রবিবার, ৪ জুলাই, ২০২১

 

"ঘরে বাইরে"--কালিকলম-সেলুলয়েড

                                 সজ্জ্বল দত্ত 



 ঘটনা প্রত্যেকের জানা । " ঘরে বাইরে "র গল্প শুধু শুধু আর একবার উল্লেখ করে আলোচনা দীর্ঘায়িত করব না । অকারণ কোন দীর্ঘ ভূমিকার অবতারণা করে পাঠকের সময় নষ্ট করতেও রাজী নই । সরাসরি যা বলতে চাই , সে প্রসঙ্গে আসি । ১৯১৫ সালে প্রথম প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের সাড়া জাগান উপন্যাস " ঘরে বাইরে " র গুরুত্বটা ঠিক কোথায় , সেইটা বরং প্রথমে একটু ভাবনাচিন্তা করা যাক । কি ধরনের উপন্যাস এটি ? ঐতিহাসিক ? সামাজিক ও নারীমুক্তির ? রবীন্দ্র ভাবধারার জাতীয়তাবোধের ? এই সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে ? " ঘরে বাইরে " শব্দবন্ধটুকু যাকে ঘিরে তিনি তৎকালীন সময়ে অভিজাত বংশের শিক্ষিতা একজন  গৃহবধূ- বিমলা । গোটা উপন্যাস জুড়ে আরো আছেন নীতি ও রাজনীতির সংঘাত ও দ্বন্দ্ব নিয়ে বিমলার প্রগতিশীল শিক্ষিত স্বামী নিখিলেশ ও তার বন্ধু তৎকালীন স্বদেশী আন্দোলনের জনপ্রিয় নেতা সন্দীপ । আছেন অন্তঃপুরবাসিনী বিধবা মেজঠাকুরানী , সন্দীপের ডাকে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়া মেধাবী অমূল্য । আছেন নায়েবমশাই , আছেন নিখিলেশের আদর্শবাদী মাস্টারমশাই চন্দ্রনাথবাবু এবং আরো অনেকে । কি ধরনের উপন্যাস, প্রধানতঃ কার গল্প , কিসের গল্প " ঘরে বাইরে " , এ ব্যাপারে এই আলোচনায় নিশ্চয়ই একটি সুনির্দিষ্ট উপসংহারে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে , তবে তারও আগে ছোট্ট  একটি বিষয়ের উল্লেখ করি যা হয়ত বোঝাবে কেন অত্যন্ত আধুনিক এই উপন্যাসের বিশ্বজোড়া খ্যাতি  কেন পাশ্চাত্যেও এর তুমুল জনপ্রিয়তা । 

১৯১৯ সালে " ঘরে বাইরে " র ইংরেজী অনুবাদ করেন রবীন্দ্রভ্রাতুষ্পুত্র  সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর । প্রকাশমাত্রই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রচুর পত্রপত্রিকায় উপন্যাসটির আলোচনা ঘিরে যথেষ্ট আলোড়নের সৃষ্টি হয় । এ'দেশীয় আলোচকগণ বঙ্গভঙ্গ ঘিরে স্বদেশী বয়কট আন্দোলনকারী ও তার মুখোশধারী নেতৃত্বর প্রসঙ্গে আলোচনা করে প্রচুর সোরগোল তোলেন । সত্যি বলতে কি আজ একশো বছর পরেও  তরুণ প্রজন্ম এখনো " ঘরে বাইরে "কে কতকটা সেই দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েই বিচার করেন । কিন্তু পাশ্চাত্যে হৈচৈ পড়ার কারণ ? পরবর্তীতে এই ইংরেজী অনুবাদের প্রকাশক ম্যাকমিলান কম্পানী তাদের এডিশানের বইয়ের ভূমিকায় যা লিখেছিলেন তার থেকে এ' বিষয়ে হয়ত কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে  । -- " The book illustrates the battle Tagore had with himself , between the ideas of politics of western culture and the socio-political revolution against it in eastern culture . These two ideas are portrayed in two of the main characters , Nikhilesh who is rational and opposes violence , and Sandip who will let nothing stand in his way from reaching his goals " . 

