শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২২

১ মে বারাকপুর স্টেশন পত্রিকার বিশেষ নিবেদন

    ভ্যাকুলিঞ্চুক 

    সজ্জ্বল দত্ত   



   " Our resistance will be long and painful but whatever the sacrifices , however long the struggle , we shall fight to the end " . 


          ১৯১৮র ফেব্রুয়ারীর এক সকাল । মাত্র একবছর আগে আর এক ফেব্রুয়ারীতে চার দিনের গণ অভ্যুত্থানে অত্যাচারী জারের সাম্রাজ্যের পতন হয়ে গোটা রুশদেশে তখন মুক্তির হাওয়া । বাতাস জুড়ে সাধারণ শ্রমিক কৃষক মেহনতী রুশনাগরিকদের উল্লাসের সুর । চতুর্দিকে পতপত করে উড়ছে লাল পতাকা । মাঝের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিনিধিদের হত্যা করে বলশেভিক কর্মীরা সবে দখল নিয়েছেন সেন্ট পিটার্সবার্গ উইন্টার প্যালেসের । .... পেত্রোগাদ ইনস্টিটিউট অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের  বাইরে এসে দাঁড়ালেন আগুনময় চোখ আর রক্ত-মায়ায় মাখামাখি হৃদয়ের এক তরুণ । কলেজের দিকে পিছু ফিরে তাকালেন একবার , তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে । কাঁধে আধময়লা পুরোনো ব্যাগ , পিছনে ধীরে ধীরে আবছা হচ্ছে সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য নির্ধারিত পিতার প্রিয় বিষয় স্থাপত্য ও প্রকৌশল বিভাগের বাড়িটি । 
    মস্কো যাবেন । কথা হয়েছে বুখারিনের সঙ্গে । বুখারিন এবং টমস্কি দু'জনেই থাকবেন । নিয়মিত লিখবেন তিনি প্রাভদায় তার প্রিয় বিষয় থিয়েটার নিয়ে । বুখারিন বলেছেন দেখা করিয়ে দেবেন মহামতি লেনিনের সঙ্গেও । ... ব্যাগ কাঁধে এগিয়ে চলেছেন চোয়ালশক্ত তরুণ । ভেতর কাঁপছে অদ্ভূত উত্তেজনায় । ছোট থেকেই যে স্বপ্ন সযত্নে লালন করে এসেছেন , সামনেই দু'একদিনের মধ্যে তা সত্যি হতে চলেছে । রেড আর্মির প্রাথমিক সদস্য হচ্ছেন তিনি । চলবে লেখা , বিভিন্ন থিয়েটারের ডিজাইন করা , সঙ্গে থাকবে দলের জন্য স্বেচ্ছাশ্রম । 

.... কাট্ ....

    ফোরেগার্স থিয়েটারে নিজের চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগের সঙ্গে ডিজাইনিংয়ের কাজে ব্যস্ত সেই তরুণ । রেড আর্মি র ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব থেকে কিছুদিন আগেই মিলেছে অব্যহতি । দু'বছর কাজ করতে করতে ফৌজের মধ্যেই এক শখের নাটকের দল তৈরি করেছিলেন তিনি । নাটকে তার ভালোবাসা দেখে লাল ফৌজের কর্তারাই নাটকের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক শিল্প-সংস্কৃতির জগতে তাকে কাজে লাগানোর কথা ভাবেন । ... সেই আলো-অন্ধকারী সন্ধ্যায় মন ডুবিয়ে  নাটকের ডিজাইনিংয়ের কাজ করছিলেন যুবক । উল্টোদিকের চেয়ারে এসে বসলেন ভিচ মেয়রহোল্দ্ । কাজ থামিয়ে তরুণ ডিজাইনার ছেলেটি জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে । রাশিয়ার শিল্প-সংস্কৃতি-নাটক-অভিনয় জগতে মেয়রহোল্দ্ তখন এক অতিপরিচিত নাম । বিরাট পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছেন তিনি যে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাটক ও চলচ্চিত্রকে মতাদর্শগতভাবে ঠিক কতখানি কাজে লাগানো যায় । ডিজাইনার ছেলেটি মোটামুটি গুরুপদে বরণ করে নিয়েছেন তাকে । 
মেয়রহোল্দ্  : " শোনো সার্গেই , আমি সব ঠিক করে ফেলেছি । আগামীমাস থেকে আর এখানে নয় , তুমি প্রোলেৎকুল্ত থিয়েটারে কাজ করবে । নাটকে শ্রমিকশ্রেণীর জন্য সত্যিকারের কাজটা ওখানেই করার চেষ্টা হচ্ছে  এখন " । 
সার্গেই : " আপনি যখন বলছেন ' না ' করার উপায় আমার নেই । কিন্তু ওখানে কি ডিজাইনারের কাজের পাশাপাশি পরিচালনার কাজও কিছু কিছু করতে পারবো ? আপনি তো জানেন , পরিচালনায় আসা আমার বহুদিনের স্বপ্ন " । 
মেয়রহোল্দ্ : " বললাম তো , সব ঠিক হয়ে গেছে । এ'বছরই জ্যাক লণ্ডনের " দ্য মেক্সিকান " গল্পটা নাটক হয়ে মঞ্চে আসবে । গোটা রাশিয়ায় বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এটাই হবে শ্রমিকদের জন্য তৈরি করা প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক । তুমি এর ডিজাইনিংয়ের কাজ তো করবেই সঙ্গে তোমার দায়িত্ব থাকবে যৌথ পরিচালনার । সবাই মিলে ঠিকঠাক ভাবে যদি করতে পারো তো ভাবছি মস্কোরই সেন্ট্রাল অ্যারেনায় ওটা দেখানোর ব্যবস্থা করবো । সঙ্গে সামনের বছরের জন্য ভেবে রেখেছি " কিং হাঙ্গার " । এটায় তুমি শুধু ডিজাইনিংই কোরো । ... আমার পরপর প্ল্যান আছে , সার্গেই । কিং হাঙ্গারের পর করবো " অ্যা ডলস্ হাউস " । ওখানেও তোমাকে বড়সড় কোনো কাজে পেতে চাই । ... যাইহোক , এখন চলো , উঠে পড়ো ।  একটু বেরোও তো আমার সঙ্গে , দেখি । দরকার আছে " । 

... কাট্ ...

তিন বছর পর । ১৯২৩ এর মার্চ । ততদিনে যুবকটি থিয়েটার জগতে অনেকখানি পরিচিত । সমবয়সী থিয়েটারবন্ধুরা তাকে সার্গেই নামে ডাকলেও রাশিয়ায় তখনকার পদবী ধরে ডাকার চল অনুযায়ী বেশিরভাগই ডাকেন " আইজেনস্টাইন " । তার ডিজাইনিংয়ে এবং সম্পূর্ণ একক পরিচালনায় প্রথম নাটক " এনাফ সিমপ্লিসিটি ইন এভরি ওয়াইজ্ ম্যান " এর শেষ পর্যায়ের মঞ্চ রিহার্সাল চলছে । কিছুদিনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে অস্ট্রোভস্কির লেখা এই নাটক । একটা চরিত্রে অভিনয় করা গ্রেগরী ভাসিলিয়েভিচ আলেকজান্দ্রভ প্রথম থেকেই চোখ টেনেছে তার । সামান্য নড়াচড়ায় কী অদ্ভূত চরিত্র ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা ! একদম জাত শিল্পী লোকটা । দু'জনের মধ্যে এখন বেশ বন্ধুত্ব । কয়েকটা দৃশ্যের পরিচালনায় তাকে এমন দু'একখানা টিপস্ দিয়েছে ও , যে একেবারে মুগ্ধ আইজেনস্টাইন । ... রিহার্সালের অবসরে কথা বলছিলেন দু'জন । 
আলেকজান্দ্রভ : " আচ্ছা সার্গেই , এমন গভীর এমন অসাধারণ আপনার দৃশ্যকল্পের ভাবনা , আপনি সিনেমা পরিচালনা করার কথা চিন্তা করছেন না কেন ? 
আইজেনস্টাইন : " সিনেমা ? ওতে যে সংলাপ থাকবে না বন্ধু আলেকজান্দ্রভ ! আর সংলাপের বদলে ওই নীচ দিয়ে লিখে দেওয়া কথা ? ওতে দৃশ্য ফোটাতে যারা পারে আমি তাদের দূর থেকে প্রণাম করি । আমার দ্বারা  বোধহয় হবে না ও' কাজ । 
আলেকজান্দ্রভ : এই কথা বলছেন তো ? প্রথম যে কোনো কাজ করতেই এরকম দ্বিধা আসে । আপনার এই নাটকে যে কুড়ি মিনিটের চলমান ছবি আপনি তুললেন , যেটা আপনি বলছেন নাটকের ভেতরে  যুক্ত করা আপনার এক নতুন পরীক্ষা , সেই ছবি তোলাটা আমি লক্ষ্য করছিলাম । আমি বলছি আপনি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভাবুন । আমার ধারণা এই মর্মে রাশিয়া শুধু নয় , গোটা পৃথিবীকে সেরার সেরা কাজ উপহার দেবে আপনার প্রতিভা । আমি আপনাকে সাহায্য করবো সার্গেই , আপনি খুব গভীরভাবে চিন্তা করুন কথাটা " । 
আইজেনস্টাইন : " আচ্ছা । আপনি বললেন , আমি নিশ্চয়ই ভেবে দেখব । এখন আসুন , রিহার্সাল শুরু করি আবার " । 

.... কাট্ .... 

১৯২৫  আটই ফেব্রুয়ারী , গভীর রাত্রি । ঠিক এক সপ্তাহ আগে মুক্তি পেয়েছে সার্গেই আইজেনস্টাইন পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র " স্ট্রাইক " । বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় সর্বহারা শ্রমিকের অধিকাররক্ষার শেষতম লড়াইয়ের ছবি । এক সপ্তাহের মধ্যেই খবর এসে গেছে । প্যারিসের " এক্সপোজিশিয়ঁ দেজ্ আর্ট দেকোরাতিফস্ " এর মতো সংস্থা পুরস্কৃত করতে চলেছে স্ট্রাইককে । জার্মানির এক প্রযোজক খবর পাঠিয়েছেন । বাণিজ্যিক ভিত্তিতে স্ট্রাইক সে দেশে দেখাতে চান তিনি । তবুও মনটা কেমন যেন খচখচ । আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের চলচ্চিত্রবোদ্ধা মহলের যা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ওখানে বোধহয় স্ট্রাইক আর দেখানো গেল না । ... এরপরের কাজ " ১৯০৫ " । জারের শাসনে ১৯০৫ সালে হওয়া নৌ-বিদ্রোহের গোটাটার চলচ্চিত্ররূপ দেওয়ার ভাবনা । তিন দিন দৃশ্যগ্রহণ হয়েছে এখনো অবধি । এবারেও একটা বড়সড় চরিত্রে আলেকজান্দ্রভ, সঙ্গে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব । চিত্রনাট্যের দায়িত্ব অনেকখানিই তার অত্যন্ত প্রিয় ন্যুনে আগাদঝানোভার ওপর । ক্যামেরা, চিত্রকলা ও আলোকচিত্রকর হিসেবে স্ট্রাইকেরই এডোয়ার্ড টিসের থেকে উপযুক্ত আর কে হতে পারে ? 
টক্ টক্ টক্ । দরজায় টোকা । ঘরে ঢুকলেন ন্যুনে । আর্মেনিয়ান এই ভদ্রমহিলা সন্ধ্যায় এসেছিলেন বাড়িতে । অতঃপর চিত্রনাট্যের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করতে করতে রাত হয়ে যাওয়ায় থেকে গেছেন । 
আইজেনস্টাইন : " কি ব্যাপার ন্যুনে , এত রাত্রে ? 
ন্যুনে ( সামান্য হেসে ) : " আমি জানতাম জেগে থাকবেনই আপনি । সার্গেই , একটা কথা আমার শুয়ে শুয়ে মনে হচ্ছিল খুব । " পোটেমকিন " জাহাজের যে দৃশ্যগুলো আপনি ওডেসায় আর সেবাস্তোপোলে তুলবেন বলে ভেবেছেন , আজ কুড়ি বছর পরে রাশিয়ায় জাহাজের ধরন যে একেবারেই পাল্টে গেছে , সার্গেই । কুড়ি বছর আগের ধরনের সে জাহাজ এখন নতুন বানাতে হলে তো অনেক খরচা বেড়ে যাবে ! এত টাকা কি আমাদের গসকিনো স্টুডিও দেবে ? 
" প্রযোজনা করতে চাইলে দিতে হবে বৈকি , নইলে দরকার হলে অন্য প্রযোজক খুঁজব ! " -- গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন বটে আইজেনস্টাইন, কিন্তু মনটা একমুহূর্তে কেমন অন্যখাতে বইতে শুরু করলো কেন ? ... জাহাজ !... জাহাজ ! ... পোটেমকিন ? ... যুদ্ধজাহাজ পোটেমকিন ? ... কুড়ি বছর আগে প্রথম বিদ্রোহ ? ... ভেতরটা কী সাংঘাতিক কেঁপে উঠল হঠাৎ ! ... অস্থিরভাবে উঠে দাঁড়ালেন । -- " ন্যুনে , আপনি ঘরে যান । অনেক রাত হয়েছে । শুয়ে পড়ুন । আমি কাল সকালে এটা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করবো " । 
ন্যুনে চলে গেলে দরজা বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে দিলেন আইজেনস্টাইন । দশ মিনিট ... কুড়ি মিনিট ... আধঘন্টা ... একঘন্টা ! ...আর একটু পরেই ভোর হবে । ক'দিন আকাশে জোরালো মেঘ ছিল । কাল দিনের আলোয় কি মেঘযাপনের অবসান ? রাত ফুরোনোর স্পষ্ট ইঙ্গিত বাইরে । ... অন্ধকারে অস্থির পায়চারী করে চলেছেন আইজেনস্টাইন । সমুদ্রে ঢেউয়ের দুলুনিতে এদিক ওদিক দুলছে বিশালাকার এক যুদ্ধজাহাজ । টিসের ক্যামেরায় কখনো ক্লোজআপে পর্দাজুড়ে , কখনো লঙশটে ! লোকলস্কর নাবিক অফিসার যুদ্ধাস্ত্র ... চোখের সামনে প্রতিটির নড়াচড়া একেবারে পরিস্কার ! জ্যামিতিক রেখার বিন্দুগুলো ঝাপসা থেকে স্পষ্ট চেহারা নিয়ে ভাসতে ভাসতে কেমন স্থির হয়ে জাহাজ সেজে উঠল ! ... হৈ হৈ হঠাৎ! জোরালো বিউগল ! কামানের গর্জন ! ... চতুর্দিকে চিৎকার ! ' জ্যাখভ্যাতিবাদ জ্যাখভ্যাতিবাদ ( দখল দখল ) ! ' ... প্রেক্ষাগৃহভর্তি দর্শকের চোখে সাদা-কালো ছবিতে পর্দায় লালের প্রতিলিপি , হালকা ছাই-ছাই ধরনের কালো ! ... ভোর হল বোধ'য় । ঘরের বাইরে বরফে ঢাকা পাইনগাছে বসে রেডস্টার্ট পাখিটা তার প্রতিদিন সকালের গান গেয়ে উঠল !
বাতি জ্বেলে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন আইজেনস্টাইন । খোলা পড়ে আছে খাতায় লেখা " ১৯০৫ " এর চিত্রনাট্য । দ্রুত উল্টে বার করলেন দৃশ্যগ্রহণের খসড়া লেখা সেই বিশেষ পাতাটা । বড় বড় করে পাতায় শিরোনাম লেখা : দৃশ্যগ্রহণ ১০৬ - " ব্যাটলশিপ পোটেমকিন " । 

                        *               *              *            *      




                       ★ The Men and the Maggots 
                           ...................................................

