শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ২০২৩

ষষ্ঠ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

 "অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে"

সজ্জ্বল দত্ত



৬.

সমসাময়িক বাংলা কবিতা

দেবদাস ছ'য়ের দশকের শেষপ্রান্তের কবি । তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি "র প্রকাশকাল ১৯৭০ । প্রথম বই যে বছর বার হচ্ছে তার অন্ততঃ বছর দু-তিন আগে সেই কবি পুরোদস্তুর কবিতা লেখালেখির মধ্যে চলে এসেছেন - এমন অনায়াসেই ধরে নেওয়া যায় । সুতরাং দেবদাসের কবিজন্মের সূচনা নিশ্চিতভাবে ষাটের দ্বিতীয়ার্ধে । অবশ্য দেবদাসের কবিতার জনপ্রিয়তা মূলতঃ সত্তরের দশকেই । 
   এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেবদাসের সমসাময়িক বাংলা কবিতা বলতে কাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা হবে ? যে সময়ে দেবদাসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ , তার পাঁচ-ছ' বছর আগে থেকে বাংলা কবিতা মোটামুটি সেইসব সোনা ফলাতে শুরু করেছে , আজ পঞ্চাশ-ষাট বছর পরেও যাদের ঔজ্জ্বল্যে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়েনি । একের পর এক স্বর্ণময় কাব্যগ্রন্থ বার হচ্ছে তখন - উৎপল কুমার বসুর " পুরী সিরিজ ( ১৯৬৪ ) , কালীকৃষ্ণ গুহর " রক্তাক্ত বেদীর পাশে ( ১৯৬৭ ) , পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের " আগুনের বাসিন্দা ( ১৯৬৭ ) , " ইবলিশের আত্মদর্শন ( ১৯৬৯ ) , তুষার রায়ের " ব্যাণ্ডমাস্টার " ( ১৯৬৯ ) । হাংরি ও শাস্ত্রবিরোধী'র মত দুই বাংলাসাহিত্যজগৎ তোলপাড় করা সাহিত্য আন্দোলনে নিবিষ্ট পাঠকের বড় একটা অংশের কবিতাসংক্রান্ত ধ্যানধারণা  প্রবল ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে । ঠিক এইরকম একটি পটভূমির ওপর দাঁড়িয়ে দেবদাসের প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ । " লেখা " পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে দেবদাস আচার্য বলছেন যে প্রথমদিকের লেখালেখির সময় তাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল হাংরি জেনারেশন এর কবিদের আন্দোলন । তো , হাংরি কবিতা নিয়েই এ' আলোচনা তাহলে শুরু করা যাক । ... কবি অরুণেশ ঘোষের " এই আমার শহর " কবিতার কিছু অংশ : 
 
      " আমার বাপের রুমাল ছিল না 
                               অথবা তার বাপের 
     অথচ আমার মায়ের রুমাল ছিল 
                               এবং তার মায়েরও 
     অর্থাৎ রুমাল-সভ্যতা এসেছে 
                              মেয়েদের কাছ থেকেই 
     দুপুরবেলা ভাটিখানার বেঞ্চে বসে
                              আমার হাসি পায় 
    মাসিকের সময় গুঁজে দেবার জন্য যে ন্যাকড়া 
    কোন শতাব্দীতে তার কোলে ফুটে উঠল 
                              গোলাপফুল ? 
  ১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে 
     তার লেঙট 
  ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে 
  ১ রোবট নিজেকে মনে করে 
     আগামীকালের শাসক 
  ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময় 
  ১ অধ্যাপিকার যৌনাঙ্গে গজিয়ে ওঠে 
                              অশিক্ষিত কালো ঘাস 
   আর ১ পাগলকবি দু'পা ফাঁক করে 
   পেচ্ছাপ করে দেয় 
   শীতের ভোররাত্রে - 
                          মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর
   আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে  
                          বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা 
   আমি দুপুরবেলা ঘুরে বেড়াই " 