  প্রাচ্যের , আরো নির্দিষ্ট ভাবে ভারতের , আরো নির্দিষ্ট ভাবে এই বঙ্গের চরিত্র , সংলাপ , চিত্রকল্প জড়ানো  রবীন্দ্রসাহিত্য কি শুধুমাত্র প্রাচ্যসাহিত্য ? তাতেই তার বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তা ? " ঘরে বাইরে " ১৯৮৪ সালে চলচ্চিত্রায়িত করেন আর এক বিশ্ববন্দিত বাঙালী সত্যজিৎ রায় । জীবনীকার অ্যাণ্ড্রু রবিনসন কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাহিত্য ও শিল্পকলা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রসঙ্গ উঠলে সত্যজিৎ রায় খুব স্পষ্টভাবে বলছেন " Rabindranath is completely an isolated phenomenon . More eastern ? Or more western ? I find it very difficult to classify him to put him into a pigeonhole " . 

              *            *          *         * 

  সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের সম্পর্ক নিয়ে নানা মুনির নানা মত । সমস্ত মত মাথায় রেখেই বলা যায় , অক্ষর  ও তার দৃশ্যায়ন নিয়ে আলোচনাপ্রসঙ্গে সেই কবে ১৮৬০ সালে  দার্শনিক C S Peirce দুটি শব্দ ব্যবহার করেন । ' sign ' আর ' icon ' । চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়নে একমাত্র  এই দুইয়ের সৌন্দর্যপূর্ণ সঠিক ব্যবহারই সত্যি মূল সাহিত্যের সঙ্গে তার নিবিড় সেতুবন্ধনের কাজটি বোধহয় জোরালোভাবে করে । 

                    " ঘরে বাইরে " র আলোচনায় ফিরি ।  সাহিত্য ঘরে বাইরে ও ছায়াছবি ঘরে বাইরে কে একসঙ্গে নিয়ে সূক্ষ্মতম জায়গা ধরে ধরে আলোচনা করলে  এ' আলোচনা দীর্ঘ বিস্তৃতি পেতে পারে । সীমিত পরিসরে অতখানি আলোচনা  সম্ভব নয় । বরং দুই মহান সৃষ্টির আপন আপন শিল্পমাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় পারস্পরিক পার্থক্য  ও মিল এর মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা যাক ।     