আসুন পাঠক , দর্শক হই । একসঙ্গে শুরু করি ছবি দেখা । প্রেক্ষাগৃহের আলো নিভল । সামনের বড় পর্দায় নাম ইত্যাদি দেখানো পর্ব শেষ হতেই উত্তাল সমুদ্রে পাথরের গায়ে ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দৃশ্য । এডোয়ার্ড টিসের ক্যামেরা একেবারে স্বাভাবিক শট্ এ অন্ততঃ সাত-আট সেকেণ্ড কোনোরকম কাট্ ছাড়াই স্থিরভাবে ধরে রেখেছে জলস্রোতের সেই উদ্দামতা। সমুদ্রের গতিবেগের সঙ্গে তাল রাখা এডমণ্ড মেইসেল এর বিবিধ তারের যন্ত্রসমন্বয়ে তৈরি দ্রুতগতির আবহসঙ্গীত যদি শৈল্পিকভাবে প্রথম দৃশ্যেই ছবিতে আমাদের পূর্ণমাত্রায় ঢুকিয়ে নেয় , তবে নিশ্চিত কন্টেন্টগতভাবে টেনে নেয় ঠিক তার পরের দৃশ্যে পর্দাজুড়ে ভেসে ওঠা " Revolution is war . Of all the wars known in history, it is the only Lawful , Rightful , just and truly great war ... . In Russia this war has been declared and begun "  ( LENIN - 1905 ) . 
 পাঁচ পর্বে বিভক্ত মোট একঘন্টা পনেরো মিনিটের ছবি " ব্যাটলশিপ পোটেমকিন " । দেখতে শুরু করেছি আমরা তার প্রথম পর্ব -"The Men and the Maggots"।
 ছবি এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে । নাবিক ম্যাতুশেঙ্কু এবং ভ্যাকুলিঞ্চুকের জাহাজের ডেকের একেবারে উঁচুতে, মাস্তুলের ঠিক নীচে দাঁড়িয়ে আলোচনা । - " আমরা আর কিছুতেই মেনে নেবো না , সমস্ত নাবিক ভাইদের সঙ্গে নিয়ে আমরা এবার ঘুরে দাঁড়াবোই " । 
  রাত্রে দোলনা ধরনের ছোট্ট ছোট্ট বিছানায় নিদ্রামগ্ন নাবিকদল । হাতে চেন ঘোরাতে ঘোরাতে আগমণ কম্যাণ্ডারের পাহারাদারের । উল্টো হয়ে শুয়ে থাকা একজনের পিঠে সপাটে চেনের আঘাত এবং সঙ্গে সঙ্গে সে নিমেষে সোজা । এই পর্বের আবহসঙ্গীত কিছুটা শ্লথ । কিন্তু এর পরে পরেই পাঠক-দর্শক , খেয়াল করেছেন হঠাৎ গতি বাড়িয়ে  কেমন পূর্ণগতিপ্রাপ্ত সঙ্গত শুরু হয়ে গেল তার ? ... পাহারাদার চলে গেলেই সেই শোবার জায়গায় দাঁড়িয়ে ভ্যাকুলিঞ্চুকের খালি গায়ে উত্তেজক বক্তৃতা, সাবটাইটেল অনুযায়ী যা : " ভাইসব , আমরা আর কতকাল ঘুমিয়ে থাকবো ? গোটা রাশিয়ার নিদ্রাভঙ্গ হয়ে গেল , আমরা কি সকলের শেষে জাগবো " ? নিমেষে টানটান হয়ে উঠে দাঁড়ালো সমস্ত নাবিক । 
 পরদিন সকালে প্রথম পচা মাংস খেতে দেওয়া নিয়ে  গোটা জাহাজে তীব্র প্রতিবাদ । পোকায় থিকথিক মাংস চশমার কাঁচ দিয়ে ভালো করে দেখে জাহাজের ডাক্তার স্মিরনভ্ রায় দিলেন " ওগুলো পোকা নয় , ' ম্যাগট্ ' , ভালো করে নুনজলে ধুয়ে নিলেই এ' মাংস দিব্যি খাওয়া যায় " ।...চরম প্রতিবাদ জাহাজের নাবিকদের। কোনোমতেই আমরা এই পচা মাংস খেতে রাজী নই ।  
একটা বিষয় খেয়াল করছেন পাঠক-দর্শক ? " The Men and the Maggots " পর্যায়ে আইজেনস্টাইনকৃত বিখ্যাত খণ্ডদৃশ্য একসঙ্গে জুড়ে গোটাদৃশ্য তৈরি করা ' মন্তাজ ' খুব উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা যাচ্ছে না । কিন্তু এই প্রথম পর্ব থেকেই আমরা দিব্যি অনুভব করতে পারছি টিসের অনবদ্য ক্যামেরাচলনের শিল্পগত কাজ , আলোর অসাধারণ ব্যবহার , সঙ্গে শ্লেষাত্মক প্রতীক নির্মাণে পরিচালকের চূড়ান্ত মুন্সিয়ানা । ডাক্তার স্মিরনভের চশমা খুলে আতসকাঁচের মত হাতে নিয়ে গম্ভীর ব্যবহার এবং তার মধ্যে দিয়ে পুরো বিষয়টিকে দেখা । নির্জীব মাংসখণ্ডের গায়ে সজীব পোকার নড়াচড়া দেখে ফের চশমা চোখে পড়ে রায় দেওয়া যে  মাংস অবশ্যই খাওয়ার যোগ্য-- এই দৃশ্যটি এই মর্মে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি দৃশ্য কিনা ? 
     এগোক ছবি । জাহাজের সিনিয়ার অফিসার গিলিয়ারভস্কিকে ঘিরে ধরে নাবিকদের তুমুল বিক্ষোভ ও ধ্বস্তাধস্তি । ভ্যাকলিঞ্চুকের সংলাপের সাবটাইটেল পড়ুন : " শুয়োর কিংবা কুত্তাও এই পচা মাংস খাবে না । জাপানে যুদ্ধবন্দী রাশিয়ানদের কপালেও এর চেয়ে ভালো খাবার জোটে " । ... তবু সেই মাংস জোর করে রান্না হল । ঘটনাবিন্যাস অনুযায়ী  ক্যান্টিন থেকে খেতে দেওয়ার সময় দলবদ্ধভাবে ভ্যাকুলিঞ্চুকের নেতৃত্বে সেই বয়েলড্ মাংসের স্যুপ নিশ্চিত প্রত্যাখ্যান করবে শ্রমিক-নাবিকরা । এবং যথারীতি ঘটলও তাই ।
  এই অংশে বিশেষ করে আলোকসম্পাতের কাজ এবং রূপকের ব্যবহার দর্শকরূপী পাঠক লক্ষ্য করুন । কুককে ওই মাংসই রান্না করতে হুকুম দেওয়ার সময় গোল গোল তারজালির ফাঁক দিয়ে কুকের গোটা মুখে এসে পড়া ছোট্ট ছোট্ট  গোল আলোআঁধারির অসাধারণ শক্তিশালী স্বতঃস্ফূর্ত শৈল্পিক ব্যবহার, কিভাবে বিপ্লবের জন্য আধাপ্রস্তুত মনকে চূড়ান্ত দক্ষতায়  সামনে আনল , লক্ষ্য করেছেন ? ... এর পেছন পেছনই আসে খাবার রাখার সমস্ত পাত্রগুলোর দোলনায় দোলার দৃশ্য । পাশে দুলুনির তালে তালে দুলতে থাকা গিলিয়ারভস্কির হাসিমুখ । ... বাইরে কিছু একটা ঘটলো । নিমেষে সে হাসিমুখের পটপরিবর্তন । আইজেনস্টাইনশিল্প অনুভব করতে হলে পাঠক-দর্শক , ভালো করে ' ব্যাটলশিপ ... ' এর সমস্ত চরিত্রের এই অতি দ্রুত এক্সপ্রেশন্  পরিবর্তনের  জায়গাগুলো কিন্তু খেয়াল করতেই হবে । 
  এবার শেষদৃশ্যে The Men and the Maggots । চরমভাবে শোষিত বঞ্চিত জাহাজ-নাবিকদের ভেতরে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুনের চূড়ান্ত বিস্ফোরণদৃশ্য । খালিপেটে প্লেট ধুতে ধুতে এক অল্পবয়স্ক নাবিকের চোখে পড়ে প্লেটের গায়ে খোদাই করা খৃষ্টান সম্প্রদায়ের প্রার্থনার একটি লাইন : ' Give us this day our daily bread ' । ক্যামেরা পূর্ণ ক্লোজআপে ধরে মুখ । লেখাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা চোখ যেন অগ্নিকুণ্ড । চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে ক্রমশঃ । অতঃপর যা অবধারিত, তাইই ঘটল ।  আছড়ে ভেঙে ফেলা হল প্লেট । নিমেষে বাদবাকি নাবিকদেরও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে ভাঙতে শুরু করল একের পর এক প্লেট । দাউদাউ করে শিখা ছড়াতে শুরু করলো বিদ্রোহের আগুন । ... গল্প এসে পড়লো পরের অংশে । কিন্তু সে অংশে যাওয়ার আগে কয়েকটি কথা । 

                              *           *          *           *

   যে ভোররাত্রে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে ' ১৯০৫ ' করবেন না , বদলে তারই একটা ছোট্ট অংশ ' ব্যাটলশিপ পোটেমকিন ' কে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রের রূপ দেবেন , সেই দিন থেকেই কি সন্দেহ তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল যে গোটা পৃথিবী এমন কী নিজের দেশ রাশিয়াও রাজনৈতিকভাবে এই চলচ্চিত্রকে কোন্ দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে গ্রহণ করবে ? ... ঘনিষ্ঠ সহপরিচালক ও অভিনেতা আলেকজান্দ্রভের কাছে দৃশ্যগ্রহণের সময়ই সন্দেহপ্রকাশ করেছিলেন একবার । কিন্তু তখন একটা অদ্ভূত ঘোরের মধ্যে দিয়ে একটা অন্যরকম স্পিরিটের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে গোটা কাজটা । 
    ছবি মুক্তি পাওয়া মাত্রই বাস্তবে ঠিক সেটাই ঘটল , ক্ষীণ সন্দেহ হিসেবে যেটা আগাগোড়া ছিল মনের মধ্যে । ১৯২৫ এর ডিসেম্বরে মস্কোর বলশয় থিয়েটারে প্রিমিয়ার শো এবং ১৯২৬ এর জানুয়ারিতে মুক্তি পেয়ে মাত্র দু'সপ্তাহের বাণিজ্যিক শো । ব্যস ! ... আইজেনস্টাইনের মাতৃভূমি বিপ্লবের মাতৃভূমি রাশিয়া তথা সোভিয়েতেই তালা পড়ল ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের দরজায় । লেনিনের মৃত্যু হয়েছে ততদিনে । ' ব্যাটলশিপ পোটেমকিন ' চলচ্চিত্রে তীব্র আপত্তি তুললেন তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি অফ্ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের তরুণ সাধারণ সম্পাদক জোসেফ স্ট্যালিন । তার বক্তব্যের মোদ্দা কথা ছিল কুড়ি বছর আগে ঘটে যাওয়া এই নৌ-বিদ্রোহ এখন ইতিহাস । নিজের দেশে বা বহির্বিশ্বে এত ঘটা করে এই  বিদ্রোহকথন এখন দেখানোর ব্যবস্থা করলে সদ্যক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির নিজ রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনায় বা গোটা বহির্বিশ্বে সোভিয়েতের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় নিশ্চিত বড়সড় সংকট তৈরি হবে । ... স্ট্যালিনের এই ভাবনা কার্যকর হওয়া মাত্র ক্ষোভে একেবারে ফেটে পড়ল যেন গোটা সোভিয়েত কবি-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী মহল ! সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদে সামিল হলেন খোদ স্ট্যালিনেরই অত্যন্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় কবি ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি । ছবিটি দেখার পর থেকেই মায়াকোভ্স্কির বরাবরের বক্তব্য এরকম : " এই ছবি শুধু যে সোভিয়েতেই নিঃশর্ত মুক্তি পাওয়া উচিত তাইই নয় , একইসঙ্গে সোভিয়েতেরই উচিত গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে এই ছবি পৌঁছে দেওয়া , দেখানোর ব্যবস্থা করা " । এ প্রসঙ্গে লেনিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কনস্ট্যানটিন্ শেভেদচিকভ্ এর সঙ্গে মায়াকোভ্স্কির এক কথোপকথনে মায়াকোভ্স্কির সেই বিখ্যাত উক্তি আজ প্রবাদপ্রতিম : " Shevedchikovs come and go , but art remains . Remember that " ! পরবর্তীতে শেভেদচিকভই স্ট্যালিনকে বুঝিয়ে ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের সোভিয়েতে মুক্তির ব্যবস্থাই শুধু করেন , তাইই নয় , নাৎসী অধ্যুষিত বার্লিনেও ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা করে দেন । 
   এপ্রিল ১৯২৬ এ বার্লিনে প্রিমিয়ার শো দেখার পর অত্যন্ত উষ্ণতায় এই ছবি গ্রহণ করল জার্মান চলচ্চিত্রমোদীরা । কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এল দুঃসংবাদ । ছবিটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে গোটা জার্মানিতে । পরবর্তী সময়ে ঘটনাক্রম জেনে ছবিটি দেখতে উৎসাহ প্রকাশ করলেন নাৎসী প্রচারমন্ত্রী গোয়েবেলস্ । ... অদ্ভূত ব্যাপার ! ছবিটি দেখে নিজ বিশ্বাস ও দলীয় নীতির একেবারে একশো আশি ডিগ্রী উল্টোদিকের মতপ্রকাশ করলেন তিনি । : " a marvelous film without any equal in the world . Anyone who had no firm political conviction could become a Bolshevik after seeing this film " । ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মহলে ব্যাটলশিপ পোটেমকিন এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গোয়েবেলস্ বলেন ' এমন একটা ছবি কি কোনো জার্মান পরিচালক বানাতে পারে না , যা দেখলেই এরকম স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ নাৎসীবাদে আকৃষ্ট হবে ? ' ...  ফলতঃ জার্মান সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন । : " দেখানো যেতে পারে, কিন্তু অনেকগুলো দৃশ্য কাটছাঁট করে " । মোট চোদ্দোশো গজের সেলুলয়েড রীলের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাদ গেল প্রায় একশো গজ । জার্মানির মানুষ দেখতে পেলেন না নাম ইত্যাদি দেখানোরও আগে ছবির ভূমিকা লেখা লিওন ট্রটস্কির লাইনক'টি । " The spirit of mutiny swept the land . A tremendous mysterious process was taking place in countless hearts . The individual's personality became dissolved in the mass , and the mass itself became dissolved in the revolutionary impetus " । ... পরবর্তীতে সোভিয়েত রাশিয়ায় স্ট্যালিনের সঙ্গে ট্রটস্কির তীব্র রাজনৈতিক মতভেদের কারণে সোভিয়েতই এই ছবির নতুন প্রিন্ট করে তাতে প্রথমে লেখা ট্রটস্কির লাইনগুলো তুলে দেয় , বদলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়  লেনিনের লাইন ( The men and the Maggots পর্বের সূচনাংশে লেখা ) । 
   নিউইয়র্কে ' ব্যাটলশিপ পোটেমকিন ' রিলিজ্ হয় ডিসেম্বর ১৯২৬ এ । মাত্র কয়েকদিন প্রদর্শিত এবং তারপরই ব্যান্ । মার্কিন সরকার বরাবর নিজেদের মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল দেখানোর ব্যর্থ কৃত্রিম প্রয়াসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই কোনো রাজনৈতিক যুক্তির অবতারণা না করে তার বদলে হাস্যকর এক যুক্তির অবতারণা করেন । এই ছবি দেখলে নাকি মার্কিন নৌ-বাহিনীর নাবিকরা বিদ্রোহ-বিপ্লবের কলাকৌশল শিখে যাবে , উৎসাহিত হবে ।   প্যারিস , আমস্টারডাম, ব্রাসেলস্ কোথাওই মুক্তি পাওয়ার পর এক সপ্তাহের বেশি প্রদর্শন করা গেল না । সর্বত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা হল । 
   BBFC সেপ্টেম্বর ১৯২৬ এ লণ্ডনের কিছু বিশিষ্ট চলচ্চিত্রপ্রেমীর জন্য  এই ছবির বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে । মাত্র ওই একটিই শো অনুষ্ঠিত হয় ব্রিটেনে । অতঃপর ব্যান্ । সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ছবিটি ব্যান্ ছিল ব্রিটেনেই । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ১৯৫৪ সালে ব্রিটেন এই ছবিকে তাদের দেশে মুক্তি দেয় , তাও ' X ' মার্ক করে । ১৯৮৭ সালে এই ' X ' মার্ক তোলা হয় ব্রিটেনে । 
   গোটা পৃথিবী , বিশেষতঃ পশ্চিমী দুনিয়া জুড়ে রাজনীতিগত ভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া অথচ শিল্পী সাহিত্যিক কবি ও চলচ্চিত্রবোদ্ধা মহলের একইসঙ্গে প্রবল থেকে প্রবলতর বিমুগ্ধ প্রশংসা- এই দুইকে একসঙ্গে নিয়ে চলতে চলতে প্রথম ' ব্যাটলশিপ পোটেমকিন ' থেকে নিষেধাজ্ঞা হালকা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই । তরুণ ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালক David O Selznick পরিচালক হিসেবে কয়েক বছর আগে তখন পা রেখেছেন হলিউডে । তার পরিচালিত " গন উইথ দ্য উইণ্ড " পৃথিবী জুড়ে বাণিজ্যিকভাবে সাফল্যের চূড়ায় । এই তরুণ অথচ তৎকালীন প্রবল খ্যাতিমান পরিচালক তার প্রযোজনা সংস্থা " মেট্রো গোল্ডউইন মেয়ার " ( MGM ) এর সমস্ত সহশিল্পীদের একদিন আমন্ত্রণ জানালেন একসঙ্গে বসে কোথাও ব্যাটলশিপ পোটেমকিন দেখার জন্য । তার আমন্ত্রণপত্রের অন্তর্ভুক্ত এই বিখ্যাত স্টেটমেন্টটি তুমুলভাবে প্রচারিত হল ব্রিটেন ও আমেরিকার চলচ্চিত্রমহলে । - " A group of artists might study a Rubens or a Raphael " । 
   তবে সত্যি কথা বলতে কী , এই সময়জয়ী চলচ্চিত্র প্রথম বড়সড় স্বীকৃতি পেল একদা নিষিদ্ধ ঘোষিত বেলজিয়ামে । ১৯৫৮ তে ব্রাসেলস্ বিশ্ব চলচ্চিত্র মেলায় ' ব্যাটলশিপ পোটেমকিন ' ঘোষিত হল " সর্বকালের চতুর্থতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র " । তারপরেও ধীরে ধীরে এক এক করে গোটা পৃথিবীর সন্দেহ কাটিয়ে ১৯৮৭ সালে ব্রিটেনের ' X ' মার্ক প্রত্যাহার করে নেওয়া থেকেই  বলতে গেলে কোনো দেশে কোথাওই এই চলচ্চিত্রের প্রদর্শনে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা রইল না । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , সার্গেই আইজেনস্টাইনের মৃত্যু ১৯৪৯ সালে । 
   এই গোটা ঐতিহাসিক অধ্যায়ের ওপর পূর্ণ যবনিকা - নির্মাণের আশি বছর পরে এবং আইজেনস্টাইনের মৃত্যুর ছেষট্টি বছরের মাথায় ২০০৫ সালে , যখন মার্কিন চলচ্চিত্র প্রচারক সংস্থা Kino Lorber Studio ডিজিটাল ডলবী সাউণ্ডে প্রথমে DVD এবং তার দু'বছর পরে ২০০৭ সালে ব্যাটলশিপ পোটেমকিন এর ব্লু-রে ভার্সান প্রকাশ করে । দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর আজ আর পৃথিবীর চলচ্চিত্ররসিক মানুষের ' ব্যাটলশিপ পোটেমকিন ' দেখতে কোনো বাধা নেই । এখন ঘরে বসে কম্পিউটারে বা মোবাইলেও দেখা যায় এই প্রবল রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত কালজয়ী চলচ্চিত্র । 
   পাঠক-দর্শক , আমাদের ছবি দেখা পর্ব pause করে এতক্ষণ ছবিমুক্তি পরবর্তী অধ্যায়ের ইতিহাস সামান্য আলোচনা করছিলাম আমরা । আসুন , আবার প্রেক্ষাগৃহের প্রোজেক্টারলাগোয়া কম্পিউটারের  ' Play ' বাটন্ এ ক্লিক করা যাক । 
 