উৎসবীজ , মৃৎশকট , সুভাষিতম বা তর্পণ এর কবিতার বিরাট বিরাট ক্যানভাসের সঙ্গে তো প্রশ্নই ওঠে না , এমনকি প্রথমদিকের কালক্রম ও প্রতিধ্বনি বা মানুষের মূর্তির সঙ্গেও এই কবিতার কোন তুলনা হয় না । দেবদাস আচার্য নিজে বললেও - না । মিল , প্রভাব কোনোদিক দিয়েই না । ছ'য়ের দশকে বহিঃপৃথিবীতে এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল যে তার প্রভাব আমাদের এখানে রাজনীতি , অর্থনীতি , সমাজনীতি , সাহিত্য কোনোকিছুতেই অস্বীকার করা যায় নি । বিশ্বব্যাপী ছাত্র-যুব-তরুণ সমাজের বিভিন্ন বিদ্রোহের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে আমাদের সংস্কৃতিতেও । তারই ফল হয়ত বা হাংরি জেনারেশনের কবিতা । বহির্বিশ্বের গতিপ্রকৃতি এবং তার ফলে কবিতার বিষয়ে , ভাষায় বিপ্লবের ঢেউ দেবদাস-কবিতাতেও পড়ে , কিন্তু হাংরি কবিতার থেকে তা সম্পূর্ণ আলাদা । 
         ১৯৯৮ সালে সমীর চৌধুরীর সম্পাদনায় " কথা ও কাহিনী " থেকে যে হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন বার হয়েছে তার মুখবন্ধে ' হাংরি জেনারেশন কেন ' শীর্ষক লেখায় সমীর চৌধুরী লিখছেন - " হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে অন্য যে কোন সাহিত্য আন্দোলনের মূল তফাত এইখানে যে , তেমন কোন দার্শনিক ভিত্তিভূমি থেকে এই আন্দোলন গড়ে ওঠেনি " । খোলামেলা ভাষা ও শব্দকে কেন্দ্র করে " আধুনিকতার শবদেহের ওপর উল্লাসময় নৃত্যের নামই হাংরি জেনারেশন " । 
আর দেবদাস-কবিতার প্রধান ভিত্তিটাই হল দর্শন । কোটি কোটি বছরের সভ্যতা তথা গোটা সৌরসংসারের বিবর্তনের ইতিহাস , যার কেন্দ্রে রয়েছে সেই আদি অকৃত্রিম মাটি আর মানুষ । শব্দব্যবহারে , ভাষাপ্রয়োগে দেবদাস যথেষ্ট অন্যরকম । হাংরি জেনারেশন কবিদের মত তিনি অক্লেশে ' পোঁদ ' শব্দটি লিখতেই পারেননি । তিনি লিখেছেন ' পাছা ' । এইখানেই তো এই কবিতাবিপ্লবের সঙ্গে দেবদাস-কবিতার অনেকখানি পার্থক্য । 
হাংরি কবিতা ছাড়া ছ'য়ের দশকের অন্য কবিদের কবিতায় আসা যাক । বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের প্রায় ছ-সাতটি দশকের মধ্যে ছয়দশকেই বাংলা কবিতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা সম্ভবতঃ সবচেয়ে বেশি হয়েছে । হাংরি আন্দোলন তো আছেই , তার পাশাপাশি মৃণাল বসুচৌধুরী , অতীন্দ্রিয় পাঠকদের শ্রুতি আন্দোলনের ধারায় আর একধরনের কবিতা । এক্সপেরিমেন্টাল কবিতা প্রচুর লেখা হওয়ার জন্য এবং কবিতার নির্মাণশৈলী ভীষণভাবে ছড়িয়ে যাওয়ার জন্যই সম্ভবতঃ আলাদাকরে ছয়ের দশকের কবিতার কোনো দশকভিত্তিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে না । কিন্তু এই দশকের অনেক কবিকেই তাদের নিজেদের-নিজেদের মত করে আলাদা বৈশিষ্ট্যযুক্ত বলে চিহ্নিত করা যায় । তুষার রায়ের কবিতা একরকম , অমিতাভ গুপ্তর কবিতা একেবারে একশো শতাংশ অন্যরকম । ভাস্কর চক্রবর্তী আবার আর এক ধরনের । অনেক বেশি মাত্রায় স্পর্শকাতর । উদাস বিকেলে একা একা বসে অদ্ভুত মনখারাপ নিয়ে পড়ার মত । 
তবে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যর মত একটা মিলের কথা উল্লেখ করাই যেতে পারে ।  ছয়ের দশকের কবিদের প্রতিক্রিয়ায় কেমন যেন একধরনের বিতৃষ্ণ ভাব , ছ'য়ের বেশিরভাগ কবি যেন স্বেচ্ছায় অশিক্ষিত হতে চেয়েছেন । হাংরি জেনারেশন বাদ দিলাম , দেবদাসকেও বাদ দিলাম , ছয়ের দশকের অন্য চারজন কবির কথা ধরা যাক । ধরা যাক , পবিত্র মুখোপাধ্যায় , রত্নেশ্বর হাজরা , কালীকৃষ্ণ গুহ এবং উৎপল কুমার বসু । বিশিষ্ট কবিতাসমালোচক বার্ণিক রায় তার " কবিতা : চিত্রিত ছায়া " গ্রন্থে ছয়ের দশকের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই চারজনের প্রথম তিন কবি সম্পর্কে কী বলছেন ? ... পবিত্র মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে আলোচনার শুরুতেই বলছেন -- " পবিত্রর সমস্ত কবিতার মধ্যে একটা ধ্বংস, অন্ধকার, ক্লেদ, বিষাদ, নিঃসঙ্গতা, মৃত্যুর আগুন, অবিশ্বাস, শীতলতা ও যন্ত্রণাবিদ্ধ উপলব্ধির তীব্র বিষময় সুরা অনুভব করা যায় " । ... রত্নেশ্বর সম্পর্কে বলছেন - " এ যুগের কবিদের ক্ষয়িষ্ণু জীবনবোধের মধ্যেও তাকে ছাপিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলোকিত চেতনার প্রত্যয়কে অতি সহজে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারেন তিনি । তার কবিতায় ক্ষুধার্ত বাতাস আর হাঙরমুখো পাতাল খেলা করলেও চেতনার হাস্যধ্বনির কাছে সব তুচ্ছ " । ... আর কালীকৃষ্ণ গুহর কবিতা প্রসঙ্গে তার বক্তব্য - " কালীকৃষ্ণ বহির্জগতের সমস্ত বেদনাজ্বালা রক্তক্ষরণ এবং একইসঙ্গে অন্তর্জগতের বেদনা বুকের ভেতর নিয়ে নিবিড় যন্ত্রণায় বাস করছেন । এখানে বহির্জগতের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই , নিবিড় হৃদয়ের অন্ধকারে প্রতীকের মত বহির্জগত তারার আলো নিয়ে জ্বলছে " । ... কিন্তু দেবদাসের কবিতা ? তার মূল জায়গাটাই যে দর্শন ! গভীরতম সমাজতান্ত্রিক দর্শনের সঙ্গে ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের নিবিড় মিশ্রণ ! সুতরাং  ... ... 