পার্থক্য : ১ )  রবীন্দ্ররচনায় বিমলার প্রথম আত্মকথনেই স্বদেশী আন্দোলন ও বন্দেমাতরম মন্ত্র ছাড়াই নিখিলেশ কিভাবে পরিকল্পনামাফিক তার " সুখসায়র " গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিতি বর্জন করে স্বদেশীয়ানা আনয়নের চেষ্টা করেছিলেন তার বিবরণ আছে । -- " আমাদের জেলায় খেজুর গাছ অজস্র , কী করে এইসব গাছ থেকে একটি নলের সাহায্যে একসঙ্গে এক জায়গায় রস আদায় করে সেইখানে জাল দিয়ে সহজে চিনি করা যেতে পারে সেই চেষ্টায় তিনি অনেকদিন কাটালেন , শুনেছি উপায় খুব সুন্দর উদ্ভাবনও হয়েছিল । চাষের কাজেও নানারকম পরীক্ষা করে তিনি যেসব ফসল ফলিয়েছিলেন সে অতি আশ্চর্য । তার মনে হয়েছিল আমাদের দেশে বড় বড় কারবার যে সম্পন্ন হয়না তার প্রধান কারণ আমাদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক নেই । একটা ছোট গোছের ব্যাঙ্কও তার প্রজাদের জন্য খুলেছিলেন তিনি " ।  প্রথম পরিচ্ছেদে বিমলার এই বিবরণের মধ্যে দিয়েই নিখিলেশ চরিত্রটির কাজভিত্তিক ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক স্বদেশীভাবনার গভীরে প্রবেশ করা যায় , যা উপন্যাসের পরবর্তীতে সন্দীপের ভাষণ ও নিছক রাজনীতিভিত্তিক স্বদেশীর থেকে নিখিলেশ চরিত্রটিকে নির্দিষ্ট বিন্দুতে পৃথক করতে পাঠককে সাহায্য করে । .... সত্যজিৎ রায় তার চলচ্চিত্রে অর্ধেকেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে  মাস্টারমশাই চন্দ্রনাথবাবুর কথনে নিখিলেশের এই নিজস্ব স্বদেশী কর্মকাণ্ড সরাসরি সন্দীপের সামনে এনে সন্দীপের বাকসর্বস্ব স্বার্থসর্বস্ব স্বদেশীর অসারতা বুঝিয়ে দেন রীতিমতো চ্যালেঞ্জের ভঙ্গীতে , যা সিনেমাটিক আবহাওয়ায় দুই চরিত্রের ভাবনামূলক দ্বন্দ্ব তৈরি করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট এফেক্টিভ একটি সিক্যুয়েন্স । - " আপনি এই লোকটি সম্পর্কে কিছু জানেন ? কিচ্ছু জানেন না । আপনি ওর স্বদেশী ব্যাঙ্কের কথা জানেন ? জানেন ওর স্বদেশী চিনির কল সাবানের ফ্যাক্টরির কথা ? এসব করতে ওর আপনাদের মতো কোনো " বন্দেমাতরম " মন্ত্রের কোনদিন দরকার পড়েনি"। 

পার্থক্য : ২ ) সাহিত্য ' ঘরে বাইরে ' তে আধুনিক চিন্তাভাবনাসম্পন্ন প্রগতিশীল নিখিলেশ ( ছবিতে  ভিক্টর ব্যানার্জি )  স্ত্রীকে নিছক অন্তঃপুরবাসিনী হিসেবে দেখতে না চেয়ে ইংরেজী আদবকায়দা ও শিক্ষায় শিক্ষিত করে বিংশ শতাব্দীর উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য তার শিক্ষক ও সঙ্গিনী হিসেবে মিস.গিলবি কে নিযুক্ত করেন । এটুকুই মিস.গিলবির পরিচয়  । এই পরিচয়ে সে' যুগের নারীর ইংরেজী কায়দা শেখার সবটুকু পর্দা বোধ'য় পাঠকের চোখের সামনে থেকে সরে যায় না । .... সত্যজিৎকৃত সেলুলয়েড মিস.গিলবির মধ্যে দিয়ে ( অভিনয়ে জেনিফার কেণ্ডেল ) দর্শকের সামনে তৎকালীন যুগে এক অভিজাত রক্ষণশীল পরিবারের গৃহবধূর ইংরেজী আদবকায়দা শিক্ষণ বলতে সঠিক কী বোঝায় তার পরিপূর্ণ একটি বোধ অসাধারণ নান্দনিকতায় হাজির করায় । পিয়ানোয় মিস.গিলবি ও পাশে দাঁড়ানো বিমলার ( অভিনয়ে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ) সেই যৌথ ইংরেজী সঙ্গীতের দৃশ্য কোনদিনই ভুলতে পারবেন না দর্শক । 

         " Tell me the tales 

                      that to me were so dear 

            long long ago 

            long long ago . 

            Sing me the songs 

                      I delighted to hear 

             long long ago 

              long ago " . 