                            *          *         *         * 




                   ★     Drama on the quarterdeck 
                          .....................................................

   সামরিক বিউগলের শব্দ । সমস্ত শ্রমিক-নাবিকের জাহাজের ডেকে এসে একদিকে জমায়েত , অন্যদিকে কম্যাণ্ডারবাহিনী । অতি ভারী আবহসঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে ডেকের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়ালেন জাহাজের সর্বময় দায়িত্বে থাকা কম্যাণ্ডার গালিকভ্ । 
   উঁচু মঞ্চটি থেকে চতুর্দিক দেখে নিয়ে তার ঘোষণা - " যারা যারা ওই মাংস খেয়েছো তারা দু'কদম এগিয়ে দাঁড়াও । অতি সামান্য কয়েকজন এগিয়ে এলো । বিপ্লবের মুখে এসে দাঁড়িয়ে সংগঠিত শক্তির মধ্যেও অনাদি অনন্তকাল ধরে চলে আসা কিছু মানুষের পশ্চাত্পদ রূপ নগ্নভাবে প্রকাশ্যে এল পর্দায় । - একশো শতাংশ কখনোই তোমার সঙ্গে থাকবে না , কিছু থাকবেই ভীত , পলায়নমনোবৃত্তি সম্পন্ন । এই সামনে এগিয়ে আসা কয়েকজন সম্পর্কে গালিকভের ভাবনা শাসকের-শোষকের চিরন্তন ভাবনা হিসেবে সাবটাইটেলে : " Petty Officers " । তাদের সিঁড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে  জাহাজের নীচের অংশে চলে যেতে বলা হল ।  বাকিদের ভালো করে দেখে নিয়ে জাহাজের মাস্তুলের দড়ির দিকে অঙ্গুলীনির্দেশ করে কম্যাণ্ডার ইনচার্জ গালিকভের বজ্রনির্ঘোষ উক্তি : " I will hang the rest " । ... ছবির একটা বিষয়ের উল্লেখ করা এখানে সবিশেষ জরুরী । যারা নিজেদের পেটি অফিসার হিসেবে প্রমাণ করলো , তাদের যেতে বলা হলেও তারা কিন্তু গেল না কেউ , ডেকেরই এককোণে সরে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল । " ব্যাটলশিপ পোটেমকিন " ঠিক এভাবেই বারেবারে বিপ্লবের চিরন্তন দূর্বলতার সঙ্গে বিপ্লবের প্রকৃত শক্তি এবং বোধের জায়গাটিকে পাশাপাশি রেখে এগিয়ে গ্যাছে । 
  জাহাজের উঁচু মাস্তুলের দড়ির দিকে ফিরে তাকালো সমস্ত নাবিক । এডোয়ার্ড টিসের ক্যামেরা ক্লোজআপে ধরে এক তুলনামূলক বয়স্ক পক্ককেশ  নাবিককে । ক্যামেরায় এক সেকেণ্ড তার বহুদূর থেকে  ভেসে আসা উদাসী চোখ , আর এডিটিং এর অদ্ভূত কাজে আর এক সেকেণ্ড দৃশ্যান্তরে দড়ির গায়ে ঝুলন্ত কিছু ছায়া ছায়া কালো মৃতদেহ ।  
   " Call the guards " । ... ডেকে এসে দাঁড়ালো বিরাট বন্দুকধারী বাহিনী । সিদ্ধান্ত পাল্টে গালিকভ্ : " আমি তোমাদের সবাইকে কুকুরের মতো গুলি করে মারব " । ... পেছন পেছনই পর্দাজোড়া ভ্যাকুলিঞ্চুকের মুখ এবং সাবটাইটেলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাবনা : " The time has come " . 
   সেকেণ্ড কম্যাণ্ডার গিলিয়ারভস্কির নির্দেশ : " বড় একটা পর্দা দিয়ে ওদের ঢেকে দাও " । কয়েকজন পর্দা নিয়ে এল । ঢেকে ফেলা হল প্রথম পর্যায়ের শ্যুটআউটের জন্য একদল অবাধ্য শ্রমিক-নাবিককে । ... এই পর্দা আনার সময় একটা ছোট্ট দৃশ্য থেকে পাঠক-দর্শক , সরে থাকলে চলবে না । একজন তরুণ বন্দুকধারী গার্ড ঘাড় ঘুরিয়ে করুণ বিষণ্ণ মুখে পর্দা নিয়ে আসা দেখছিল , দেখতে দেখতে মুখ তার নীচু হয়ে গেল , ঘাড় ঝুলে পড়ল বুকের দিকে হাতে ধরা বন্দুকের দিকে । ঠিক তিন থেকে পাঁচ সেকেণ্ডের দৃশ্য । 
   " ATTENTION " ! ... চোখের ইঙ্গিত গিলিয়ারভস্কির । বন্দুক উদ্যত করল গার্ডবাহিনী । ... স্লো-রিদমে হঠাৎই চার্চের প্রার্থনা ধরনের আবহসঙ্গীত । জাহাজের উঁচু ডেকে এসে দাঁড়ালেন হাতে উঁচু করে তুলে ধরা ক্রুশবিদ্ধ যীশু নিয়ে সাদা দাড়িগোঁফ সম্বলিত এক পাদ্রী । সাবটাইটেল : ' Dear Lord ! Make the disobedient see reason ' । চোখের কোণ দিয়ে ডেকের পুরো দৃশ্য দেখছেন তিনি । হাতে ঠুকঠুক্ করে ক্রমাগত ঠুকতে থাকা ক্রুশ । ... বন্দুকে লক্ষ্যস্থির করে দাঁড়িয়ে সমস্ত  গার্ড । পাদ্রীকে ফের ধরে ক্যামেরা । স্থির অচঞ্চল দৃষ্টি , ডানহাত দিয়ে শুধু বাঁহাতে ক্রুশ ঠুকে চলেছে । ... ক্যামেরায় পেছন পেছনই  একঝাঁক বন্দুকধরা হাত । গভীর দৃষ্টিতে পাঠক-দর্শক লক্ষ্য করবেন , সমস্ত বন্দুক হালকাভাবে কাঁপছে । 
   " FIRE " ! ... ঠিক সেই মুহূর্তে ভ্যাকুলিঞ্চুকের গলা ফাটানো চিৎকার । সাবটাইটেলে যা : " Brothers ! Who are you shooting at ? " পর্দায় এক তরুণ গার্ডের মুখ ক্লোজআপে । অসম্ভব মায়াময় মুখ । পরক্ষণেই পাদ্রীর ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মুখ ধরে ক্যামেরা । ভুরু কোঁচকানো গম্ভীর । ... আগাগোড়া অদ্ভূত এক অতিভারী আবহসঙ্গীত । 
   বন্দুক নামিয়ে নিল গার্ডের দল । পারল না । ... উন্মাদের মত সামনে ছুটে এল গিলিয়ারভস্কি । ... " shoot " ! ... " I order , shoot  ! shoot everyone " ! ... কিন্তু ততক্ষণে নেমে গ্যাছে সমস্ত বন্দুক । ...আর ঠিক তখনই ভ্যাকুলিঞ্চুকের চিৎকার নির্দেশ " Take the rifles first , brothers " । তার পরপরই নির্দেশ " Smash the  Dragons ! Smash all of them " ! ... নিমেষে দৌড়ে সমস্ত বন্দুকের দখল নিল শ্রমিক-নাবিকরা । আবহসঙ্গীত প্রবল দ্রুতলয়ে । জাহাজের পুরো অস্ত্রাগারের দখল গেল নাবিকদের হাতে । দীর্ঘ হুটোপুটি ছুটোছুটির দৃশ্যের মাঝখানে দু'টি দৃশ্যের উল্লেখ আলাদাভাবে না করলেই নয় । ১ ) মাটিতে পড়ে থাকা বিরাট পর্দাটির ( যা আনা হয়েছিল নাবিকদের ঢেকে গুলি করার জন্য ) হাওয়ায় ফুলেফেঁপে প্রবলভাবে উড়তে থাকা নড়তে থাকা , ২ ) জাহাজের মাথায় জারের  পতপত করে উড়তে থাকা পতাকা । 
   কোনক্রমে প্রাণ বাঁচিয়ে দৌড়ে ঘরে পালালো কম্যাণ্ডার ইনচার্জ গালিকভ্ । ভ্যাকুলিঞ্চুক যখন গিলিয়ারভস্কিকে আক্রমণ করেছে , পর্দায় আবির্ভূত হলেন পাদ্রী । ভ্যাকিলিঞ্চুকের দিকে ক্রুশ তুলে নির্দেশ : ' Have fear of God ' । ... গিলিয়ারভস্কিকে ছেড়ে ভ্যাকিলিঞ্চুক ধরলেন জারের পেটুয়াচার্চের পেটুয়া এই পাদ্রীকে । ছিটকে পড়লেন তিনি সিঁড়ি দিয়ে । আটকে গেলেন সিঁড়ির শেষ মাথায় । ক্যামেরার লেন্স  আলাদাভাবে ফোকাস করে দেখালো তার মাটিতে লুটিয়ে পড়া ক্রুশ ... , এবং এই ফাঁকে পালালো গিলিয়ারভস্কি । 
   এক এক করে কম্যাণ্ডার গালিকভের আজ্ঞাবহ অফিসারদের ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হতে লাগল জলে । ডাক্তার স্মিরনভকে হাত-পা বেঁধে জলে ছুঁড়ে ফেলার সময় গোটা পর্দা একবার এক মুহূর্তের জন্য  ক্লোজআপে দেখালো ম্যাগটের নড়াচড়া । অতঃপর জল ছিটিয়ে দেহ সমুদ্রে পড়তেই নাবিকদের সমবেত হর্ষধ্বনির সংলাপ সাবটাইটেলে : " Go to the bottom and feed the worms " , .... আর ঠিক তখনই দু'হাত শূন্যে ছুঁড়ে ভ্যাকুলিঞ্চুক : " Brothers , we have won ! " ... না , জাহাজের ডেকের নাটক এখানেই শেষ নয় । হঠাৎই কোথা থেকে এসে ভ্যাকুলিঞ্চুককে বন্দুক হাতে তাড়া করলেন গিলিয়ারভস্কি । জাহাজের সবচেয়ে উঁচু জায়গায়  দু'জন । বন্দুকের বুলেট নিমেষে বিদ্ধ করল মাথার পেছন । টলতে টলতে মাস্তুলের ঝুলন্ত দড়ির ওপর ভ্যাকুলিঞ্চুকের সমস্ত শরীরের ভার । নীচে অনন্ত সমুদ্রজল । ক্যামেরায় মুহূর্তে এক তুলনাহীন আইজেনস্টাইন মন্তাজের প্রতীকী দৃশ্য । প্রায় মৃত পাদ্রীর এক পলকের জন্য একচোখের কোণ খুলে দৃশ্যটি দেখে নেওয়া, অন্য চোখ বন্ধ । ঘাড় কাত , এলিয়ে পড়ল পাদ্রীর শরীর । 
   অসাধারণ ইলিপটিক্যাল শেপের ভেতর দিয়ে পরবর্তী দৃশ্যে টিসের ক্যামেরা দেখালো ভ্যাকুলিঞ্চুকের দড়ির গায়ে  ঝুলন্ত শরীর , সঙ্গে কিছু নাবিকের দৌড়ে গিয়ে জলে ঝাঁপ দেওয়া । ... মেইসেল্ এর বেহালায় চূড়ান্ত শ্লথ শোকসঙ্গীতের মতো আবহসঙ্গীত । ... রক্তাক্ত ভ্যাকুলিঞ্চুকের জলে ভেজা দেহ তুলে আনা হল জাহাজে । মর্যাদার সঙ্গে রক্ত মুছিয়ে শোয়ানো হল । সাবটাইটেলে : " And he was first to sound the cry of rebellion was first to fall at the executioner's hand " । 
লঙশটে  সাদা চাদর দিয়ে মুড়িয়ে শুইয়ে রাখা ভ্যাকুলিঞ্চুকের দেহ । ... জাহাজ জল কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে ওডেসার দিকে । এডোয়ার্ড টিসের অনবদ্য ক্যামেরায় পর্দায় আধা আলো আধা অন্ধকার গোলাকৃতি ফ্রেমে ভ্যাকুলিঞ্চুকের চাদরে ঢাকা শরীর । জলের ওপর অদ্ভূত আলোআঁধারির খেলা । জাহাজের ওপরের চিমনি দিয়ে হুহু করে কালো ধোঁয়া , নীচে জলসংলগ্ন আড়াআড়ি আর এক চিমনি দিয়ে টানা সাদা ধোঁয়া । জল কেটে এগিয়ে চলেছে জাহাজ ওডেসা বন্দরের দিকে , যেখানে সেইদিন নোঙর ফেলার কথা । ক্যামেরায় জলের ওপর আকাশ জুড়ে শেষ সূর্যের বিষণ্ণ আলোর প্রতিচ্ছবি  । সাবটাইটেলে : " A tent on the new pier in Odessa is the final resting place of Vakulinchuk " । 
   পাঠক-দর্শক , লম্বা আবহসঙ্গীত শেষ হলেই এবার আমরা যাবো পরবর্তী পর্যায়ে " The Dead Man Calls Out " , তার আগে আসুন দ্রুত একটু অন্য গল্প শুনে নেওয়া যাক । 