    উৎপল কুমার বসু ।  ' পুরী সিরিজ ' , ' আবার পুরী সিরিজ ' , ' লোচনদাস কারিগর ' ইত্যাদি সমেত উৎপল কুমার বসুর সমগ্র কবিজীবন অনুসরণ করে , দেবদাস আচার্যর পূর্বসূরি হিসেবে তুলনামূলক আলোচনায় আমার সবচেয়ে প্রিয় মন্তব্যটিই এখানে রাখি । ... আলোচক সুজিত সরকার । - " উৎপল কুমার বসুকে আমার বরাবরই এক বিদেশী কবি বলে মনে হয়েছে । বাঙালীকবি হিসেবে আমি তাকে কোনদিন ভাবতেই পারিনি । তার কবিতা পড়তে পড়তে কেবলই মনে হয়েছে , এ যেন কোন বিদেশী কবিতার অসাধারণ বাংলা অনুবাদ "    (  শব্দের নিজস্ব আলো : পৃষ্ঠা ৬৮ ) । উৎপল কুমার বসুর কবিতার নাম " অর্কিড " , " রা-রা-রা ডেমোক্রেসি " । গাছের নাম ব্যবহার করতে হলে শব্দ পাওয়া যাবে " ইউক্যালিপ্টাস " , নারীর নাম ব্যবহারের প্রয়োজন হলে শব্দটি হবে " মরিয়ম " । ... অন্যদিকে দেবদাস শতকরা একশোভাগ এই মাটির কবি , এই মানুষের , এই বাংলার গ্রামের কবি । তার কবিতার শব্দচয়নে চাষি বিদে দেয় , খুঁটে তোলে আগাছা , শস্যে নিড়িনি চালায় । 
          সর্ব আলোচনাশেষে নির্দ্বিধায় বরং দ্রুত এ'কথা মেনে নেওয়া ভালো যে পুরোদশকের কবিতা থেকেই দেবদাস-কবিতা একেবারে স্বতন্ত্র , অন্যরকম । কিরকম ? পরীক্ষানিরীক্ষার তেমন একটা ধার ধারেন না , তবে নিজস্বতা অবশ্যই পুরোমাত্রায় খুঁজে পাওয়া যায় । আসলে তিনি বিরাট বিরাট এক ক্যানভাসে প্রাণপণে খুঁজে বেড়ান নিজের তথা জীবনের অর্থ । বারবার বিভিন্ন কবিতায় তার এই খুঁজে ফেরা চোখে পড়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় । 