  পার্থক্য: ৩ )  " ঘরে বাইরে " উপন্যাস ও চলচ্চিত্র উভয়ক্ষেত্রেই একটি অন্যতম পার্শ্বচরিত্র ' অমূল্য ' । অথচ সাহিত্যে অমূল্যর ঠিক যতখানি ভূমিকা , সত্যজিতের সেলুলয়েডে তা বহুগুণে কাটছাঁট । বিমলার দেওয়া গিনির বাক্স নেওয়া উচিত না ফেরত দেওয়া উচিত তা নিয়ে সাহিত্যে সন্দীপ ও অমূল্যর যথেষ্ট বাদানুবাদ দেখতে পান পাঠক । ফিল্মে এমন কোনো দৃশ্যের অস্তিত্ব নেই । শুধুমাত্র সৎ একনিষ্ঠ কিছুটা যৌবনসুলভ অন্ধবিশ্বাসে ' বন্দেমাতরম ' মন্ত্রে আকৃষ্ট হয়ে তাকে সন্দীপের সহকারী হিসেবে থাকতে দেখা যায় । বিমলার গিনির বাক্স, পাঁচ হাজার টাকা ইত্যাদি সন্দীপের গ্রহণ করার সময় তার প্রতিবাদ আছে ঠিকই কিন্তু তা অনেক মৃদু বহুগুণে হালকা । রূপালী পর্দায় অতিভাষী অমূল্য হয়ত বা তিন প্রধান চরিত্র থেকে দর্শককে কিছুটা সরিয়ে দিতে পারত , তাই কি বিশ্ববন্দিত পরিচালকের এই সতর্কতা ? ... প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য - রবীন্দ্র গল্পের বাইরে গিয়ে বিভিন্নভাবে প্রধানতঃ তিনটি মুখ কে মুখ্য করতে চাওয়া ফিল্ম হিসেবে " ঘরে বাইরে " র অন্যতম ত্রুটি বলে কিন্তু  বহু আলোচক বহু সময়ে মত প্রকাশ করেছেন । মাত্র বছর চারেক আগেও সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে fweekend অনলাইন পত্রিকার সম্পাদকীয়তে এই প্রসঙ্গে আলোচনায় কি লেখা হয়েছিল তা সরাসরি কোট করার প্রয়োজন অনুভব করছি । - " The greatest strength of Ghare Baire is Tagore's story . The biggest weakness of Ray's film is the execution of that . While Tagore weaves a beautiful tale of love , companionship , deceit and freedom against the backdrop of the nationalist movement after Lord Curzon's partition of Bengal , Ray just stretches the story while unconvincing portrayals of its main faces , the trio of characters " . 

   পার্থক্য : ৪ ) " বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমনই শক্তিমান / তুমি কি এমনি শক্তিমান ? " ..... , " চল রে চল সবে ভারতসন্তান / মাতৃভূমি করে আহ্বান " .... , " বুঝতে নারি নারী কি চায় ? / কি চায় গো ? " .... এই সঙ্গীত ও সঙ্গীতাংশগুলি সত্যজিৎবাবু তার ফিল্মে রেখেছেন সন্দীপের লিপে । ... রবীন্দ্রসাহিত্যে সন্দীপের সঙ্গীতের কথা এইরকম : 