                            *          *          *          * 

   " মাই অটোবায়োগ্রাফি " পৃষ্ঠা ৩১৯ এবং ৩২০ অনুযায়ী চ্যাপলিনের সঙ্গে আইজেনস্টাইনের দেখা হয়েছিল একবারই ,  ১৯৩০ সালে হলিউডে প্যারামাউন্ট পিকচার্সের আমন্ত্রণে আইজেনস্টাইনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে । " ... পোটেমকিন " মুগ্ধ চার্লি চ্যাপলিন তার আত্মজীবনীতে আইজেনস্টাইনের সঙ্গে তার কথোপকথনের ছোট্ট একটা জায়গার এইভাবে বর্ণনা দিয়েছেন : " তার সঙ্গে কমিউনিজম্ নিয়ে আলোচনা করতে করতে তাকে আমি একদিন প্রশ্ন করেছিলাম , ' আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় না, যে শিক্ষিত প্রোলেতারিয়ানের মানসিকতা তার প্রজন্মের সাংস্কৃতিক ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা বুর্জোয়া মানসিকতার সঙ্গে একই ? " ... চ্যাপলিন লিখছেন , " আমি ভেবেছিলাম এই প্রশ্ন শুনে কমিউনিজমের ধারণা সম্পর্কে আমার অজ্ঞতায় উনি অত্যন্ত অবাক হবেন । কিন্তু উল্টে আমাকে অবাক করে দিয়ে আইজেনস্টাইন উত্তর দিলেন " অবশ্যই । শিক্ষিত হলেই প্রোলেতারিয়ানের মস্তিষ্কশক্তি অন্য ধরনের হয়ে উঠতে চায়, অনেকটা সার পেয়ে নতুনভাবে উর্বর হয়ে উঠতে চাওয়া মাটির মতন " । ... আইজেনস্টাইন প্রসঙ্গে পরবর্তীতে চ্যাপলিন আরো লিখছেন - " ইতিহাসের নিছক বর্ণনামূলক সত্যকথন আমাকে কখনো আকর্ষণ করেনি । কিন্তু আইজেনস্টাইনের ছবি দেখে আমি অনুভব করেছি যে সেই ইতিহাস যখন বিশেষ কোনো শিল্পীর হাতে অসাধারণ কাব্যিকতায় সামনে আসে , তখন তা গোটা ঐতিহাসিক পর্যায়টি সম্পর্কেই ভেতরে ঠিক কী ধরনের গভীর অনুভবের জন্ম দেয় " ! ... চ্যাপলিন লিখছেন - " ফেলে আসা প্রকৃত সত্যঘটনার শৈল্পিককর্ম ইতিহাস বইয়ের থেকেও যে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আইজেনস্টাইন তার ছবিতে তা প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন " । 
  ব্রেখট্ ও আইজেনস্টাইনের এক কথোপকথন নাটক ও চলচ্চিত্র গবেষণায় ইতিহাসপ্রসিদ্ধ । ৮ই থেকে ৯ই মে ১৯৩২ , বার্লিন থেকে মস্কো যাওয়ার পথে এক ট্রেনযাত্রায় দু'জনের দেখা হয় এবং ব্যাটলশিপ পোটেমকিন কে সামনে রেখে বিপ্লবের পটভূমিকায় আইজেনস্টাইনকৃত মন্তাজের রুশ চলচ্চিত্রে ব্যবহার ও ব্রেখট্ কল্পিত জার্মান এপিক থিয়েটারে ব্যবহার নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয় । সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের অ্যাক্টা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত রুশ সাহিত্য ও চলচ্চিত্র সম্পর্কিত রচনাসংকলনের একটি গ্রন্থে Lars K Leberg রচিত ব্রেখট্ ও আইজেনস্টাইনের মধ্যে এক নাট্যধর্মী রচনা থেকে জানা যায় যে ব্রেখট্ হাসতে হাসতে আইজেনস্টাইনকে বলছেন , " জার্মান মানুষ রাশিয়ায় জারের শাসনে হওয়া নৌ-বিদ্রোহ সম্পর্কে হয়ত রুশ জনগণের থেকেও অনেক বেশি জানে " । আইজেনস্টাইন জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে ব্রেখটের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ' কিভাবে ' ? ব্রেখটের উত্তর - ' কেন ? ব্যাটলশিপ পোটেমকিন দেখে ' । ... ( দর্শক-পাঠক , ভুলবেন না জার্মানিতে প্রাথমিকভাবে মূল সেলুলয়েড রীল থেকে প্রায় একশো গজ অংশ কিন্তু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল । তারপরেও ... ) 
   ম্যাক্সিম গোর্কি ! ... গোর্কির জীবনের শেষপ্রান্তে আইজেনস্টাইনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব । আইজেনস্টাইন ও গোর্কি উভয়ই পরস্পরের সম্পর্কে ছিলেন গভীর শ্রদ্ধাবনত । আইজেনস্টাইন তার একটি নিবন্ধে লিখছেন " অত্যন্ত বিনয়ী গোর্কি শত্রু বা শয়তান সম্পর্কে যে ধরনের রসিকতা করতে পারতেন তাতে মোহিত হয়ে যেতে হত " । ব্যাটলশিপ পোটেমকিন নিয়ে গোর্কি ও আইজেনস্টাইনের বিভিন্ন আলোচনায় কম্যাণ্ডার গালিকভ্ ও গিলিয়ারভস্কি সম্পর্কে গোর্কির অদ্ভূত অদ্ভূত  রসিকতায় বারবার অবাক হয়েছেন আইজেনস্টাইন । 
   1957 সালে সার্গেই আইজেনস্টাইন ও তার কালজয়ী চলচ্চিত্র ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের অসম্ভব ভক্ত বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত আইরিশ চিত্রকর ফ্রান্সিস বেকন এই চলচ্চিত্রের " ওডেসা স্টেয়ারকেস " অংশের অত্যন্ত আলোচিত ও পৃথিবী জুড়ে প্রশংসিত রক্তাক্ত চশমাঝুলেপড়াচোখ নার্সমুখের মন্তাজদৃশ্যটি অবলম্বনে এঁকেছিলেন তার বিখ্যাত চিত্র " study for the nurse " । তেলরঙে আঁকা 198×142 cm দৈর্ঘ্য-প্রস্থর এই অসাধারণ  ছবিটি রাখা আছে ব্রিটেনের লিভারপুল আর্ট গ্যালারিতে । চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্রে আজীবন ডুবে থাকা এই শিল্পী জীবনে প্রথমবার ব্যাটলশিপ পোটেমকিন দেখেন ১৯৩৫ সালে , তারপর অসংখ্যবার । 
   আমেরিকার বিদ্রোহী কৃষ্ণাঙ্গ গায়ক পল রবসন ১৯৩৪ এর একেবারে শেষলগ্নে দু'মাসের জন্য সস্ত্রীক রাশিয়ায় আসেন । সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র নিয়ে আইজেনস্টাইনেরই বাড়িতে এই দুই মহান শিল্পীবিপ্লবীর একাধিকবার মত বিনিময় হয় । প্রথম সাক্ষাতেই আইজেনস্টাইনও যেমন তার প্রতিভাকে স্বীকার করে নেন , রবসনও বলেছিলেন সার্গেই আইজেনস্টাইনের সঙ্গে  সাক্ষাৎ তার জীবনের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা । ... পল রবসন অবশ্য স্বয়ং আইজেনস্টাইনকে স্পষ্টভাবেই জানিয়ে ছিলেন যে ব্যাটলশিপ পোটেমকিন নয় , তার প্রিয় আইজেনস্টাইন চলচ্চিত্র " ওল্ড অ্যাণ্ড নিউ " । ... কেন ? ... উত্তরও অতিবিস্তৃতভাবে দিয়েছিলেন এই কৃষ্ণাঙ্গ গায়ক । ... কিন্তু সে প্রসঙ্গ আপাততঃ থাক । দেরী হয়ে যাচ্ছে । আসুন , আবার শুরু করি ' ... পোটেমকিন 'এর বাকি অংশ দেখা । 

                              *        *        *        * 




                    ★ The Dead Man Calls Out 
                       ................................................

   রিদম্ এ বাজতে থাকা অদ্ভূত লিরিক্যাল আবহসঙ্গীতের সঙ্গে ক্যামেরা ঘুরছে ওডেসা বন্দরের চারপাশ দিয়ে । একাধিক নোঙর ফেলে থাকা জাহাজ , সমুদ্রে জলের স্রোত , হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়া সন্ধ্যের আকাশ , ফাঁক গলে মাঝেমাঝে জলের ওপর আড়াআড়ি চাঁদের আলো । ... ক্যামেরা স্থির হল ডাঙায় ছোট্ট একটা তাঁবুর সামনে । ... Rumors came from the pier " । একজন দু'জন করে তাঁবুর কাছে সেই সন্ধ্যায় জমতে শুরু করল লোক । ক্যামেরা ক্লোজআপে দেখালো শায়িত ভ্যাকুলিঞ্চুককে । ... এক মা তার ছোট্ট ছোট্ট দুই শিশু পুত্রকন্যা সঙ্গে নিয়ে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো মৃতদেহের সামনে । ... আরো একজন । ... আরো দশজন । ... ক্রমশঃ বাড়ছে ভীড় । একজন মহিলা হাঁটু গেড়ে বসে মৃতদেহের বুকের ওপর জ্বলতে থাকা হালকা ধোঁয়াযুক্ত কোনো কাঠি ( ধুপের মতো ) পরম শ্রদ্ধায় সামান্য নাড়িয়ে ঠিক করে দিলেন । ... সন্ধ্যে বাড়ার সাথে সাথে আরো লোক বাড়ছে । তাঁবুর সামনে কৌতূহলী মুখের উঁকিঝুঁকিই শুধু নয় , হতবাক হতভম্ব ভীড়ের পুরো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা । ক্যামেরা এক মুহূর্তের জন্য দেখালো জাহাজের দু'জন কম্যাণ্ডার অফিসার নিশ্চিন্তে জলে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে । এদিকে তাদের হুঁশ নেই । 
   " Together with the Sun news hit the city " । পরদিন সূর্য ওঠার পর থেকেই খবর পেয়ে শুরু হল তাঁবুর দিকে কাতারে কাতারে লোক আসতে থাকা । সবদিকের সমস্ত রাস্তা দিয়ে লাইন দিয়ে হেঁটে আসছে লোক । দু'পাশের দুটো সিঁড়ি দিয়ে পিলপিল করে নামছে লোক । সমুদ্রের ওপর দিয়ে পোতাশ্রয় অভিমুখে  অর্ধচন্দ্রাকৃতি রাস্তা । ক্যামেরা ধীরে ধীরে ফোকাসের রেঞ্জ লঙশটের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করল । পর্দাজুড়ে সমুদ্রজল , এ কোণ থেকে কোণাকুণি ও কোণ পর্যন্ত বৃত্তের জ্যা ধরনের সরু সমান্তরাল দুটো দাগ ( রাস্তা ) । তার ওপর দিয়ে পিঁপড়ের মতো মানুষের মাথা । হাজার ... লক্ষ ... লক্ষ লক্ষ ... । হাঁটার গতিবেগ দ্রুত হচ্ছে মানুষের ।  সাবটাইটেলে - " A killed sailor " । 
   এক অল্পবয়স্ক তরুণীর তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত বক্তৃতা । " We will remember " । ... " এক চামচ পচা মাংসর স্যুপ খেতে অস্বীকার করার জন্য " । ... ক্যামেরা দেখালো একখণ্ড কাগজ হাতে নিয়ে এক তরুণ সমবেত জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে শপথবাক্য পাঠ করানোর মতো কিছু পড়ছে । ... " Citizens of Odessa ! Lying before you is the body of the brutally killed sailor Grigory Vakulinchuk , slain by a senior officer of the squadron battleship ' Prince Tavrichesky ' . Let's take revenge on the bloodthirsty Vampires ! Death to the oppressors ! Signed , crew of the squadron battleship ' Prince Tavrichesky ' ... " । 
   বয়ো:বৃদ্ধা একজন কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ল মৃত ভ্যাকুলিঞ্চুকের বুকে । ফের উঠে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে মুছতে লাগল চোখের জল । বয়ো:বৃদ্ধ একজন চশমা খুলে ছলছল চোখে একদৃষ্টিতে দেখছে ভ্যাকুলিঞ্চুকের নিথর দেহ । ... ক্যামেরা এক মুহূর্তের জন্য দেখালো সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে কম্যাণ্ডার গিলিয়ারভস্কি সব দেখতে দেখতে ধূমপানে মগ্ন । 
   " Eternal memory to the fallen fighters . ... All for one . ... One for all " । .... ধীরে ধীরে শোক ভুলে কঠিন হচ্ছে জনতার মুখ । ... টুপি খুলে শ্রদ্ধাবনত মুখ , অথচ হাতের টুপি শক্ত হচ্ছে মুঠোয় । জনতার সমস্বরে মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে তুলে স্লোগান , অল্পবয়স্ক তরুণের চিৎকার করে স্লোগান , অল্পবয়স্কা সুন্দরী তরুণীর দৃপ্তমুখে স্লোগান , শোকভুলে বৃদ্ধাবৃদ্ধের প্রবল স্লোগান , হাজার লক্ষ ওডেসা জনতার সমবেত স্লোগান -  " Down with tyranny " । ... অল্পবয়স্কা সুন্দরী তরুণীটির বক্তৃতাঢঙে বলা কথা সাবটাইটেলে : Mothers and brothers ! Let there not be differences or hostility among us " ! .... " shoulder to shoulder ! .... The land is ours ! ... Tomorrow is ours ! " ... ক্যামেরা দেখালো , জনতার মাঝে জামা খুলে ফেলল চরম উত্তেজিত তরুণ । আঙুল তুলে দেখালো দূরে দাঁড়ানো পোটেমকিন জাহাজের দিকে । ... দলে দলে লোক উন্মাদের মতো উঠতে লাগল জাহাজের ডেকে । ক্যামেরায় পর্দার তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে জাহাজ । ডেকের ওপর থিকথিক করছে জনতা । ... " জ্যাখভ্যাতিবাদ ! জ্যাখভ্যাতিবাদ ! ( দখল ! দখল ! ) নীচে ডাঙায় দাঁড়িয়ে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মুষ্টিবদ্ধ হাত । তাকিয়ে আছে জনতা একদৃষ্টিতে জাহাজের দিকে । 
   " The enemy must be dealt with a decisive blow ! " .... " Together with the rebelling workers for all of Russia ! " .... " We will win ! "  সমবেত জনতা আবার আঙুল তুলে দেখালো । এবার জাহাজের মাথায় উড়তে থাকা জারের পতাকার দিকে । একজন মাস্তুলের দড়ি বেয়ে ওই সর্বোচ্চ শিখরে । ... নেমে গেল জারের পতাকা , শাসকের পতাকা । তার জায়গায় ধীরে ধীরে একখণ্ড লাল পতাকা উঠতে লাগল ওপরের দিকে । একসময় জাহাজের সর্বোচ্চ বিন্দুতে এসে স্থির হল ক্যামেরা । পতপত করে গোটা ওডেসা আকাশ জুড়ে উড়ছে লাল ... লাল ... লাল ... লাল । ... আবহসঙ্গীত ধীরে ধীরে শেষ । পাঠক-দর্শক , এরপর আমরা দেখবো ফিল্মের চতুর্থ অংশ " ওডেসা স্টেয়ারকেস " । ... আপাততঃ  কাল্পনিক ইন্টারভ্যাল ।  প্রেক্ষাগৃহের আলো জ্বলে ওঠা দেখতে দেখতে , পটাটো চিপসের প্যাকেট ছিঁড়তে ছিঁড়তে এই লাল পতাকা নিয়ে খুব প্রাসঙ্গিক একটি কথা না জানলেই নয় । যেহেতু ছবিটি সাদা-কালো , পতাকার রঙ ঠিক কোন ধরনের হলে লালের পরিপূর্ণ এফেক্ট দর্শককে দেওয়া যায় , পরিচালক সার্গেই আইজেনস্টাইনের এই রঙখুঁতখুঁতুনির জন্য তৃতীয় পর্বের শেষতম দৃশ্যটির গ্রহণের তারিখ তিনবার পিছিয়েছিল । অবশেষে একধরনের সামান্য আগুনে পোড়া ছাই মেশানো অথচ আদতে ভারী কালো ধরনের রঙ পরিচালকের পছন্দ হয় । অতঃপর আবার নতুন তারিখ ঠিক করে দৃশ্যগ্রহণ ... 

