রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০২৩

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে"

সজ্জ্বল দত্ত



 ৭ . 

        " And miles to go before I sleep 
          And miles to go before I sleep " 

পাঠ্যসূচিতে যখন রবার্ট ফ্রস্ট এর এ' কবিতা পড়েছিলাম , মনে আছে প্রায়ই প্রশ্ন আসত , লাইনটি দু'বার ব্যবহারের তাৎপর্য কী ? উত্তরটাও পড়তে পড়ত প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল আমাদের । জ্যোৎস্নাময় আলোমাখামাখি বনভূমির নিবিড় সৌন্দর্য কবিকে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করলেও সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে এই মুগ্ধতা কবির বেশিক্ষণ উপভোগ করার সময় নেই , তাকে যেতে হবে । লাইনটি প্রথমবার ব্যবহারের তাৎপর্য সেই সন্ধ্যায় কবিকে বিশ্রাম নেওয়ার আগে তখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে । লাইনটি দ্বিতীয়বার ব্যবহারের অর্থ জীবনের শেষবিশ্রাম নেওয়ার আগে তখনও বহু বহু পথ অতিক্রম করতে হবে কবিকে । 
 পাঠ্যবইয়ে পড়া এই লাইনদুটি উদ্ধৃত করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল কবি দেবদাস আচার্যর "উৎসবীজ" এর একেবারে শুরুটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল , তাই ।   

" আমার বাঁ হাতে আছে গোল ছোট একটি পৃথিবী
  এর মায়া-রূপে মুগ্ধ , দাঁড়িয়েছি ক্ষণিক প্রহর 
  অশান্ত যাত্রার পথে , এই সৌরজগতের দেশে । 
  বহুদূর নক্ষত্রের পথ ধরে এসেছি এখানে , 
  অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে থমকে দেখি
  উজ্জ্বল মণির দীপ্তি মহাজাগতিক অশ্রুকণা " 
 
পাশ্চাত্যের কবি বহু বহু মাইল হাঁটার পথে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন চন্দ্রালোকিত বনভূমির নিবিড় সৌন্দর্যের সামনে । আর এই বাংলার কৃষ্ণনগরের খোড়ে নদীর ধারে বসবাস করা আধুনিক কবি দেবদাস আচার্য অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে দেখছেন গোল ছোট একটা পৃথিবী, তার মুগ্ধ করা মায়ারূপ, উজ্জ্বল মণির দীপ্তি মহাজাগতিক অশ্রুকণা । 
একদিন হঠাৎ যে গ্যাসীয় পিণ্ডটি সূর্যের থেকে ছিটকে বেরিয়ে তার প্রবল আকর্ষণে চারপাশে ঘুরতে শুরু করেছিল , আজ একেবারে ঠাণ্ডা সেই পিণ্ডের মধ্যে বসে দু'হাত দু'পা আর সাদাকালো চুলে ভর্তি মাথা নিয়ে বিচিত্র এক প্রাণী হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে , দুঃখ আনন্দ শোক তাপ হাসি কান্না নিয়ে আঁকছে লিখছে খেলছে গাইছে , চন্দ্রজয়ের পর সূর্যজয় করা যায় কিনা খতিয়ে দেখছে । ... এই যে অনন্ত অনন্তকাল , এই কালের মহাসমুদ্রে ভেসে যেতে যেতে কবির প্রার্থনা -- শুধু এই জল , আলো , স্থিতি আর প্রাণবায়ুর মধ্যে আরো কিছুকাল যেন থেকে যেতে পারেন । আরো...আরো...কিছুকাল ! এই কবি দেবদাস আচার্য । কোটি কোটি বছরের পৃথিবীর মাটির সঙ্গে যিনি নাড়ির যোগাযোগ টের পান আর সেখানেই ভাসিয়ে দিতে চান নিজের সত্ত্বাকে । দেবদাসের কবিতার সবচেয়ে বড় কথা জীবনদর্শন তার কাছে স্বাভাবিক কবিতা , তাই পাঠকের সেই দর্শনের গভীরে পৌঁছানোর কাজটি অত্যন্ত সহজ বলে মনে হয় । 
সাহিত্য , সমাজ , দর্শন , অর্থনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই টিঁকে থাকার প্রধান শর্ত হচ্ছে বহু বহু বছরের চলমান জীবনপথে সে সংক্রান্ত সৃষ্টি বা তত্ত্ব এই প্রবহমানতার বা বয়ে চলার কোনো প্রাথমিক কার্যকারণ ফলাফল ইত্যাদির ওপর আলোকপাত করতে পারছে কিনা এবং সেই আলো স্রষ্টার একেবারে হৃদয়ের গভীরতম অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসছে কিনা । কবি দেবদাস আচার্যর কাব্যগ্রন্থগুলো একের পর এক পাঠ করলেই তার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি একেবারে চরমতম পারদর্শিতায় পরিস্কার হয়ে ফুটে ওঠে । 
শেষবেলায় আবার একটু খোলা যাক "সুভাষিতম" এর পাতা । 