     ১ )       " আমার ঘর বলে তুই কোথায় যাবি  , 

                           বাইরে গিয়ে সব খোয়াবি । 

               আমার প্রাণ বলে তোর যা আছে সব 

                           যাক না উড়ে পুড়ে " । 

      ২ )   " ওগো আপন যারা কাছে টানে 

                            এ' রস তারা কেই বা জানে - 

                 আমার বাঁকা পথের বাঁকা সে যে 

                             ডাক দিয়েছে দূরে । 

                  এবার বাঁকার টানে সোজার বোঝা 

                              পড়ুক ভেঙেচুরে " । 

     ৩ )  " যখন দেখা দাওনি রাধা, 

               তখন বেজেছিল বাঁশি

               এখন চোখে চোখে চেয়ে 

               সুর যে আমার গেল ভাসি । 

               তখন নানা তানের ছলে 

               ডাক ফিরেছে জলে স্থলে , 

               এখন আমার সকল কাঁদা 

                রাধার রূপে উঠল হাসি " । 

চলচ্চিত্র ও সাহিত্য দুই ক্ষেত্রেই সন্দীপের এই সঙ্গীত নিঃসন্দেহে  বিমলাকে আকৃষ্ট করার জন্য । এমনকি সত্যজিৎবাবু তার ফিল্মে এই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু তৈরি করার জন্য নেপথ্যগায়ক হিসেবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রোম্যান্টিক কন্ঠস্বর খালি গলার কিশোরকুমারের কন্ঠ পছন্দ করেন । তবে ফিল্মে বিমলার ভালোলাগা পেলেও ( " আপনি রাজনীতিতে না এসে মন দিয়ে গানটাই গাইলে পারতেন "  ) , সাহিত্যে বিমলার সেভাবে ভালোলাগা পেতে সন্দীপসঙ্গীত কিন্তু ব্যর্থ ( " .... এই বলে সন্দীপ তার ভাঙা মোটা গলায় গান ধরলেন ... " -- বিমলার আত্মকথন ) । সন্দীপের গলা সম্পর্কে বলা বিমলার এই দুটি বিশেষণেই যথেষ্টভাবে তার অনাকর্ষণ ফুটে ওঠে । 

   কত বলবো ? সেই দার্শনিক পিয়ার্স সাহেবের মতের sign আর icon এর পার্থক্য । এই তফাৎ  অজস্র ! 

  পার্থক্য : ৫ ) চলচ্চিত্রে সন্দীপ ও বিমলার  বিখ্যাত চুম্বনদৃশ্য । সাহিত্যে সন্দীপের আত্মকথনে যা ঘটার হলেও আটকে গেছিল কোথাও । - " আমি বিমলার হাত চেপে ধরলুম , আমার দেহবীণার ছোট বড় সমস্ত তার ভিতর ভিতর ঝংকার দিয়ে উঠল । কিন্তু স্থায়ীতেই থেমে গেল কেন ? কেন অন্তরা পর্যন্ত পৌঁছাল না ? বুঝতে পারলুম , জীবনের স্রোতঃপথের গভীরতম তলাটা বহুকালের গতি দিয়ে তৈরি হয়ে গ্যাছে ; ইচ্ছার বন্যা যখন প্রবল হয় , তখন সেই তলার পথ ভাঙে আবার কোথাও এসে ঠেকে যায় " । ... ফিল্মে এই চুম্বন হয়ত আকর্ষণী তীব্রতা প্রকাশে সময়ের বিবর্তন । ভুললে চলবে না সাহিত্য " ঘরে বাইরে " র প্রথম প্রকাশ সাল ১৯১৫ , চলচ্চিত্র ১৯৮৪ । কিংবা হয়ত এই চুম্বন চলচ্চিত্র মাধ্যমে চরিত্রের আন্তর্জাতিকীকরণ । এও ভুললে চলবে না , নষ্টনীড়ের স্পর্শহীন রোম্যান্টিকতার অমল-চারুলতা সত্যজিৎ চলচ্চিত্রে এসে চারুর অমলের মুখে পান গুঁজে দিয়ে  তার বুকে মাথা রাখা পর্যন্ত এগিয়েছিল । যে দৃশ্য সম্পর্কে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক সেবাব্রত গুপ্ত " দ্য স্টেটসম্যান " এ আলোচনা করতে গিয়ে কারণ হিসেবে ফিল্মকে ' সম্ভবতঃ  আরো বেশি আন্তর্জাতিক করে তোলার প্রচেষ্টা' র কথা বলেন । 