                              *          *          *          * 

" এখানে চালের কল আছে । সেই কল-দানবের চাকা সাঁওতাল ছেলেমেয়েরা । ধনী তাদের কি মানুষ মনে করে ? তাদের সুখদুঃখের কি হিসেব আছে ? প্রতিদিনের পাওনা গুনে দিয়ে তার কাছে কষে রক্ত শুষে কাজ আদায় করে নিচ্ছে । এতে টাকা হয়, সুখও হয়, অনেক হয় , কিন্তু বিকিয়ে যায় মানুষের সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ , মানবত্ব " । 

   ১৯৩০ সালে সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক সন্ধ্যায় মস্কোর ইউনিয়ন সিনেমা অ্যাসোশিয়েশানের আলো-আঁধারী আবহের প্রেক্ষাগৃহে সাদা দাড়িগোঁফ সম্বলিত এক দীর্ঘদেহী সৌম্যদর্শন ভারতীয় কবির ( পড়ুন , বঙ্গকবির ) সঙ্গে অল্প কয়েকজন রুশ নারীপুরুষ । সার্গেই আইজেনস্টাইন পরিচালিত " ব্যাটলশিপ পোটেমকিন " চলচ্চিত্রের স্পেশাল শো । মানবতাবাদী দার্শনিক এই ভারতীয় বিশ্বকবির জন্য আলাদাভাবে ব্যবস্থা করা এ' শোয়ের  আয়োজক আইজেনস্টাইনের সেই সময়ের প্রেমিকা ও পরবর্তীকালে স্ত্রী পেরা অ্যাটশোভা । ... আলো নিভল । শুরু হল ছবি । প্রথম দৃশ্যে সেই উত্তাল সমুদ্রস্রোতের পাথরের গায়ে আছড়ে পড়া , সঙ্গে এডমণ্ড মেইসেলের আবহসঙ্গীত । ... একদৃষ্টিতে পর্দার দিকে তাকিয়ে কবি । ... সময়ের নিয়মে একসময় ছবি শেষ হল । জ্বলে উঠল আলো । উপস্থিত সবাই প্রেক্ষাগৃহের ঠিক পাশের হলঘরটিতে গিয়ে বসলেন । 
   পেরা অ্যাটশোভা : " আপনি রাশিয়ায় আসছেন শোনার পর থেকেই আমার প্রবল বাসনা ছিল একবার যেন আপনি ছবিটি দেখেন । আজ সত্যিই আমার হৃদয় উপচে পড়া ভালোলাগা ! অসম্ভব তৃপ্ত আমি ! কেমন লাগল কবি , ব্যাটলশিপ পোটেমকিন " ? 
   কবি : অপূর্ব ! ... দেশেই আমি এই ছবির শ্রেষ্ঠত্ব , এর দুনিয়াজোড়া সুনাম সম্পর্কে জেনেছিলেম ।  ঠিক করেছে ওরা । অত্যাচার অবিচার যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় , প্রকৃতি  নিজের নিয়মেই বোধ'য় এমনি করে তখন ভেতরে আগুন জ্বালাতে শুরু করে । কালের বিধান মেনে অত্যাচারীকে একদিন আত্মসমর্পণে বাধ্য হতেই হয় । 
        পেরা : " মানুষের প্রতি  এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, মানবতার প্রতি এই অনন্ত শ্রদ্ধার কারণেই তো গোটা সোভিয়েতের কাছে আপনি অসম্ভব প্রিয় । ... আমরা এখানে উপস্থিত সবাই খুব যত্ন করে ইংরেজী ভাষা শিখেছি , কবি ।  আপনার " সঙ অফারিঙস্  " আমার প্রিয়তম কাব্যগ্রন্থ । শুধু আমার নয় , আমাদের সক্কলের "। 
        উপস্থিত এক তরুণী হঠাৎই আবৃত্তির ভঙ্গীমায়  : " Leave this chanting and singing and telling of beads ! / whom do thou worship in this lonely dark corner of temple with doors all shut ? / open thine eyes and see thy God is not before thee ! / He is there where the tiller is tilling the ground and where the path-maker is breaking stones . / He is with them in the Sun and in shower , and his garment is covered with dust . / put off thy holy mantle and even like him come down on the dusty soil ! " 
   স্মিত প্রসন্নমুখে কবি : " আমাদের বাঙলায় এই কবিতাটির নাম ধূলামন্দির । ধূলা মিনস্ ডাস্ট অ্যাণ্ড মন্দির ইজ্ দ্য টেম্পল । ... আজ এই ছবি দেখতে দেখতে আমার বারবার মনে পড়ছিল ঠিক দু'বছর আগে আমার লেখা রক্তকরবী নাটকের কথা , সেই সোনার খনির শ্রমিকদের কথা , তাদের আবেগ তাদের অনুভূতির কথা , বিশুপাগলার কথা । মকররাজের রাজত্বে কিংবা এই যুদ্ধজাহাজ পোটেমকিনে , শ্রমের মানুষ বোধহয় সর্বত্রই শুধু নম্বরে । ৬৯ ঙ । ... তবে মিছে বলবো না , এ'ছবি দেখার আগে চলচ্চিত্রকে মানবতাবাদী শিল্পমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করায় আমার বড় একটা উৎসাহ ছিল না । শুনেছিলেম চলচ্চিত্র নির্মাণ বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ " । 
   পেরা : আর এখন ? ছবি দেখার পর ? 
   কবি : এখন আমি এই ছবির পরিচালকের সঙ্গে একবার আগে দেখা করতে চাই । তার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই যে তার হাত ধরে শুধু বিপ্লব নয় , মানুষের ইতিহাসে চিরন্তন মানবতার পদধ্বনি পর্দায় আনা সম্ভব হতে পারে কিনা । ... কত বয়স এই পরিচালকের ? 
   পেরা : ২৭ বছর । ... আমি জানি , সার্গেইও আপনার সঙ্গে দেখা হলে প্রবল আনন্দিত হতেন । কিন্তু  দেখা হবে না , প্রিয় কবি । উনি এই মুহূর্তে এক ফিল্ম কম্পানীর আমন্ত্রণে আমেরিকায় । 
   কবি : সত্যিই স্তম্ভিত আমি ! আশ্চর্য হচ্ছি তার বয়স শুনে । বড় ভালো হতো যদি এই অনন্যসাধারণ প্রতিভার মানুষটির সঙ্গে সম্মুখসাক্ষাৎ হতে পারতো ! আলোচনা করতাম তার সঙ্গে , যে আমার " The Child " কে নিয়ে রুশ প্রযোজনা ও তার পরিচালনায় একটি ছবিনির্মাণের  কাজ সম্ভব কিনা । 
   পেরা : সে ফিরলে তাকে অবশ্যই আমি আপনার সমস্ত কথা জানাবো । 
   কবি : আজ তবে এই অবধি থাক ? ক'দিন এই বিপ্লবের দেশ রুশ দেশে আপনাদের সাহচর্যে বড় ভালো কাটল , ব্যস্ততায় কাটল । এইবার গন্তব্য  জার্মানি ও আমেরিকা ।  ...রুশদেশ সম্পর্কে  আমার অন্তরের মুগ্ধতা আমার দেশবাসীকে লিখে জানাবো আমি । ... তবে শারীরিকভাবে বড় ক্লান্তি অনুভব করছি এখন  । আপনারা তো জানেন ক'দিন কী  ধকল যাচ্ছে আমার ওপর দিয়ে ! কাল সকালে গেছি কৃষি সমবায় ভবন পরিদর্শনে ,  সন্ধ্যায় আর্ট থিয়েটারে দেখেছি টলস্টয়ের উপন্যাস অবলম্বনে নাটক " রেজুরেকশান্ " । আজ সকালে আপনাদের এখানকার সিনেমাটোগ্রাফিক আর্টিস্ট ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে লম্বা আলোচনা । তারপর আজ সন্ধ্যায় এই ছবি । .... এবার আমার একটু বিশ্রাম না নিলেই নয় , পেরা । আপনাদের সকলের জন্য  সুদূর ভারতবর্ষে আমার শান্তিনিকেতনে আসার আমন্ত্রণ রেখে গেলাম । সার্গেই আইজেনস্টাইনের মতো মহাশিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে আপনারা নিশ্চয়ই আসবেন শান্তিনিকেতনের গাছগাছালি ছাওয়া আশ্রমে । ঘুরবেন আশপাশের গ্রাম । দেখবেন , ছাতিমতলার উপাসনাস্থলে বসে হৃদয় কেমন পূর্ণ হয়ে ওঠে কানায় কানায় । .... আজ উঠি তবে । 
   উঠে পড়লেন সবাই , বেরিয়ে পড়লেন হলঘর ছেড়ে । 

   পাঠক-দর্শক , আসুন শুরু করি দেখা ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের বিখ্যাত চতুর্থ পর্ব " The Odessa staircase " । আজ অবধি বিশ্ব-চলচ্চিত্র সম্পর্কে কোথাও আলোচনা হচ্ছে অথচ the odessa staircase নিয়ে একটি শব্দও আলোচক খরচ করেননি , এমন নজির বোধহয় নেই । .... বেল বাজল । মধ্যান্তরের পর  শুরু হতে চলেছে ছবি । " The Odessa Staircase " । 

                     *           *           *          * 

                     ★    The Odessa Staircase 
                         ...............................................

   পোতাশ্রয় । ... একে একে ছোট নৌকাগুলো জিনিসপত্তর ভরে নিয়ে পাল তুলে এগিয়ে যেতে শুরু করল ব্যাটলশিপের দিকে । ওডেসার মানুষের বিপ্লবের দিনগুলোয় টানা বসবাস দূরে লাল পতাকা উড়িয়ে ভাসতে থাকা যুদ্ধজাহাজকে সঙ্গে নিয়েই । ওডেসা শহর থেকে ওই সমস্ত ছোট ছোট নৌকায় জাহাজের নিত্যদিনের ব্যবহার্য মালপত্র জলে ভাসতে ভাসতে চলেছে জাহাজ অভিমুখে । ... অদ্ভূত লিরিক্যাল আবহসঙ্গীত । ... ক্যামেরায় সামনে থেকে ধরা পড়ে সমুদ্রের স্রোত বেয়ে এগিয়ে চলা একঝাঁক পালতোলা নৌকা । ডাঙায় সোৎসাহে জাহাজের দিকে হাত নাড়তে থাকা ছাতা মাথায় দম্পতি , তরুণী যুবতী , তরুণ যুবক , চশমাচোখে প্রৌঢ়া নার্স । নৌকা আসতে দেখে ছুটে জাহাজের সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালো বিপ্লবীদল । একে একে সমস্ত মাল উঠতে লাগল জাহাজে । রান্নাকরা খাদ্য, বিভিন্ন কাঁচা আনাজপাতি , খাঁচা ভর্তি মুরগী । সব হাতে হাতে উঠছে জাহাজে । দূরে তীরভর্তি মানুষজনের হাত নাড়া । ক্যামেরা ফের একবার ফ্রেমবন্দী করে হাত নাড়তে থাকা সেই প্রৌঢ়া নার্সকে , তরুণ যুবককে । ভীড়ের মধ্যে হাত নাড়ছে ঝুড়ি হাতে ছোট শিশু , বসে বসেই হাত নাড়ছে পা-বিহীন প্রতিবন্ধী যুবক , মাথার টুপি খুলে সমানে নেড়ে চলেছে আরো দুই শিশু ভাই-বোন । 
   সাবটাইটেলে : ' And Suddenly ... ' 
হঠাৎই প্রবল দ্রুতলয়ে আবহসঙ্গীত । ... পর্দায় প্রথম দেখা গেল প্রতিবন্ধী পা-বিহীন যুবকটির হাতের ওপর ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে একেকটা সিঁড়ি ভেঙে ভয়ার্ত দৌড় । ... পেছন পেছন ছাতা মাথায় মহিলা । ছাতাটি দ্রুত এগিয়ে সামনে এসে পর্দাজোড়া হয়ে উঠল । তারও পেছনে ওডেসা-বন্দরের সিঁড়ির ধাপগুলো ভর্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা গোটা ভীড়ের ভীত উদভ্রান্ত দৌড় । ... পাঠক-দর্শক , এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কী ঘটলো ! বোঝা গেল কাট্ হয়ে পরের দৃশ্যে । ... সাদা পোশাকে হাতে উদ্যত বন্দুক নিয়ে তালে তালে পা ফেলে এগিয়ে আসছে জারের সেনাবাহিনী । একজন সেনার বন্দুকের নলের মুখে প্রথম দেখা দিল ধোঁয়া । পাঠক-দর্শক , নির্বাকযুগের ছবিতে মনে মনে একটি শব্দ কল্পনা করে নিন । ..." গুড়ুম ! "... সিঁড়ির ওপর দু'পা হাঁটু থেকে ধীরে ধীরে স্লো-মোশনে সামনের দিকে ভাঙছে , অতঃপর কেউ একটা মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে । ... দ্রুত বেজে চলা আবহসঙ্গীতের সঙ্গেসঙ্গেই ভীড়ের প্রাণপণে ছুটে পালানো । ... একদল সুশৃঙ্খল সৈন্যবাহিনী গোটা ভীড়ের পেছনে বন্দুক উঁচিয়ে সিঁড়ির ধাপ ডিঙিয়ে তালে তালে পা ফেলে , তালে তালে পা ফেলে ... । .... একের পর এক বন্দুকের মুখে সাদা-সাদা পাকানো ধোঁয়া ! সমবেত ভীড় থেকে সমানে লুটিয়ে পড়ছে মানুষ । ... তিন-চার জন সিঁড়ির পাশে নীচু হয়ে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করছে , তার মধ্যে চশমাপড়া সেই প্রৌঢ়া নার্স । ... আবার বন্দুকের ধোঁয়া! ... মা'র হাত ধরে ছুটতে থাকা শিশু লুটিয়ে পড়ল । শিশুর দিকে ফিরেও না তাকিয়ে মা'র সামনের দিকে দৌড় । ... এডোয়ার্ড টিসের ক্যামেরা ক্লোজআপে দেখালো ওইটুকু রক্তাক্ত শিশুর হাত মাড়িয়ে শরীর মাড়িয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে জনতা । ... কিন্তু মা দৌড়ে পালালেও অসীম সাহসে ভর করে এগিয়ে এসে শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন বাবা । সিঁড়ির নীচে আড়াল থেকে উঠে দাঁড়ালেন যে ক'জন লুকিয়েছিলেন । শিশুকোলে-বাবার দিকে তাকিয়ে প্রৌঢ়া নার্সের জবানীতে পর্দায় সাবটাইটেল : " Let's go ! Let's convince them ! " ... ভয়ার্ত জনস্রোতের সম্পূর্ণ উল্টোদিকে রক্তাক্ত  শিশুটিকে কোলে করে অতঃপর তার বাবার হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাওয়া । একের পর এক শরীর তখন বন্দুকের সামনে লুটিয়ে পড়ছে । সিঁড়িভর্তি মৃতদেহের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একা বাবা সন্তান কোলে জারের সেনাবাহিনীর বন্দুকের নলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন । ... " Listen ! Don't shoot ! My boy is badly hurt ! " ... এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো সৈন্যদল । সমস্ত আবহসঙ্গীতও স্তব্ধ ।  তারপর ... " গুড়ুম ! " ... ছিটকে পড়ল শিশুসহ বাবার শরীর । ... আবার ক্যামেরায় মানুষের ছোটাছুটি । নারী-শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-তরুণ-তরুণী নির্বিশেষে সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়ছে ওডেসা নাগরিকদের দেহ । এবার ভীড়ের সামনের দিকটায় দেখা গেল চাবুক হাতে ঘোড়ায় চড়া আর একদল সৈন্য । বেপরোয়া চাবুক চালাচ্ছে তারা । দু'দিক থেকে আক্রমণ , পালানোর পথ বন্ধ । .... ঠিক এর পরেপরেই পৃথিবীজোড়া আলোচিত প্যারাম্বুলেটারে শিশুর সেই গড়িয়ে পড়া দৃশ্য । ... প্যারাম্বুলেটার ঠেলতে ঠেলতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করা মা লুটিয়ে পড়লেন গুলিতে । ... দ্বিতীয় পর্বে ভ্যাকিলিঞ্চুকের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে উত্তেজক বক্তৃতা দেওয়া সেই অল্পবয়সী সুন্দরী তরুণীটি ক্যামেরায় । দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁট কামড়ে নিস্ফল আক্রোশে তিনি একবার তাকাচ্ছেন পেছনে সেনাবাহিনীর দিকে , একবার সিঁড়িতে আটকে থাকা প্যারাম্বুলেটারের দিকে । শোয়ানো শিশুসহ প্যারাম্বুলেটারটি যেই ধরলেন , সঙ্গে সঙ্গে গুলি । টলতে টলতে ছিটকে পড়লেন তিনি । তার মাথার ধাক্কায় প্যারাম্বুলেটার সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নামতে শুরু করল নীচের দিকে । শোয়ানো শিশুটিকে ক্লোজআপে ধরে ক্যামেরা । আপনমনে ছোট্ট হাতের আঙুল দিয়ে চোখ ঘষছে । .... গড়িয়ে গড়িয়ে নীচের দিকে ... , নিম্নমুখী গড়িয়েই চলেছে শিশুসহ প্যারাম্বুলেটার , আর তার পেছনে বন্দুক হাতে জারের পদাতিক বাহিনীর মার্চ , সামনে চাবুক হাতে ঘোড়সওয়ার বাহিনী । দু'য়ের মাঝে পর্দায় গড়াতে থাকা প্যারাম্বুলেটার । ... হঠাৎই কোথা থেকে উন্মাদের মত সেই প্রৌঢ়া নার্স ! প্যারাম্বুলেটারটির কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা মাত্র একজন জার সেনার তার মুখ লক্ষ্য করে সপাটে চাবুক । পেছনের গা-লাগোয়া দৃশ্যটি সবিশেষভাবে লক্ষ্য করুন , পাঠক-দর্শক । এই দৃশ্য বিগত একশো বছর ধরে চলচ্চিত্রদুনিয়ায় সর্বসময় আলোচিত আইজেনস্টাইনের বিখ্যাত বিখ্যাত বিখ্যাততম মন্তাজদৃশ্য । মুখ লক্ষ্য করে চালানো চাবুকের আঘাতে নার্সের চশমার একদিক চোখ থেকে কিছুটা নীচে । চোখের সেই দিক রক্তবিহীন । অন্যচোখে চশমার কাঁচ ঠিক যেখানে থাকার কথা সেখানেই । সম্পূর্ণ রক্তাক্ত ! ... সিঁড়ি দিয়ে আপনগতিতে গড়িয়ে চলেছে প্যারাম্বুলেটার । 
   আর ঠিক তখনই ... । ... ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া । ... জারের সেনাপ্রধান ও তার বাহিনী বোধহয় বিস্মৃত হয়েছিল যে পোটেমকিনের মতো একটি যুদ্ধজাহাজ সম্পূর্ণভাবে জনতার দখলে । ... হঠাৎই অতীব গম্ভীর হয়ে ওঠা স্লো-রিদম্ আবহসঙ্গীতের সঙ্গে পর্দাজুড়ে জাহাজের গোলাছোঁড়ার জন্য বিরাটাকৃতি নলের গোল মুখটি দেখা গেল ঘুরতে শুরু করেছে , লক্ষ্য স্থির করছে । ... " And then the brutality of the military authorities in Odessa was answered with the battleship shells " . ... , " The target - the odessa theater ... THE GENERAL'S HEAD QUARTER " . ... একের পর এক জাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ । ধোঁয়ায় ধোঁয়া ! চুরচুর করে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে জারের সেনাবাহিনীর সদর ঘাঁটি ওডেসা থিয়েটার । ছাদের ওপরের সাজানো স্থাপত্য ভেঙে পড়ল । ভেঙে পড়ল গেট । ভেঙে পড়ল গেটের মাথায় বসানো প্রতীকী সিংহের মূর্তি । ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো  হয়ে যাচ্ছে সেনাভর্তি গোটা বাড়ি । ... পর্দায় শুধু ধোঁয়া ... ধোঁয়া ... ধোঁয়া ! 
   পাঠক-দর্শক , এরপরের পর্বটিই এই কালজয়ী চলচ্চিত্রের শেষতম পর্ব , " Rendezvous with the squadron " । এটি দেখেই এই ছবি দেখা শেষ করবো আমরা । আসুন , দেখার ফাঁকে একটু সাইডটক্ হয়ে যাক । ... যে যাই আপত্তি করুক , একটুআধটু সাইডটক্ ছাড়া বাপু হলে বসে সিনেমা দেখা হয় না । 

