''অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে''
সজ্জ্বল দত্ত
৩.
দর্শন ও মূলভাবধারা
আধুনিক বাংলা কবিতার কবিদের মধ্যে যাদের কবিতায় নিছক বাকসর্বস্বতা তাদের এমন কোন জোরালো দাবী নেই যে তাদের নিজস্ব জীবনদর্শন এবং তাকে জড়িয়ে কবিতার অন্তর্নিহিত দর্শন নিয়ে আলোচক মাথা ঘামাক , আলোচকেরও নেই সেই দায়বদ্ধতা । কিন্তু প্রকৃত বোধসম্পন্ন কবির কবিতার দর্শন ও মূলভাবধারা ঠিক কোন্ পথে কিভাবে আসে তা নির্ধারণ করতেই হয় , নাহলে আলোচনা থেকে যায় অসম্পূর্ণ । আর এও ঠিক , ব্যাপারটা কোন নির্দিষ্ট ফর্মুলায় হয় না । রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যেমন বেশিরভাগ আলোচকই একমত যে রবীন্দ্রকবিতার দর্শনের মূল ভিত্তি হল উপনিষদ । " ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যথ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ " । কিন্তু সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত স্বল্পসংখ্যক কয়েকজন বলছেন ' রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন সমাজবিজ্ঞানী , তার দর্শনের মূল ভিত্তি হল আধ্যাত্মিক জড়বাদ । রবীন্দ্রনাথের মত এমন আশ্চর্যভাবে কবিতায় বিপ্লবের ব্যাখ্যা আর কেউ দেননি ।
কবি দেবদাস আচার্য সম্পর্কে চোখ বুঁজে বলে দেওয়া যায় যে উনি সমাজতান্ত্রিক ধারণার কবি ।
" আমি ফিরে এসেছি তোমাদের মধ্যে
বারবার ফিরে এসেছি
এই মধু ও গম , ধানের শিস হাতে
এই লাঙলের ফলা হাতে
প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে, প্রতিটি জনপদে,
আমাকে স্পর্শ করো এবং উদ্দীপিত হও " ।
( রাজা বিক্রমাদিত্য বলেন : উৎসবীজ )
এই লাইনগুলি পরিস্কারভাবে তার প্রমাণ । কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মানে তিনি কি মার্কসবাদী ? শ্রেণীসংগ্রাম, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ধারণা তার কবিতায় তেমনভাবে চোখে পড়ে কি ?
কবি দেবদাস অবশ্যই সমাজতান্ত্রিক ধারণার কবি নন , তিনি ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের কবি ।
" সবাই চলে যায় উৎসমুখ থেকে
নিরবচ্ছিন্নভাবে, নিরবধিকাল ।
কালও চিহ্নহীন হয়ে যায়, স্মৃতি লুপ্ত হয়
রূপান্তরে পরিবর্তিত হয়ে যায় মহাকালও ।
# # # #
নদীতে পুরোনো ঢেউ পুনর্বার জাগ্রত হয় না ,
অতিক্রান্ত সময়ও কখনো
ফিরে তাকায় না পশ্চাতে ।
# # # #
একদিন ধীরে ধীরে এই চিরগতি মিশে যায়
জরা-মৃত্যুহীন এক অন্তহীন গতির বলয়ে " ।
( ' অমর ' : তর্পণ )
এইবার কী প্রমাণ হয় , দেবদাসের কবিতায় অসাধারণভাবে এই দুইয়ের মিশ্রণ ? মাটি আর মানুষের সঙ্গে আত্মার যে নিবিড় সম্পর্ক সেটাই সকলের চেয়ে বড় নিত্য সম্পর্ক । যে মুহূর্তে কবি , তোমার মধ্যে এই সত্ত্বা জেগে উঠবে , সেই মুহূর্তে কবি তুমি সমস্ত জগৎ সংসার বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তোমার কবিতায় কাছে টেনে নিতে পারবে । অন্তরের সবকটি দ্বার উদ্ঘাটিত হবে , উঠে যাবে তুমি শ্রেণীচেতনার ঊর্ধ্বে ।