পার্থক্য  : ৬ ) সাহিত্য " ঘরে বাইরে " তে বিমলার আত্মকথনে সন্দীপের কাছ থেকে সরে আসার মুহূর্তে বিমলা সন্দীপকে মানসিকভাবে তীব্র আঘাত করতে চায় । তার ভাবনায় তখন সন্দীপ একজন মন্ত্র ব্যবসায়ী । " বন্দেমাতরম " মন্ত্র । মন্ত্রের প্রভাব যে মুহূর্তে খাটে না , সেই মুহূর্তে সন্দীপের আর কোন জোর নেই । তাকে কথা বলার জন্য খাতা দেখে আসতে বলে মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করে বিমলা । সন্দীপের আকর্ষণী আগুনে পতঙ্গের মত পুড়লেও সাহিত্যে বিমলা প্রথম থেকে শেষ " সন্দীপ " নামক ব্যক্তিত্বটির ভেতর দিয়ে নিজেকে অতিবাহিত করেছে তার দেশপ্রেমের সততা সম্পর্কে হালকা সন্দেহের একটা দোদুল্যমানতা বজায় রেখেই । ... চলচ্চিত্রের পরিসর সর্বদাই সাহিত্যের তুলনায় স্বল্প । চলচ্চিত্রে সন্দীপের কাছ থেকে বিমলার সরে আসা এক মুহূর্তের ছোট্ট একটা সংলাপে । যে সংলাপে আঘাতের চেয়েও লুকিয়ে আছে শ্লেষের তীব্রতা । - " সুর কেটে গ্যাছে সন্দীপবাবু । আমার স্বামী বলেছিলেন আপনাকে অল্প জানলে ভালো লাগে , আমি বোধ'য় একটু বেশিই জেনে ফেলেছি " । এই শ্লেষ দর্শকমনে একটু আগের দৃশ্যে আকর্ষণের তীব্রতায় সন্দীপ ও তার মক্ষিরানী বিমলার নিবিড় চুম্বনকে এক লহমায় ভুলিয়ে বিমলাকে পরিপূর্ণভাবে সন্দীপের থেকে নিশ্চিত বার করে নিয়ে আসতে সাহায্য করে । 

               *               *            *             * 

   " যেটুকু আমার ভাগে এসে পড়েছে সেইটুকুই আমার , এ'কথা অক্ষমেরা বলে , দূর্বলেরা শোনে । যা আমি কেড়ে নিতে পারি সেইটেই যথার্থ আমার , এই হল জগতের শিক্ষা । দেশে আপনা-আপনি জন্মেছি বলেই দেশ আমার নয় - দেশকে যেদিন লুঠ করে নিয়ে জোর করে আমার করতে পারব সেই দিনই দেশ আমার হবে । যারা কাড়তে জানে না ধরতে পারে না , একটুতেই যাদের মুঠো আলগা হয়ে যায়, পৃথিবীতে সেই আধমরা একদল লোক আছে , নীতি সেই বেচারাদের সান্ত্বনা দিক । প্রকৃতির বরপুত্র তারাই যারা সমস্ত মন দিয়ে চাইতে পারে , সমস্ত প্রাণ দিয়ে ভোগ করতে জানে , তাদের জন্যই প্রকৃতি যা কিছু সুন্দর তা সাজিয়ে রেখেছে । তারা নদী সাঁতরে আসবে , পাঁচিল ডিঙিয়ে পড়বে , দরজা লাথিয়ে ভাঙবে , পাবার যোগ্য জিনিস ছিনিয়ে কেড়ে নিয়ে চলে যাবে । এতেই যথার্থ আনন্দ , এতেই দামী জিনিসের দাম । প্রকৃতি আত্মসমর্পণ করবে সে দস্যুর কাছে " । .... ঘরে বাইরে উপন্যাসে সন্দীপের আত্মকথার একেবারে সূচনাংশ , যার প্রথমাংশটুকু কোনোরকম পরিবর্তন ছাড়াই সত্যজিৎবাবু ব্যবহার করেছেন ফিল্মে । ফিল্মেও এটি সন্দীপের আত্মকথন । মুখে বলা সংলাপ নয় । সৌমেন্দু রায়ের ক্যামেরা ক্লোজআপে ধরে আবছা আলো আঁধারির মায়াময় সন্দীপ তথা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একমুখ দাড়িভর্তি মুখ । ব্যাকগ্রাউন্ডে বিলিতি জিনিস পোড়ানোর দাউদাউ আগুন , সঙ্গে মাদল বাজার স্টাইলে অদ্ভূত দ্রিমি দ্রিমি আবহসঙ্গীতের হাত ধরে পেছন পেছন টিপিক্যাল সত্যজিৎ ঘরানার সেই অনবদ্য প্রাচ্যপাশ্চাত্য স্টাইল মিশ্রিত সুরধ্বনি । অসাধারণ ফিল্মি পিকচারাইজেশনে সন্দীপমুখের মুখোশ উন্মোচন ।  দর্শকের সামনে স্পষ্ট মুখ । 