                      

                              *          *          *           * 

    সমুদ্রের ছোট-বড় ঢেউ ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে একখানা নৌকায় আইজেনস্টাইন , আলেকজান্দ্রভ ও টিসে । আজ চারদিন পার হয়ে পাঁচদিনে পা রাখল ভোরবেলা তাদের এই সমুদ্রঅভিযান । লক্ষ্য - কুয়াশা এবং তার ভেতর দিয়ে রোদদূরের চুঁইয়ে পড়া দৃশ্য সমুদ্রে ভাসতে থাকা জাহাজ থেকে ঠিক যেমনটি লাগে অবিকল সেই দৃশ্য তোলা । চারদিনে সফল হওয়া যায় নি । আজ পঞ্চম দিন । ... টিসে : " আজও যদি না হয় , তো " ? 
আলেকজান্দ্রভ : " আবার কাল "। 
টিসে : " কিন্তু এভাবে কতদিন ? রোজ চার রুবল্ করে নৌকাভাড়া নিচ্ছে " । 
আইজেনস্টাইন : " বন্ধু এডোয়ার্ড , বহু বাধার ধাপ পেরিয়ে সবকিছু মনোমত করতে পেরেছি , আর এই সামান্য ব্যাপারে হেরে যাবো ? কিছুতেই না । দরকার হলে অনন্তকাল ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে রাজি " । 
আলেকজান্দ্রভ : " আপনি তো পোটেমকিনের মত জাহাজ পাওয়া যাবে কিনা , সে' নিয়েও খুব চিন্তা করছিলেন " ! 
আইজেনস্টাইন : " হ্যাঁ , ন্যুনে আমার মাথায় একদিন মাঝরাত্তিরে এই চিন্তাটা ঢুকিয়ে দিয়ে যায় "। 
আলেকজান্দ্রভ : " বেঠিক কোনো ভাবনা কিন্তু ঢোকায়নি ন্যুনে ! অবশেষে পাওয়াও তো গেল " ! 
আইজেনস্টাইন ( মৃদু হাসি ) : " কপাল ভালো আমাদের , তাই পেলাম । একটাই মাত্র সে' আমলের যুদ্ধজাহাজ বেঁচে ছিল । তাও তো মেরামত করতে রঙ করতে প্রচুর খরচা হয়ে গেল । ... আর আপনি তো জানেন , শুধু কী জাহাজ পাওয়ার সমস্যা ? জাহাজের ডেকে শ্রমিকদের দাঁড় করিয়ে ঢেকে গুলি করতে বলার জন্য যে ত্রিপলটা ? সেইটা নিয়ে কম ঝামেলা পোহালাম " ? 
টিসে ( একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে  ) : " ত্রিপল নিয়ে কী হয়েছিল? জানি না তো ! "
আইজেনস্টাইন : শ্যুটিং দেখতে ভীড় করা মানুষের মধ্যে থেকে একজন আদালতে সত্যবিকৃতির মামলা করেছিল । সে নাকি ১৯০৫ এর বিদ্রোহে জাহাজে উপস্থিত ছিল , ত্রিপল দিয়ে ঢেকে গুলি করতে বলার কোনো ঘটনা নাকি বাস্তবে ঘটেনি । ... ( আলেকজান্দ্রভের দিকে তাকিয়ে ) জানেন তো , কত কাণ্ড করে সে' মামলা মেটালাম ! 
টিসে ( হঠাৎ চিৎকার করে ) : সার্গেই , পেয়েছি ! পেয়েছি ! আকাশের ওই কোণটার দিকে তাকান ! ওই যে ওই কোণটা ! 
আইজেনস্টাইন ( ততোধিক উত্তেজিত ভাবে ) : জলদি এডোয়ার্ড ! জলদি ! জলদি তুলুন ! শিগগীর পয়েন্ট করুন ক্যামেরা ! 

কাট্ 

লো- ভল্যুম সাইডটক্ পেছনের রো থেকে । 
প্রথম দর্শক : "  যাই বল্ , ওডেসা স্টেয়ারকেস্ দেখে এখন পরিস্কার বুঝতে পারছি , কেন একশো বছর ধরে এত এত নামী ফিল্ম-ক্রিটিক এই ওডেসা বন্দরের সিঁড়ি আর বিরাট লম্বা শোকমিছিলের শিল্পসম্মত দেখানোর ভঙ্গী নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় , সেমিনারে আলোচনার পর আলোচনা চালিয়ে গেছেন " !
দ্বিতীয় দর্শক : " আইজেনস্টাইন নিজেই কি বলে গেছেন জানিস তো ? সিঁড়ির চাতালের মতো ধাপগুলো আর তার ওপর মানুষের পায়ের যে সাপের মতো মিছিল - তার বেশির ভাগ দৃশ্যগুলোই কখন ক্লোজআপ কখন লঙশট্ , তার ব্যবহার নাকি শ্যুটিংয়ে সময় সময় তার হঠাৎ ঠিক করে ফেলা । বেশিরভাগই প্রি-প্ল্যানড্ নয় " । 
প্রথম দর্শক : " বলিস কী রে ! ... এই যদি সত্যি হয় তো পৃথিবীতে ওনার প্রতিভার বোধহয় কোনো দ্বিতীয় হয় না ! সেনার গুলিতে মানুষের লুটিয়ে পড়া আর ছুটোছুটির প্রতিটা শট্ ওডেসার ওই লম্বাচওড়া সিঁড়ির ধাপে কেমন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল , দেখেছিস ? এইসব ক্লোজআপ-লঙশট্ যদি স্পটে দাঁড়িয়ে চটজলদি নেওয়া সিদ্ধান্ত হয় , তো ... "
দ্বিতীয় দর্শক : " বিশেষ করে ক্লোজআপের ব্যবহারের কথা তো বলতেই হয় । শুধু ওডেসা অংশে কেন ? গোটা ' ... পোটেমকিন ' জুড়ে । আমাদের মতো প্রত্যেকটা মানুষের ভেতরের অনুভূতির জোরালো জায়গাগুলো বিভিন্ন রূপকে সিম্বলে কী অসাধারণ ভাবে পর্দায় এনেছে , বল তো ! ... ধর্ ডাক্তার স্মিরনভকে জলে ছুঁড়ে ফেলার দৃশ্যটা ! ... ডাক্তারের অসহায় অবস্থার দূর্দান্ত প্রতীক ক্লোজআপে ওর নাকের ওপর দিয়ে ঝুলে পড়া চশমাটা ! " । 
প্রথম দর্শক : " আইজেনস্টাইন আইজেনস্টাইনই , যে দেশে যত বড় পরিচালকই আসুক না কেন " ! 
দ্বিতীয় দর্শক : " সে আর বলতে ? ... তবে তুই বিপ্লব-পরবর্তী রাশিয়ায় আইজেনস্টাইন আর ' ... পোটেমকিন ' এর পূর্ববর্তী আর সমসাময়িকদের মধ্যে কুলেশভ্ আর পুদভকিনকে আলোচনা থেকে একেবারে বাদ দিতে পারিস না "। 
প্রথম দর্শক : " কীরকম ? ... কীরকম ? ... আমি তো যদ্দূর জানি , কুলেশভের আগের রুশ চলচ্চিত্র শুধুমাত্র  বিপ্লবের বাস্তবতা আর বাস্তব অভিজ্ঞতা - এই দু'য়ের  মিশেল । কুলেশভই তার বাইরে বেরিয়ে এসে চলচ্চিত্রে সৌন্দর্যতত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা । ... এছাড়া আর কি ?... আইজেনস্টাইনের সঙ্গে তার কিসের সম্পর্ক " ? 
দ্বিতীয় দর্শক : " সম্পর্কর চেয়েও বড় কথা আইজেনস্টাইন সবদিক দিয়েই কুলেশভ-ছবি কে এগিয়ে নিয়ে গেছেন । রাশিয়ায় চলচ্চিত্র নাটক সবই তখন প্রধানতঃ উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে । সেই উপন্যাসভিত্তিক চলচ্চিত্রে কুলেশভ প্রথম নিয়ে এলেন মন্তাজসৌন্দর্য্য । ফলতঃ যেটা ঘটলো , চলচ্চিত্র আর শুধু উপন্যাসের পর্দায়ন হয়ে থাকল না , হয়ে উঠল একেবারে আলাদা একটা শিল্পসৌন্দর্য্য প্রকাশের মাধ্যম " । 
প্রথম দর্শক : " আর আইজেনস্টাইন " ? 
দ্বিতীয় দর্শক : " আইজেনস্টাইন তার পরে এসে ভীষণ সাফল্যের সঙ্গে যেটা করতে পারলেন , সেটা হল - চলচ্চিত্রকে এই উপন্যাসভিত্তিকতা থেকে পুরোপুরি বার করে আনা । ওনার হাতে পড়ে চলচ্চিত্র হয়ে উঠল বিপ্লবের ইতিহাসে বিভিন্ন স্মরণীয় ঘটনাভিত্তিক । সঙ্গে যুক্ত হল মন্তাজের তার নিজস্ব স্টাইল " ।  
প্রথম দর্শক : " আমি শুনেছিলাম যে পুদভকিন নাকি মন্তাজের ব্যাপারে আইজেনস্টাইনকে কুলেশভের ' সরাসরি শিষ্য ' বলেছিলেন " । 
দ্বিতীয় দর্শক : " বলেছিলেন । ... কিন্তু খুঁটিয়ে দেখার পর বোঝা যায় কুলেশভের মন্তাজ আর আইজেনস্টাইনের মন্তাজের নন্দনতত্ত্ব একেবারেই আলাদা । ... মন্তাজ বলে কাকে জানিস তো ? " 
প্রথম দর্শক : " অবশ্যই ।  মন্তাজ এডিটিংয়ের একটা বিশেষ কায়দা । ... দুটো আলাদা ভাবনা বা আলাদা খণ্ডদৃশ্য সম্পাদনার মাধ্যমে একই দৃশ্যে পরিণত করতে পারা " । 
দ্বিতীয় দর্শক : " ঠিক তাই । ... কুলেশভ-মন্তাজের এই দুই খণ্ডাংশের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র হলো ' সুসম্পর্কের সংযোগ ' । সেখানে আইজেনস্টাইন-মন্তাজের দু'টি খণ্ডাংশের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র হলো ' দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের সংঘর্ষ ' " । 
প্রথম দর্শক : " আর এই সংঘর্ষ বা collision এর দৃশ্যদুটো যখন শিল্পীভাবনার অতিগভীরতায় মিলেমিশে একদৃশ্য হয় , তখন তার এফেক্ট যে কী মারাত্মক,   ওডেসা স্টেয়ারকেসে নার্সের সেই চশমার মন্তাজ বোধহয় তার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ " । 
দ্বিতীয় দর্শক : " এক্কেবারে ।  সেই কারণেই ব্যাটলশিপ পোটেমকিন কে শুধুমাত্র বিপ্লব প্রদর্শনের চলচ্চিত্র হিসেবে দেখাটা ঠিক হবে না , মন্তাজতত্ত্বের নতুন ধারা মিশে এ' চলচ্চিত্র আসলে চলচ্চিত্র-ইতিহাসে সোনার অক্ষরে ঠাঁই পাওয়া এক ' বৈপ্লবিক চলচ্চিত্র ' " । 
প্রথম দর্শক : পুদভকিন নিয়ে কী বলছিলি ? 
দ্বিতীয় দর্শক : তুই পুদভকিন সম্পর্কে কী জানিস , আগে বল্ ! 
প্রথম দর্শক : আমি যতদূর জানি , পুদভকিন আইজেনস্টাইনের ওই সময়েরই আর এক রুশ পরিচালক । ম্যাক্সিম গোর্কির " মা " উপন্যাসকে চলচ্চিত্রায়িত করেছিলেন পুদভকিন । ' ... পোটেমকিন ' এর পাশাপাশি সেইসময়ের আর এক বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্র হল " মা " । 
দ্বিতীয় দর্শক : একদমই তাই । ব্যাটলশিপ পোটেমকিন নিয়ে কথাবার্তা বলাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি পুদভকিনের কথা একটুও বলা না হয় । 
প্রথম দর্শক : আলাদাটা কোথায় দু'জনে ? 
দ্বিতীয় দর্শক : একদম প্রধান পার্থক্য হলো আইজেনস্টাইন-চলচ্চিত্রে শেষপর্যন্ত কোনো ব্যক্তি নায়ক নন , নায়ক জনতা , জনতার আশাআকাঙ্খা । ব্যাটলশিপ পোটেমকিনে বিপ্লবের নেতা ভ্যাকুলিঞ্চুকের ছবির দ্বিতীয় অংশেই মৃত্যু । ... অন্যদিকে পুদভকিনের " মা " তেও বিপুল সংখ্যক রুশ জনগণের আকাঙ্ক্ষাই ছড়িয়ে থেকেছে , কিন্তু বিশেষ এক নায়ককে চিত্রিত করার মাধ্যমে । ... 
প্রথম দর্শক : আমি শুনেছিলাম পুদভকিন ও আইজেনস্টাইন দু'জনেই দু'জনের ছবি সম্পর্কে সর্বত্র বিরাট উচ্ছ্বাস দেখিয়েছেন । 
দ্বিতীয় দর্শক : কেন ? তুই ব্যাটলশিপ পোটেমকিন সম্পর্কে পুদভকিনের এই কথাগুলো পড়িস নি ? - " নির্মাণে পরিবেশ যেভাবে বিস্ফারিত হওয়ার কথা ছিল , আইজেনস্টাইন সার্থক এক শিল্পী-স্রষ্টার মতো সে বিস্ফোরক পরিবেশকে এ' ছবিতে অনায়াস দক্ষতায় ব্যবহার করতে পেরেছেন " । 
প্রথম দর্শক : না রে , জানতাম না । তবে এটাই কিন্তু  খাঁটি সত্যি কথা । বজ্রপাত আর বিদ্যুৎ একসঙ্গে মিলেমিশে পোটেমকিনের এই বিস্ফোরণ ।  আইজেনস্টাইনের বিরাট প্রতিভা আর রাশিয়ায় জাররাজত্বে শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের চূড়ান্ত লাঞ্ছনার মধ্যে ১৯০৫ এর নৌ-বিদ্রোহের মতো অভূতপূর্ব একটা ঘটনা । এই দুইয়ে ঠিকঠাক  মিলে ... 
দ্বিতীয় দর্শক : আসলে কী জানিস ? আমার যেটা বরাবর মনে হয় , পৃথিবীর ইতিহাস - মানুষের অনন্ত জীবনপ্রবাহে শ্রমদানের ইতিহাস , তাকে ঘিরে সংঘর্ষ ও রক্তপাতের ইতিহাস । ... এই চিরকালীন এই শাশ্বত সত্য যখন একজন প্রকৃত শিল্পী তার বিবেকের মধ্যে আত্মস্থ করেন , তখন তার শিল্পকর্ম জনগণের সাধারণ আবেগকে অন্ততঃপক্ষে কিছুটা " এ' আমারই গৌরব , আমারই সম্মান , আমারই সাফল্যের গর্ব "র অনুভূতিতে কত দ্রুত জারিত করে ফেলতে পারে , ব্যাটলশিপ পোটেমকিনের রাশিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপের , ইউরোপ ছাড়িয়ে আমেরিকার বিদগ্ধ থেকে সাধারণ চলচ্চিত্রমোদীর অজস্র প্রশংসায় প্রশংসিত হয়ে ফের ' রাশিয়ার ছবি ' হয়ে রাশিয়ায় ফিরে আসা তার নিশ্চিত প্রমাণ । 
প্রথম দর্শক : সত্যিই তাই । পুরোপুরি একমত । ... কিন্তু আর নয় । অনেক বকবক্ হলো । সবাই বিরক্ত হচ্ছে হয়তো । এবার চুপ । ... বাকি ছবিটা দ্যাখ্ , " Rendezvous with the squadron " । 
দ্বিতীয় দর্শক : দাঁড়া , তার আগে তোকে হোয়াটস্ অ্যাপে  একটা ছোট ইউটিউব ভিডিও পাঠাই  । তোর কাছে হেডফোন আছে ? 
প্রথম দর্শক : আছে । 
দ্বিতীয় দর্শক : কানে লাগা । চুপ করে ভিডিওটা দ্যাখ্ আর শোন্ । 

