিশ ও ছবিওলা আসে
এ লাশের দায়িত্ব আমিই নিলাম...
★ নাট্টোৎসবে প্রবেশ নিষেধ
সফল সম্ভোগের দ্যোতনা জাগাতে পারিনি বলে
এই আশ্চর্য রাত্রি মুখ ঢাকে লজ্জাবস্ত্রে—
আমরা শুরু করি যুদ্ধের কথা
বস্তুতঃ
কোন যুদ্ধেই জয়-পরাজয় স্থায়ী হয় না, তবু
পরাজয়ের গল্প কেইবা শোনায়!
এখন নীহারিকা থেকে কিছুটা আলো এসে
ধুয়ে দিচ্ছে যাত্রা-মঞ্চ
আমরাও বদলেছি পোশাক সাবেক কালের...
নাট্টোৎসব শুরু হয় হয়
এখানে দর্শকের প্রবেশ নিষেধ...
★ আনাচ কানাচ
ভাবো, এক লুপ্ত নগরী, বসে আছি—
তোমাদের হাতে গাঁইতি, শাবল, লম্বা ফিতে
কোমল আঘাতে প্রত্নচিহ্ন ফুটে উঠছে, আর
তোমাদের উল্লাস ছবি হয়ে...
এফোঁড় ওফোঁড় সেলাই হয়ে যাচ্ছে
পাথরের ভাঙা কাপ ও পিরিচ, মোমদানি
রাত্রি হলে চলে যাবে তোমরা বিপুল মদিরায়
আর আমি খুঁজে দেখবো আনাচ কানাচ
★ ঘটনাচক্র
দক্ষিণের জানলা বেয়ে ভেসে এলো শাঁখের আওয়াজ মৃদু, মাঙ্গলিক
আরো ছিল নানা কন্ঠের শব্দজট, হাসির তবক। তিথি-উৎসব...
উত্তরে নিরেট দেয়াল, তাই এই-ই আমার সীমিত কারাকক্ষ
তোষকছাড়া চৌকি ও মশারী আছে, বিদ্যুতহীন ব্যবস্থায়
বই খাতা, খাদ্যাখাদ্য একশ শতাংশ অপ্রাসঙ্গিক
দক্ষিণ দিগন্ত কিছুই কাছের নয়, ওইদিকে সাগর-- শুনেছি
ঘটনাচক্রে এঘরের জানলাটা ঐদিকে খোলে
★ কৃষ্ণগহ্বর
বহুদিন পরে ফের একবার নিধুবনে
সরাসরি লম্বা হয়ে শোওয়া—
আকাশ, চাঁদ, তারা হয়েছে উধাও
উচাটন বাজে শুনি নূপুর নিক্কণে, মৃদুময়...
ঝরণার ফোঁটা জলে জিভ পেতে ঈষৎ লবণ
যতেক ব্যঞ্জন সব স্বাদু করে দেয়
পরীর আখ্যান শুনি লোকমুখে, থাকে সূত্রধর
আনন্দ-ধ্বনি ওঠে কৃষ্ণগহ্বরে...
★ সংবাদ
চংক্রমণের পরে বৃষ্টি নামে খুব
তার আগে হাওয়ায় উড়েছে শাড়ি পাশের বাড়িতে
সদ্ভাব নেই তত যতটা রয়েছে কুটিল সংশয়
দু’টো বাড়ি ধুলো মাখে, রোদে পোড়ে একসাথে
আজ তারা বৃষ্টি মাখবে...
পঞ্জিকা কোন সিদ্ধান্তের শেষ বাচক নয় বলে
ভিন্ন লগ্ন, আলাদা নক্ষত্র হতে পারে, প্রায়ই হয়
তবে
আজ তারা একসাথে বৃষ্টি মাখবে—
আপাততঃ এটাই সংবাদ
★ তারা-কথা (২৩)
শব্দ বেজেছে কোন দূরে, কোথাও লুকোনো আছে ঢাক
মহুয়ার বনে কোন অছিলায় উৎসব শুরু হয়ে গেল
পাচার হচ্ছে মেয়ে এই ফাঁকে সীমান্তের কাঁটাতার ছুঁয়ে...
বনান্তরে যেতে পারি, এসব পেরিয়ে, শুতে পারি শিরীষতলায়
সুচারু শিল্পের কথা রটে যাক... লৌকিক গানে
★ তারা-কথা (২৪)
এসে গেছে উৎসবের কাল, শহরের শরীরে সেই ঘ্রাণ
নতুন পোশাকগুলি পৃথক চরিত্র হয়ে
ভিন্নতর বার্তা ওড়ায় বেলুনে বেঁধে, নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে
এসবের সঙ্গে আমার কোন আঁতাত নেই
তর্পণের তিল জল ভেসে যায় সঙ্গমের টানে
সেই জলে তৃষ্ণা মেটাবেন পূর্ব পুরুষ!
আকাশ ঢেকেছে মেঘ
ঘরে দেখি ঘি মাখা পান্তার থালা!
★ তারা-কথা (২৫)
চোখ ভারী, হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে
মনে হয় ধূপের ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাব
অপরিমেয় শূন্যতায় দেখা যাবে এক নতুন নক্ষত্র-- যার
কোন আলো নেই, শুধু চোখে পড়ে মহাকাশ গবেষণা যন্ত্রে
এসব প্রাক্তন কথা সরিয়ে রাখছি
মরুর শহরে ছাউনি পড়েছে
মরূদ্যানের সন্ধান পেয়েছি, যদিও
মরীচিকা বারবার ভুল পথে টেনে নিতে চায়...
কবি পরিচিতি ~
প্রণব বসুরায় বরাবর শ্রীরামপুর শহরের বাসিন্দা। কর্মসূত্রে
যুক্ত ছিলেন এলাহাবাদ ব্যাঙ্কে। প্রথম মুদ্রিত কবিতা ১৯৬৪
সালে। 'কন্ঠস্বর' পত্রিকা প্রকাশনা এবং 'শীর্ষবিন্দু' পত্রিকা
সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। দেশ, কৃত্তিবাস, কবি
সম্মেলন প্রভৃতি পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রকাশ পেলেও
লেখালেখি মূলত লিটল ম্যাগাজিনে।
প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ - প্রণয়রাংতা, এ বাড়িতে রান্নাঘর নেই,
ফ্রেডরিক নগরের বাসিন্দা, মাইনাস ডেসিবল ,
চর্বির মোম যেটুকু আলো দিতে পারে এবং রাতের সেলাই কল।
বারাকপুর স্টেশন পত্রিকার পাতায় প্রণব বাবুর মতো সিনিয়র কবিকে পেয়ে আমরা গর্বিত ও আনন্দিত।
উত্তরমুছুনরাজদীপ ভট্টাচার্য