     উপন্যাস ও ছায়াছবির শেষপ্রান্ত । দাঙ্গার খবর পেয়ে নিখিলেশের কর্তব্যপরায়ণ মন যখন তাকে বিমলার সমস্ত বারণ অগ্রাহ্য করে ঘোড়া ছুটিয়ে দাঙ্গা থামানোর জন্য যেতে বাধ্য করায় , তখন মেজঠাকুরানীর ছুটে এসে বিমলাকে বলা হাহাকারসর্বস্ব রবীন্দ্র সংলাপটুকু অবিকৃত অবস্থায় সত্যজিৎ রায় ব্যবহার করেছেন তার ছবিতে । -- " ছুটু , কী সর্বনাশ করলি ! ঠাকুরপোকে যেতে দিলি কেন ? ... রাক্ষুসী ! সর্বনাশী ! নিজে মরলি নে , ঠাকুরপো কে মরতে পাঠালি ? " 

দিনের আলো শেষ হয়ে  সূর্যাস্তের প্রতিটি রেখা বিমলা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল সেদিন । রবীন্দ্রবর্ণনায় সামনের রাস্তা , গ্রাম , দূরের শস্যহীনমাঠ এবং তারও শেষপ্রান্তে গাছের রেখা ঝাপসা হয়ে আসে । মাঝে মাঝে রাস্তার ধারের কালো গাছের সারির নীচ দিয়ে আলো দেখতে পায় বিমলা । কেবলই মনে হতে থাকে তার তিনি মরলেই সব বিপদ কেটে যাবে । যতক্ষণ বেঁচে আছেন সংসারকে তার পাপ নানা দিক দিয়ে মারতে থাকবে । .... একই পটভূমিকায় রবীন্দ্রউপন্যাসের সত্তর বছর পরে ধ্রুপদী চলচ্চিত্রে কান্না ও হতাশার অভিব্যক্তিতে বিমলা তার মুখের ওপর থেকে হাতটি সরায় । দ্রুত তান ও লয়ের আবহসঙ্গীতে জানলার বাইরে অজস্র জ্বলন্ত মশাল । একটি জোরালো ফায়ারিং এর শব্দ । অতঃপর অজগর সাপের মতো মিছিলটি জানলা দিয়ে দৃশ্যমান । আবহসঙ্গীত পাল্টে যায় , আসে ধীর লয়ের সেতারে ভারতীয় রাগাশ্রয়ী শোকসঙ্গীত । এক লহমায় পাল্টে যায় বিমলার পোশাক । উধাও রঙীন বস্ত্র রঙীন টিপ । তার জায়গা নেয় সাদা শাড়ির বৈধব্য পোশাক । বাজতেই থাকে শোকসঙ্গীতের সুর । ঘরে .. বাইরে..  ফের ঘরে। 