কবি দেবদাস আচার্যর কবিতায় প্রথম থেকেই পাওয়া যায় এই জীবনদর্শন । শ্রমের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা আর সেই সঙ্গে কোষে কোষে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া ভারতীয় দর্শন । জীবাত্মা ও পরমাত্মা দু'য়েরই স্বচ্ছ বোধ বা ধারণা তার কবিতার দর্শনকে , কবিতার মূলভাবধারাকে এক সর্বোচ্চ পর্যায়ের আসন দিতে পেরেছে । দেবদাস আচার্যর আত্মজীবনীর যে একটি অংশ ' গল্পসরণি ' পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল , তার থেকে জানা যায় তার কিশোর বয়স থেকে উদ্বাস্তু জীবনের কথা , অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের জন্য পরিবারের অন্যদের সঙ্গে নিয়ে একটা সময়ে নিরন্তর সংগ্রামের কথা যা হয়তবা তাকে দিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক দর্শনের অনুভূতি । পাশাপাশি পিতা ও মাতার প্রভাবে এবং সম্ভবত: কিছুটা সদব্রাহ্মণকূলে জন্মের কারণেও ধীরে ধীরে তার মনে জেগে ওঠে ভারতীয় দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা । এই দুইয়ে মিলেই তিনি কাব্যিক সুষমায় লিখে যেতে পেরেছেন সৃষ্টির বিবর্তনের প্রকৃত ইতিহাস, আর সঙ্গে ইঙ্গিত দিয়ে যেতে পেরেছেন সভ্যতার আগামী গতিপথের দিকে । তবে তার কাব্যভাবনার শুরুর দিকটা কিন্তু অনেকটাই খেটেখাওয়া মানুষের দিনলিপি । এইখান থেকে প্রথম উল্লেখযোগ্য মোচড় " উৎসবীজ " , এবং দ্বিতীয় " আচার্যর ভদ্রাসন " ।
" উৎসবীজ " পৃথিবী থেকে শুরু করে গোটা সৌরজগৎ , ছায়াপথ , সেখান থেকে আরো দূর মহাশূন্য ব্যপী ছুটে বেড়ানো এক প্রচণ্ড কম্পন , যা এগিয়ে নিয়ে যায় সহস্র লক্ষ কোটি বছর ধরে সময়ের ইতিহাসকে । নিছক বস্তুবাদী সমাজতান্ত্রিক ধারণায় একে আবদ্ধ রাখা যায় না । দেবদাসের পূর্ববর্তী কাব্যগ্রন্থগুলি থেকে " উৎসবীজ " এই কারণে পৃথক । উৎসবীজে দেবদাস লিখছেন :
" ছিল এ জগৎ শুধু
বস্তুভারে ক্লান্তিকর , নিরেট , নিষ্প্রাণ ,
অন্ধকারে অগ্নিরাশি মহাতারকারা
ছড়ায় লোলুপফণা , অদৃশ্য-গহ্বর
গ্রাস করে ভ্রাম্যমান বস্তুপিণ্ড , শিলা ।
প্রাণের নিনাদহীন জড় ছায়াপথ
নিরন্তর প্রসারিত হয় , অবিশ্রাম
ছোটে নিজ গ্যালাক্সিতে , বস্তুর পাহাড়
সংখ্যাহীন পরিমাপহীন , কোন গতি
অন্তহীন খাতে করে নিয়ন্ত্রণ ওই
অগ্নিময় নিষ্প্রাণ বস্তুর জঙ্গল " ।
প্রাণের বহুপূর্ব থেকে এই উৎসবীজ-বিস্তৃতির সূচনা । আর ব্যক্ত প্রাণকে কিভাবে বলা হচ্ছে এই কাব্যগ্রন্থে ?
" একটি কণিকামাত্র , সৌরকক্ষে স্থিত
ছায়াপথে লুক্কায়িত , আহ্নিক গতির
নিয়ন্ত্রণে ঘূর্ণমান , ভৌম-প্রেক্ষাপটে
অস্তিত্ববিহীন প্রায় , অতীন্দ্রিয় ধ্যানে
আভাসিত হয় শুধু , ব্রহ্মাণ্ডলোকের চেতনায়।
তবু তার জন্যে সমারোহে
বহির্বিশ্বের সব নক্ষত্রপুঞ্জের
নিজ নিজ মহাকাশে উড়ল পতাকা ,
ওঁ-ধ্বনি জাগরিত হল নাভি থেকে
ব্রহ্মাণ্ডলোকের " ।
" উৎসবীজ " এর পরের কাব্যগ্রন্থ " আচার্যর ভদ্রাসন " । সেখানেই প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে চমৎকারভাবে বস্তুবাদী ও আধ্যাত্মবাদী দর্শন মিশে গেছে । ' আচার্যর ভদ্রাসন ' এর কবিতাগুলো লেখার স্টাইল একেবারে অন্যরকম । সিদ্ধাচার্যরূপী কবির ইন্দ্রিয়জগতে চেতনায় যা ধরা পড়ছে তাই এখানে কবির কবিতার মূল ভাববস্তু । কিছুটা যেন নাড়িচক্র সাধনার মত , যেন চর্যাপদের কবিদের সাধনারই আধুনিক রূপ , যেন দেহবাদী থেকে ক্রমশঃ দেহাতীতে যাওয়ার চেষ্টা । সিদ্ধাচার্য শূন্যবাদী , নির্বাণ-পিপাসু । সিদ্ধাচার্যর সাধনসঙ্গিনীর লালপেড়ে মোটা শাড়ি । পেচক , শব ও শিবা সিদ্ধাচার্যের গান শোনে । পদ্মের ওপর বসে নৈরাত্মমণি তাকে কোলে তুলে নেন । এইসব বিবিধ অনুষঙ্গে প্রমাণ হয় লুই পা , কাহ্ন পা র চর্যার দর্শনের আধুনিক রূপ , যার প্রতিটি স্তরে কবি আঁকড়ে ধরেন মানুষকে । " উৎসবীজ " এর কবিতা মানুষ তথা প্রাণের ঊর্ধ্বে আরো অনেককিছু । আচার্যর ভদ্রাসন-এ --
" রাত ঘন হয় , আর অতিপ্রাকৃতিক
ব্রহ্ম-পদ্ম ফুটলে ডেকে ওঠে ডোমের কুকুর
# # # #
এই প্রসারতা অন্তহীন ,
তারও পরে আছে বিশুদ্ধ ধ্যান
তারও পরে ?