                            *            *          *           * 
   প্রায় তিন বছরের দীর্ঘ সফরে ব্রিটেন , আমেরিকা ( হলিউড ) , বার্লিন ঘুরে আইজেনস্টাইন পৌঁছলেন প্যারিসে । ... সাল ১৯৩০  । ... প্যারিসে এক সন্ধ্যায় একটি বাড়ির প্রায়ান্ধকার ঘরে দুই ছায়ামানুষের সাক্ষাৎ । ... ঘরে অতি হালকাপলকা একখানা মোমবাতিজ্বলা আলো । একজন ছায়াছায়া মানুষ আগে থেকেই বসে আছেন চেয়ারে । খোদ গৃহকর্তা । সামনে ফাঁকা আর একটা চেয়ার । .... দরজা আলতো ধাক্কায় কিছুটা ফাঁক করে বাইরে থেকে অন্য  আর এক ছায়ামানুষ মুখ বাড়িয়ে - : " আসতে পারি ? " 
গৃহকর্তা সাগ্রহে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে - : আসুন আসুন আসুন ।  ... পোটেমকিন এর বিশ্ববন্দিত পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছে আমার বহুদিনের ! আসুন, ভেতরে আসুন মি: আইজেনস্টাইন , সামনের ওই চেয়ারে আসনগ্রহণ করুন । 
   অতঃপর সেই অন্ধকার ঘরে দুই ছায়ামানুষের কথোপকথন .... 
আগন্তুক - : ' ইউলিসিস ' এর স্রষ্টার সঙ্গে দেখা করার , কথা বলার , মত বিনিময় করার অভিপ্রায় আমারও দীর্ঘদিনের মি : জয়েস । ... ঘরের বাতি আর একটু উজ্জ্বল হতে পারে না ? 
গৃহকর্তা ( সামান্য হাসির আওয়াজ) - : কেন ? এই তো বেশ ! পোটেমকিন আর ইউলিসিসের ছায়া পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে । ... এই তো মাটির ওপরে দীর্ঘ ঘন কালো আপনি ! জায়গায় জায়গায় আলো ফেলে দিব্যি আমার মতো করে উজ্জ্বল করে নিচ্ছি আমি । 
আইজেনস্টাইন : হুমম , বুঝলাম ! 
জয়েস ( আবারও মৃদু হাসির শব্দ ) : কী বুঝলেন ? 
আইজেনস্টাইন : বুঝলাম ঠিক নয় , আসল কথাটা হচ্ছে মিললো ।  
জয়েস : কী মিললো মি : আইজেনস্টাইন ? 
আইজেনস্টাইন : ইউলিসিস পড়ে তাঁর স্রষ্টার অন্তর্গভীরতা ঠিক যতখানি বলে ধারণা ছিল আমার , সেইটা । .... যাইহোক , এখন বলুন আমার সঙ্গে যে আপনার সাক্ষাতের ইচ্ছে বহুদিনের বললেন , সেটা কেন ? 
জয়েস : একটা গূঢ় কারণ অবশ্যই আছে । বলতে পারেন , একটা ভেবে দেখার বেয়াড়া অনুরোধ । কিন্তু তারও আগে আমি আপনার " ব্যাটলশিপ পোটেমকিন " সম্পর্কে অনন্ত মুগ্ধতা জানাতে চাই । পোটেমকিনের মত বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্রের পরিচালককে একবার চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিলাম , সামান্য হলেও কথাবার্তা বলতে চেয়েছিলাম । 
আইজেনস্টাইন : " বিশ্ববন্দিত বা বিশ্বনিন্দিত " এভাবে বললেই বোধহয় ঠিক ছিল ( হাসতে হাসতে ) । ... যাইহোক , জেমস জয়েসের মত মানুষের কাছ থেকে এ হেন স্বীকৃতি পাওয়া আমার কাছেও পরম সৌভাগ্যের । আমার অশেষ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানবেন , ইউলিসিসের জনক । .... আর আপনার " গূঢ় কারণ " বা " বেয়াড়া অনুরোধ " টি সম্ভবতঃ আমি অনুমান করতে পারছি ( আবার হাসি ) । কতকটা আমিও আমার নিজ আগ্রহে ঠিক এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতেই তড়িঘড়ি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আপনার কাছে এসেছি । ... কিন্তু তবুও মি: জয়েস , আমি চাই আপনিই আজকের এই মহাকথনের স্রষ্টা হিসেবে আমার কাছে প্রথম নিজের মনোবাসনা ব্যক্ত করুন । 
জয়েস : বেশ । তাইই  হোক তবে । আমার ইচ্ছে আপনি , সার্গেই আইজেনস্টাইন , আমার ইউলিসিসকে চলচ্চিত্রে রূপ দিন । আমার বারবার যেটা মনে হয় , সবসময় যেটা মনে হয় , আপনিই এর যোগ্যতম লোক । 
আইজেনস্টাইন : জানতাম আপনি এটাই বলবেন । আর আগেই বলেছি কতকটা আমিও ঠিক আপনার কাছে এই প্রস্তাব নিয়েই আলোচনা করতে এসেছি । ইউলিসিস আমার অত্যন্ত প্রিয় বই । কিন্তু  আমি দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত দ্বিধায় ছিলাম মি : জয়েস , যে লিওপোল্ড ব্লুম , স্টিফেন ডেডালাস কে চলচ্চিত্রায়িত করার যোগ্যতম লোক আমি কিনা ! আপনার ওই mathematical catechism এর ' ইথাকা ' অংশ , যাকে আপনিই বলেছেন বইয়ের ' কুৎসিততম অংশ ' , তাকে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার সত্যিই যোগ্য লোক আমি কিনা । তবে অনেক ভাবনাচিন্তা করে আপাততঃ সে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলেছি । এগোতে চাই আমি ' ইউলিসিস ' নিয়ে । ... এবার আপনি বলুন মি : জয়েস আপনিই বা আমার কথা ভেবেছেন কেন ? 
জেমস জয়েস : খুব স্পষ্টভাবেই বলছি , বারংবার আপনার " ব্যাটলশিপ পোটেমকিন " দেখে । ... কোনো ন্যারেটার ছাড়াই আপনার শুধু দৃশ্য দেখানোর অসাধারণ সূক্ষ্ম শৈল্পিক ভঙ্গীমায় ফুটে ওঠা inner film monologue দেখে , ... গোটা ছবি জুড়ে বিশেষতঃ ওডেসা স্টেয়ারকেস অংশে আপনার মন্তাজের অবিস্মরণীয় সব কাজ দেখে , ... ফিল্মে সাবজেক্ট এবং অবজেক্টের মধ্যে সম্পর্ককে আপনার পুরোপুরি dissolute করে দেওয়ার ক্ষমতা দেখে ! ... কী অসাধারণ টেকনিকে যে ব্যাটলশিপ পোটেমকিনে আপনি আত্মবাদীতা ও নৈর্ব্যক্তিকতাকে সম্পূর্ণ দ্রবীভূত করিয়ে মিলিয়ে মিশিয়ে দিতে পেরেছেন মি : আইজেনস্টাইন , আপনি বোধহয় নিজেও জানেন না ! ... তাছাড়া আমি শুনেছি এরপর নাকি আপনি মার্কসের ক্যাপিটাল কে ফিল্ম করার কথা ভাবছেন ? ... ঘটনাবিহীন গল্পবিহীন ওই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তত্ত্বকে ফিল্ম করা তো দূরের কথা , যিনি ফিল্ম করার ভাবনাটুকুও ভাবতে পারেন , তার হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া আমার ইউলিসিসকে চলচ্চিত্রায়িত করার স্বপ্ন আমি আর কিভাবে দেখতে পারি মি : আইজেনস্টাইন ?
আইজেনস্টাইন : হ্যাঁ, পোটেমকিনের পর সত্যিই মার্কসের " ক্যাপিটাল " কে ছবি করার একটা সিদ্ধান্ত আমি প্রায় নিয়েই ফেলেছি । কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য হচ্ছি যে  আপনি এত দূরে বসে সে খবর পেলেন কিভাবে ?  
জেমস জয়েস ( আবারও মৃদু হেসে ) : পেতে হয় মিঃ আইজেনস্টাইন ! আর আপনার মতো বিখ্যাত লোকের  খবর তো হাওয়ায় ভাসে ! ... যাক শুনুন , ওয়ার্নার ব্রাদার প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমায় যে ইউলিসিস তারা চলচ্চিত্রায়িত করতে চায় । আমি এক কথায় সে প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছি । আমার একবারের তরেও মনে হয়নি যে ওরা যোগ্য । আমি অপেক্ষা করে আছি আপনার জন্য । এখন আপনি যদি এর দায়িত্ব নেন্ আমার থেকে বেশি সুখী বোধহয় আর কেউ হবে না ।
আইজেনস্টাইন : আপনাকে বলি , অলরেডি 'শ' এর মতো নাট্যকার আমাকে তার " আর্মস্ অ্যাণ্ড দ্য ম্যান " নাটকটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন । ... দ্য গ্রেট পোয়েট , ওয়ার্ল্ড পোয়েট ,  ট্যাগোর  ইণ্ডিয়া থেকে এসে আমার বান্ধবীর কাছে জানিয়ে গ্যাছেন তাঁর একটি কাজ নিয়ে যদি আমার পক্ষে ছবি করা সম্ভব হয় ! ... বাট্ একদম মনের কথা বলছি , আই রিয়েলি প্রেফার " ইউলিসিস " । ... কেন জানেন ? আমার বরাবর মনে হয়েছে ইউলিসিসকে ছবি করার মাধ্যমে আমি একটা বড়সড় এক্সপেরিমেন্ট করতে পারবো যে ফিল্মকে আর্টের অন্যান্য ফর্মের সঙ্গে লিঙ্কআপ কিভাবে করা যায় ! বা বলা ভালো , আদৌ করা সম্ভব কিনা ! 
জয়েস : তাহলে অতঃপর ? 
আইজেনস্টাইন ( উঠে দাঁড়িয়ে হেসে ) : ঠিকসময়ে আপনি খবর পাবেন মি: জয়েস । চিন্তা করবেন না । ... আপাততঃ আসি আজ । আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই । 
জেমস জয়েস : নিশ্চয়ই । ... আশায় রইলাম । 
দুই ছায়ামানুষের করমর্দন । এক ছায়ামানুষ বেরিয়ে গেলেন দরজা খুলে । 

কাট্ 

প্রথম দর্শক : দেখলাম রে তোর পাঠানো ভিডিও । ... কিন্তু আর নয় , এবার ছবিটা দেখা শেষ করি আগে । পঞ্চম তথা শেষ পর্ব .... 

                              *          *        *         * 

           ★    Rendezvous with the squadron 
                 .............................................................