  " Whenever in a film there is tragic situation and jerk a few tears at the ending , there should always be some room for improvisation for the viewers " - সত্যজিৎ রায়ের নিজেরই মত যদি ছবির শেষ বিয়োগান্ত হয় । আর সত্যজিৎ ছবির দর্শকমাত্রই জানেন ,  এই ইম্প্রোভাইজেশান সৃষ্টি ও তার প্রতীক নির্মাণেই সত্যজিৎ রায় সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বশ্রেষ্ঠ । তার ইম্প্রোভাইজেশান তৈরি করার পদ্ধতি ডায়ালগসর্বস্ব নয় । ' ঘরে বাইরে ' উপন্যাসের শেষপ্রান্তে রবীন্দ্রনাথ তার লেখনীতে পরিপূর্ণভাবে বিমলার অনুভূতি এনে স্পষ্ট বুঝিয়েছেন আদর্শবাদ ও স্বদেশীয়ানার দ্বন্দ্ব , দেশনেতার চরিত্র বিশ্লেষণ এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে " ঘরে বাইরে " আসলে বিমলার গল্প । সেই যুগে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বাইরে পা দেওয়া এক নারীর গল্প । সত্যজিৎ রায় তার ছবির শেষাংশে এসে যা বুঝিয়েছেন নিখিলেশের মৃত্যু ও  সঙ্গে সঙ্গে এক মুহূর্তের ওই সধবা থেকে বিধবার পোশাকে পরিবর্তন আনার মধ্যে দিয়ে । এই হল ইম্প্রোভাইজেশান , সেলুলয়েডকে যা বিশিষ্ট করে , প্রকৃত অর্থে  ফুটিয়ে তুলতে পারে এমন অসাধারণ  রবীন্দ্রসাহিত্যকে ।    

                              " ঘরে বাইরে " প্রসঙ্গে দুই মহান শিল্পীব্যক্তিত্বের স্ব স্ব ক্ষেত্রে  শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েও একটি কথা তো শেষপর্যন্ত  মানতেই হয় । " ঘরে বাইরে " র স্রষ্টা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ , সত্যজিৎ রায় নয় । রবীন্দ্রনাথের দিব্যদৃষ্টিতে সেই সময়ের বিমলা নিখিলেশ সন্দীপ , রবীন্দ্রভাবনায় অন্তঃপুরবাসিনীর বহির্জগতকে চেনা , সমাজ রাজনীতি মানুষ চিনতে পারা , রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবোধ , রবীন্দ্র দৃষ্টিভঙ্গীতে নীতি ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব সংঘাত । সত্যজিৎ রায় এই অতুলনীয় সাহিত্যকীর্তিকে শুধু তার মতো করে ধরেছেন নিজস্ব শিল্পমাধ্যমের ক্যানভাসে , যে ক্যানভাস পনেরো রীল সেলুলয়েড ফিল্ম । আর অতুলনীয় শিল্পকীর্তির সে ফিল্মে ১৯৮৪ পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে গোটা পৃথিবীর মানুষ দেখেছে স্বদেশী আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস , স্পষ্টভাবে বুঝেছে বঙ্গদেশে দাঙ্গার প্রকৃত উৎসবিন্দু , দেখেছে নিখিলেশ সন্দীপ , আর সর্বোপরি দেখেছে বুঝেছে বিমলাকে , তৎকালীন থেকে চিরকালীন প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য  ঘরে ও বাইরে শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত নারীহৃদয়ের প্রতিটি গ্রহণ ও বর্জনের  কোণকে । " ঘরে বাইরে " কালিকলম ও সেলুলয়েড উভয় মাধ্যমেই দুই শ্রেষ্ঠ শিল্পীমানুষের অন্তর্দৃষ্টির চূড়ান্ত সাক্ষ্য বহনকারী কীর্তি ।  দুই কীর্তিরই উজ্জ্বলতা  সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে মাঝেমাঝে দৃশ্যমান  পৃথিবীর খুব কাছাকাছি থাকা  ঝকঝকে শুক্রগ্রহর মতো , নিছক আরেকটি নামে যা " শুকতারা " । 

                           ........................

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...