# # # #
সিদ্ধাচার্য ভ্রষ্ট সন্ন্যাসী
তার তৃতীয় নয়ন
অশ্রুতে ভেসে যায় । "
এই অশ্রু মানুষ ও মানবতার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার অশ্রু , ব্রহ্মপদ্মের পাশাপাশি ডোমের প্রসঙ্গই তার প্রমাণ । গোটা ' আচার্যর ভদ্রাসন ' কাব্যগ্রন্থেই কবির সংবেদনশীল মন এমনি করে খুঁজে ফিরেছে চলমান জীবনযাপনকে আর আকুল প্রার্থনা করেছে এই মায়ামমতাময় জীবনে মানুষের সঙ্গে যেন আজীবন থেকে যেতে পারেন । নাড়িচক্রে মূলাধার থেকে আজ্ঞা পর্যন্ত সবকটি চক্রে যেমন একেকটি পদ্মের মুখ খোলে আর একেকটি জগৎ উদ্ভাসিত হয় , তেমনি এখানেও পর্যায়ক্রমে একে একে যেন খুলে যেতে থাকে জীবনের একেকটি পর্দা ।
" কালক্রম ও প্রতিধ্বনি " প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেবদাস আচার্যর কবিতার দর্শন একটি নির্দিষ্ট দিকের সন্ধান করেছে । " মৃৎশকট "এ তা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে । তারপর " মানুষের মূর্তি "র খেটে খাওয়া মানুষের ছবি এবং আরো আরো বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের পথ পার হয়ে প্রথমে " উৎসবীজ " তারপর " আচার্যর ভদ্রাসন "এ মিলিত হল দুই প্রান্তের দুই দর্শন এবং তৈরি হল দেবদাসের কবিতার নিজস্ব দর্শন যা পরবর্তীতে ঠিক ঠিক উত্তরিত হয়েছে " সুভাষিতম "-এ , "তর্পণ"-এ ।
" প্রতি মুহূর্তের এই পৃথিবী
যে গতিতে ঘূর্ণায়মান
তার চেয়েও দ্রুতগতিতে ঘূর্ণায়মান
চেতনার জগৎ " ( সুভাষিতম )
এই চেতনার জগৎ প্রবলভাবে আছড়ে পড়েছে বর্তমান পৃথিবীতে , খুঁজে ফিরেছে ইতিহাস , সভ্যতার ভিতরে-বাইরে কালের প্রতিটি ক্ষুদ্রাংশে এবং অবশেষে ভালোবাসার আকর্ষ ছড়িয়ে দিয়েছে মানুষের জন্য , ঈশ্বর বা শয়তানের জন্য , সকলের জন্য , সবকিছুর জন্য । মানুষ , ঈশ্বর , শয়তানের এই সাম্য এক নির্বিকার আসক্তির প্রবাহ -- এই পৃথিবী ।
দেবদাস আচার্যর কবিতার দর্শন ও মূলভাবধারা সময়ের বয়ে চলা এবং তার সমস্ত উপাদানকে সঙ্গে নিয়ে এক আশ্চর্য আলোয় উদ্ভাসিত । যা বিস্তৃত বিলুপ্ত ছিল , কবিতার জাগ্রতক্ষেত্রে এসে তাকে রহস্যে একেবারে অভিভূত করে দিচ্ছেন কবি দেবদাস। সমস্ত চেতনাই যে এক অখণ্ড ও অবিচ্ছিন্ন - এই তত্ত্বকে প্রত্যক্ষ করতে হলে দেবদাসের কবিতার বিস্তৃতপাঠ অবশ্য প্রয়োজন। দেবদাস-কবিতায় চেতনা অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে একটা হাইফেনের মতো, যা অনায়াসে মিশে যেতে পারে জড়ের সঙ্গে, আর পাঠক আমরা নিমেষে জড়রাজ্যকে জড়িয়ে জড়রাজ্যের বাইরেরও সমস্ত বিষয় নিজচেতনায় ধারণা করতে সমর্থ হই।
( চলবে )
খুব সুন্দর এই কবি ও কবিতার বিশ্লেষণ। ভালো লাগছে পড়তে ।
উত্তরমুছুনচমৎকার বিশ্লেষন
উত্তরমুছুনরাত ঘন হয় , আর অতিপ্রাকৃতিক
উত্তরমুছুনব্রহ্ম-পদ্ম ফুটলে ডেকে ওঠে ডোমের কুকুর । দর্শন কী ভীষণ বাঙ্ময়। অধ্যাত্ম চেতনায় জারিত কবিতা। অনিন্দিতা মন্ডল।