জাহাজে সন্ধে অবধি চলতে লাগল মিটিং । সেই প্রথম দৃশ্যের পর দীর্ঘক্ষণ বাদে পর্দায় দেখা গেল ম্যাতুশেঙ্কুকে । হাত নেড়ে উত্তেজিত ভাবে বক্তৃতা - আমাদের ওডেসায় জাহাজ নিয়ে গিয়ে ওঠাতেই হবে । ওখানকার ভীতসন্ত্রস্ত কমরেডরা আমাদের মতো সংগ্রামীদের জন্য অপেক্ষা করছে । কিন্তু কী উপায়ে  ?  অ্যাডমিরালের যুদ্ধজাহাজ যে জলে সতর্কভাবে পাহারা দিচ্ছে । ... অবশেষে জাহাজ জুড়ে উপস্থিত থাকা সমস্ত মানুষ সমবেতভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে তারা জারের স্কোয়াড্রনের  সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে যাবে , তাতে যা হওয়ার হবে । হাত তুলে জাহাজের প্রত্যেকে সমর্থন করল  সিদ্ধান্ত । 
   অত্যন্ত উদ্বিগ্নতার সঙ্গে দিন শেষ হয়ে রাত্রি এল । অনবদ্য ক্যামেরার কাজে পর্দায় মাঝসমুদ্রের রাত্রি । আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘের মধ্যে দিয়ে চাঁদের লম্বা আলোর ফালি জলের ওপর পড়ে আশ্চর্য রূপালী রঙে চিকচিক ! আবহসঙ্গীতে অত্যন্ত মৃদুলয়ে বাতাস বয়ে চলার শোঁ শোঁ । সাদা আলোর লম্বা ফালির ওপর দিয়ে বয়ে চলা নীরব সমুদ্রস্রোত । কয়েকজন ছাড়া সমস্ত জাহাজ নিদ্রামগ্ন । যে দু'চারজন জেগে , তারা জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বহুদূর ওডেসার দিকে দৃষ্টি ফেলে দেখার চেষ্টা করছে যে অ্যাডমিরালের স্কোয়াড্রন দেখতে পাওয়া যায় কিনা । চরাচর জুড়ে অনন্ত নৈ:শব্দের মধ্যেই জাহাজের কেবিনঘরে একগুচ্ছ স্পিডোমিটারের কাঁটা দেখালো ক্যামেরা , দেখালো দূরে সমুদ্রের ওপর অন্ধকারে জোরালো সার্চলাইট ঘুরিয়ে আলো ফেলার দৃশ্য । ... সাবটাইটেলে " The squadron was sneaking up in the darkness " । ... জলের ওপর চাঁদের আলোর কাঁপা কাঁপা নড়াচড়া । ... হঠাৎ আবহসঙ্গীত দ্রুতলয়ে । এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো ম্যাতুশেঙ্কু । উঠে দাঁড়ালো আরো অনেকে । দূরসমুদ্রে দৃষ্টি ফেলা হল , কিন্তু কিছু এখনো দেখা যাচ্ছে না । অন্ধকারে ডেকের ওপর বন্দুক হাতে সতর্ক পাহারায় ছায়া-ছায়া মানুষের নড়াচড়া । জাহাজের একেবারে উচ্চতম অংশে দাঁড়ানোর যে সামান্য জায়গাটুকু , সেখানে দাঁড়িয়ে দূরবীনে চোখ লাগিয়ে একজন । ... আলেকজাণ্ডার টিসের ক্যামেরা জ্যোৎস্নালোকিত জলের ওপর দিয়ে সরছে দূর দিগন্তরেখার দিকে । 
   একেবারে শেষপ্রান্তে এইবার হঠাৎ দেখা গেল ছোট্ট ছোট্ট দুটো বিন্দুর মতো জাহাজ । সাবটাইটেলে : " squadron on the horizon " । নিমেষে চাঞ্চল্য । ওপর থেকে দৌড়ে এসে খবরটা দেওয়া হল নীচের সবাইকে । ঘুম ভেঙে প্রত্যেকে উত্তেজনায় টানটান । দুই তরুণ শ্রমিক-নাবিককে দেখা গেল উষ্ণ আলিঙ্গনে পরস্পরের কাছ থেকে শেষবিদায় নিয়ে একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে । ... ক্যামেরা আর একবার দেখালো দূরে দুটো জাহাজ । ... এখন আরও একটু স্পষ্ট । ... বেজে উঠল যুদ্ধের বিউগল । গোটা জাহাজ জুড়ে হুড়োহুড়ি ব্যস্ততা । ..." prepare for the battle "।... সর্বত্র ছুটোছুটি । কয়েকজনকে দেখা গেল হাতে গোলা নিয়ে কামানের দিকে ছুটতে । কয়েকজন দৌড়ে কেবিনঘরের দায়িত্ব নিল । পর্দা ম্যাতুশেঙ্কুকে দেখাল কন্ট্রোল-ফোনের মাধ্যমে কেবিনের কাউকে কিছু নির্দেশ দিতে । প্রায় সমস্ত নাবিক-শ্রমিক হাতে হাতে কামানের গোলা নিয়ে ছুটছে বড় বড় কামানগুলোর দিকে । চাদর পেতে সেগুলো পাশে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে । ... রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অনিবার্য প্রস্তুতি । 
   সাবটাইটেলে : " full speed " । ... কেবিনঘরের প্রতিটি যন্ত্রের দ্রুতগতি চলাচল । কন্ট্রোলরুমের আভ্যন্তরীণ ফোনে ম্যাতুশেঙ্কু । অসম্ভব দ্রুততায় জল কেটে এগিয়ে চলেছে জাহাজ । গম্ভীর আবহসঙ্গীতও অত্যন্ত দ্রুতলয়ে । গলগল করে কালো ধোঁয়া আর তার ফাঁক দিয়ে  সাদা আকাশের অনবদ্য চিত্রায়ন । ... আবহসঙ্গীত গম্ভীরতর । জাহাজের মাথায় বসানো কামানের মোটা মোটা নলগুলো এইবার ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করেছে লক্ষ্যের দিকে । পর্দায় একেবারে কাছে স্কোয়াড্রনের যুদ্ধজাহাজ । সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে মোট পাঁচটি । ... " Hearts forward " । দু'দিকের জাহাজেই যে যার পজিশনে । 
   ... " Top speed " । ... অদ্ভূত এক ঝনঝনে আবহসঙ্গীত । পোটেমকিন তার চূড়ান্ত গতিবেগে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে । ... " Potemkin and destroyer no :- 267 " , মুখোমুখি । ... সবকটি কামানে গোলা ঢুকিয়ে বিপ্লবীবাহিনী প্রস্তুত । এক মুহূর্তের জন্য পর্দাজুড়ে এতগুলো জাহাজের কালো ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশ । .... সাবটাইটেলে ম্যাতুশেঙ্কুর নির্দেশ : " Give the signal , join us " । ... পোটেমকিনের সর্বোচ্চ উচ্চতায় দাঁড়িয়ে একজনকে দেখা গেল দু'হাতে পতাকা নাড়াচ্ছে । ... " join " .... " us " । পর্দায় এবার একই ফ্রেমে দু'তরফেরই জাহাজ । 
   হঠাৎই আবহসঙ্গীত অসম্ভব স্লো । " the enemy is within firing range " । পোটেমকিনে প্রত্যেক বিদ্রোহী প্রস্তুত । স্থির দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে অ্যাডমিরালের স্কোয়াড্রনের দিকে । ... " All against one " । না , " One against all " । ... পর্দায় স্কোয়াড্রনের যুদ্ধজাহাজগুলোর কামানের নলের মুখ ঘুরতে শুরু করল পোটেমকিনের দিকে । আর একমুহূর্ত ঠিক বাকি চূড়ান্ত সংঘাতসূচনার । ... " shoot ! ... or die ! 
   আর ঠিক তক্ষুনি ঘটল সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা ! অ্যাডমিরালের স্কোয়াড্রনের প্রত্যেকটি জাহাজের প্রত্যেকটি কামানের মুখ পোটেমকিনের দিক থেকে সরে উঠে গেল ঊর্ধ্বে আকাশের দিকে । ... " Brothers ! we are brothers ! " ... পর্দা দেখালো উচ্ছ্বাসে আনন্দে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছেন পোটেমকিনের বিদ্রোহীরা । ... ক্লোজআপে জাহাজের মাথায় পতপত করে উড়তে থাকা লাল পতাকা ! ... দু'দিকের মুখোমুখি সবকটি জাহাজের ডেক জুড়ে শুধু মানুষ আর মানুষ ! অবিশ্রান্তভাবে হাত নেড়ে চলেছে পরস্পরের দিকে । শুধু মানুষের মাথা , ... সবার মুখে হাসি আর আনন্দ উল্লাস ! ... " Above the heads of the tsar's admirals , thundered a brotherly hurrah " । ... সবকটি জাহাজে আনন্দ উচ্ছ্বাস আর মানুষের হাতনাড়া রুমালনাড়ার মধ্যে দিয়ে " proudly waving the red flag of victory , without a single shot the rebellious battleship passed through the rows of the squadron " । ... বিনাবাধায় বিনারক্তপাতে জাহাজ ভিড়বে ওডেসায় , উদ্ধার হবে বিদ্রোহী অত্যাচারিত সাথী কমরেডরা । ... অনন্ত সমুদ্রস্পর্শ করা আকাশ জুড়ে লাল ! ... লাল লাল আর লাল ! ...এগিয়ে চলেছে পোটেমকিন ডেকের ওপর দাঁড়ানো হাজার মানুষের জয়ধ্বনির মধ্যে দিয়ে । ডেকের তলার দিকের কালো অংশ ধীরে ধীরে বড় হয়ে গ্রাস করে নিল গোটা পর্দা । 
   " THE END " । 

                             *         *          *           * 

   তবে এইভাবে বাঁচার অধিকার বুঝে নিতে হয় ? " ব্রাদার্স ! উই আর ব্রাদার্স ! " এভাবে অবচেতনে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে সেনা থেকে সাধারণের মধ্যে ? ...   নিছক বইভুক্ত তথ্য ও ঘটনায় গুরুত্ব না দিয়ে হৃদয়-মস্তিষ্ক যদি সামান্যতমও ইতিহাস অনুসরণ করে , তো নিশ্চিত খেয়াল করবে সভ্যতা ও তাকে ঘিরে মানুষের এই অনন্ত যাত্রাপথের ইতিহাস আসলে একটি শ্রেণীর প্রভুত্ব বিস্তারের ইতিহাস , দমন পীড়ন আর হত্যার ইতিহাস ।  এই প্রভুত্ব  বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে , প্রাকৃতিক সমস্ত সম্পদ আপন ভোগবিলাসের কাজে লাগানোর মাধ্যম হিসেবে , অনিবার্যভাবে উঠে আসে একটাই তত্ত্ব একটাই কর্ম - পুঁজির বল্গাহীন প্রসারের চেষ্টা । এই চেষ্টারই অবয়বের হাত-পা-চোখ-মুখ বোধ'য় সেনা থেকে কর্মচারী , শ্রমিক থেকে সাধারণ । ... এই পুঁজিপ্রসার প্রভুত্বপ্রসার চেষ্টায় প্রাকৃতিক নিয়মেই একসময় অবধারিত হয়ে ওঠে সংঘাত । নিত্য সে সংঘাত-সংঘর্ষ দিনের সূচনায়-সমাপ্তিসময়ে প্রকৃতিগতভাবে আকাশও সমর্থন করে লাল হয়ে ওঠে । সূর্যাস্তে লাল মিলিয়ে গেলে ঘরে ঘরে জ্বলতে থাকে আলো । ... কৃত্রিম , তৈরি করা । ... কিছু সময় ক্লান্ত নড়াচড়া শেষে সে' বাতি নিভিয়ে গভীর নিদ্রায় ডুবে যায় প্রাণ । ... আর ঠিক সেই সময়ে সেই অন্ধকার সময়ে চিরন্তন ইতিহাসপথে , শোষণ বঞ্চনার পথে , উৎপীড়ন নৈরাজ্যের পথে , বিপুলা এ' পৃথিবীর কোনো না কোনো কোণে , কোনো পর্ণকুটিরে কিংবা জমকালো বহুতলে , প্রত্যন্ত গ্রামে কিংবা শহুরে বস্তিতে  শ্রমজীবী মানুষের হৃদয়ভাষা হয়ে হয়ত উঠে আসে কালি ও কলম , মঞ্চে নড়াচড়া , সেলুলয়েডের বুকে ছাপা দৃশ্যের চিত্রনাট্য । আসে সার্গেই আইজেনস্টাইনের মতো মহাশিল্পী মহামানব , আসে সঠিক অর্থযুক্ত শিল্পবিপ্লব ( আর্ট রেভোলিউশন্ ) , হঠাৎই কোনো মধ্যরাতে হৃদয়ে আচমকা ভেসে ওঠে এমনই ' ব্যাটলশিপ পোটেমকিন ' । ... নিদ্রার অবসানে চরাচর সেজে ওঠে আবারও । শীতের  বরফরাত্রি শেষে নতুন বসন্তে আসে দিন । মানুষ রঙিন হয় । অনন্ত আকাশ থেকে রক্তিম আবীররঙ ফের গলে পড়তে থাকে পৃথিবীর বুকে । নড়েচড়ে মেহনত । কর্মে ঝরে ঘাম । শোষণে বিদ্রোহে আঘাতে প্রত্যাঘাতে শ্রমিক রক্তাক্ত হয় । প্রাকৃতিক আলতালালে ঘামরক্ত মেশা মিছিল এগোতে থাকে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ ... অফুরান রাস্তা ধরে । অনন্ত রক্তিমতায় মিশে মানুষ তৈরি করে ইতিহাস । যুগ ... কাল ... অত্যাচার অবিচার... !  সময়ের সন্ধিক্ষণ ! ... বিদ্রোহ ... প্রতিবাদ  ... ভ্যাকুলিঞ্চুক ! ... " হাজার বছর ধরে ( নিশ্চিত জেনো )   আমি ( এই ) পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে " । 
              
                                                        ( শেষ ) 

                                       ........................ 

    লেখকের কিছু কথা  : 





দীর্ঘ গদ্যপাঠে ক্লান্ত পাঠকের কাছে আরও ক্লান্তিকর এই অংশের অবতারণা না করলেও হয়তো চলতো , শুধু করা এই জন্য যে গদ্যের কিছু জায়গা পড়ে পাঠক হয়তো বা বিভ্রান্ত হতে পারেন , মনের অন্দরমহলে জেগে উঠতে পারে একাধিক প্রশ্ন । কয়েকটি কথা তাই শেষে জানিয়ে দেওয়া একান্ত আবশ্যিক বলে মনে করছি ।
১ ) এই গদ্য প্রায় শতবর্ষ স্পর্শ করা একটি রুশ  চলচ্চিত্র ও তাকে কেন্দ্র করে বিগত একশো বছরের পৃথিবীতে ঘটে চলা বিবিধ ঘটনাবলী নিয়ে লেখা একটি আলোচনা মাত্র , কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের বাণীপ্রচার কখনোই এর উদ্দেশ্য নয় ।  
২ ) গদ্যে উল্লিখিত প্রতিটি কথোপকথন বলাবাহুল্য কাল্পনিক , আবার হয়ত সত্যিও । দায়িত্ব সহকারেই বলছি , আমার বিস্তৃত পাঠ এবং তাকে ঘিরে বোধ এই কথা জানান্ দিচ্ছে যে এই সমস্ত কথোপকথনের সময় যদি কোনো অদৃশ্য রেকর্ডার সেখানে বসানো থাকত , ঠিক এই কথাগুলোই সম্ভবতঃ উঠে আসত , কিংবা এর অত্যন্ত কাছাকাছি কিছু একটা । 
৩ ) গদ্যটি লিখতে গিয়ে প্রচুর পড়তে হয়েছে , প্রচুর প্রচুর প্রচুর ... । সেই সমস্ত বই ও ওয়েবজিনের কাছে এই গদ্য লেখায় আমার ঋণ কোনোদিন ফুরোনোর নয় । কিন্তু তার  দীর্ঘ তালিকা এখানে প্রকাশ করে পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন করলাম না । বরং এইভাবে জানিয়ে রাখি - কোনো তথ্য কোনো ঘটনা কোথা থেকে পেলাম যদি কারো জানতে আগ্রহ থাকে তো আমার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করলে আশাকরি তার আগ্রহের অবসান ঘটাতে পারব । 
আর মাত্র দু'টি কথা বলে শেষ করবো । কথা নয় , তথ্য । 
৪ ) একেবারে সূচনায় উল্লেখ করা ইংরেজী লেখাটুকু ( our resistance will be long and painful ... ) মহান ভিয়েতনামী বিপ্লবী হো চি মিন এর একটি কথার অংশ । এই গদ্যে তা লেখার প্রয়োজনে নেহাতই কোট্ করা হয়েছে । ওই লেখাটুকু কোনোভাবেই মূল " ব্যাটলশিপ পোটেমকিন " ফিল্মের অন্তর্ভুক্ত নয় । 
৫ ) " এখানে চালের কল আছে / সেই কল-দানবের চাকা সাঁওতাল ছেলেমেয়েরা ... "  অংশটুকু রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠির  ' গ্রামবাসীদিগের প্রতি ' থেকে সংগৃহীত এবং এটিও শুধুমাত্র কোট্ করা হয়েছে । মূল ছবির অংশ এটি কোনোভাবেই নয় । 
                         
                        .......................... 
   

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...