ক্যানভাস ১ - " নিঃসীম শূন্যের গহ্বরে কালো , ধূ-ধূ কালো , আকস্মিক পদস্খলনের / পর ছুটে যায় সেই শূন্যের ভিতরে অনুপরমাণুময় ধুলোঝড় " । ... নিজে ,তথা জীবন , তথা প্রাণের অর্থ - " সেই ঝড় থেকে মুক্ত অণু এক ভাসমান মহাশূন্য অতিক্রম করে / এসেছি এ' পৃথিবীতে , জল দাও আলো দাও স্থিতি দাও প্রাণবায়ু দাও " । ( উৎসবীজ ) 

ক্যানভাস ২ - " দুঃখ নয় শোক নয় ভালোবাসা নয় / সে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল সময়ের মাঝখানে , হাতে পেটানো ঘন্টা " । ... আর নিজে তথা জীবন তথা প্রাণের ব্যাখ্যা - " এক কোটি বছর ধরে ঠেলে এনেছি আজকের প্রচ্ছদ / মেঘ , বায়ু , ঘনঘোর জ্যোৎস্না ও অন্ধকার / উল্লাস , অশ্রু , যৌন-কীট / বিশাল ঐতিহ্য , সংগ্রাম " । ( মৃৎশকট ) 

ক্যানভাস ৩ - " এ পাশে পৃথিবী আর ওপাশে আকাশ " । ... জীবন তথা প্রাণ - " মাঝখানে / সবিস্ময়ে কাশীনাথ চেয়ে দেখে / কাণ্ডারীবিহীন নৌকা ভেসে যায় " । ( অগ্রন্থিত কবিতা ) 

         এরকম উদাহরণ আরো বহু বহু খুঁজে পাওয়া যায় । ফলতঃ অনায়াসে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতেই পারে যে সমসময়ের কবিতার সঙ্গে দেবদাস-কবিতা মেলে না । আর সত্যি বলতে কী দেবদাস-কবিতার বিস্তৃত পাঠশেষে এমনই মনে হয় যে , " সমসময় " নামক এত ক্ষুদ্র শব্দে কী আদৌ আটকে রাখা সম্ভব সূর্যের মত তেজস্বী এই কবিতাআলোর ঔজ্জ্বল্য ? 
                                ( আগামী পর্বে শেষ ) 

1 টি মন্তব্য:

  1. এ এক অমূল্য সম্পদ। লেখক এবং সম্পাদককে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...