    ১ ) " কালকে ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত করে 
  প্রতিটি মুহূর্তকে স্বয়ংসম্পূর্ণ অণুতে পরিণত করে 
  অস্তিত্ব রক্ষার নাম 
  জীবন " 

   ২ ) " কিছু কিছু ভোগ-স্পৃহা 
           কিছু কিছু জয়স্তম্ভ 
           কিছু কিছু লৌকিক কিংবদন্তী 
   আমাদের মেধায় ও হৃদয়ে আবর্তিত হয় 
  একটা গতিশীল অখণ্ড শ্বাস-প্রশ্বাস 
  জীবাশ্ম থেকে অতিজীবনের অন্তর্বর্তীকাল জুড়ে 
               প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে 
               একটা অখণ্ড মুদ্রায় 
              নৃত্যরত " 

কালের প্রবহমানতার একেবারে গোড়ার কথা । নয় কি ? আর শুধু বিষয়বস্তুতেই নয় , বলার ভঙ্গিমাতেও খাঁটি কবিতা । কবিতার অতি সামান্য একজন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাঠক হিসেবে মনে হয় , আর কার ক্ষেত্রে কী হবে জানিনা , দেবদাস আচার্যর কবিতা অন্তত সোনার ধান হয়ে মহাকালের নৌকায় উঠবেই , দেবদাসের কবিতায় যে তার সবকটি লক্ষণ বিদ্যমান !
এই গদ্যের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে একজনের কথা না বললে গদ্যটি নাকি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে -- ঘরোয়া কথাবার্তায় দেবদাস-ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু মানুষ বলেছেন আমাকে । যার কথা বলতে চেয়েছেন তিনি কবি মজনু মোস্তাফা। দেবদাস আচার্য তার সাহচর্যে কবিতা লেখার শুরু থেকে প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত যথেষ্ট উপকৃত , বলেছেন অনেকে । 'প্রভাবিত'ও বলেছেন দু'একজন । উপকৃত বা প্রভাবিত যাইই হোন না কেন , এ কথা নিশ্চয়ই ঠিক , তার সাক্ষ্য দেবে কবিতা । যারা বলেছেন ক্ষমা করবেন , মজনু মোস্তাফার কবিতা বিস্তৃত পাঠ করে এরকম ধারণার বিশেষ কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় বলে মনে হয় না । দেবদাসের মৃৎশকট, তর্পণ , উৎসবীজ , আচার্যের ভদ্রাসন , সুভাষিতম কোনো কাব্যগ্রন্থের মূলভাবের সঙ্গেই মজনুর কবিতার কোনো মিল কোথাও চোখে পড়ে না । মজনু তথা নির্মাল্যভূষণের " উনিশ যন্ত্রণা " ভালোভাবে পড়ে "উনিশ যন্ত্রণা"র ভূমিকায় লেখা বার্ণিক রায়ের এই বক্তব্যের সঙ্গেই একমত হওয়া অনেক বেশি সহজ , যে মজনুর কবিতায় বরং র‍্যাঁবোর প্রভাব বেশি চোখে পড়ে । মজনুর কবিতা অনেকখানি স্বপ্ন ও বিশ্বাসভঙ্গের তীব্র দহনজাত বেপরোয়া কবিতা । তার বিষয়ে শব্দপ্রয়োগে র‍্যাঁবোর লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে বেশি । আর দেবদাসের কবিতার জায়গা যে একেবারে অন্যরকম তা এতক্ষণের আলোচনায় পাঠকের কাছে নিশ্চয়ই স্পষ্ট । অবশ্য একথা ঠিক , অনেকসময় একজন কবির কবিতায় আর একজন কবি প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে উপস্থিত থাকেন । আপাতদৃষ্টিতে এই উপস্থিতি ধরা বেশ কঠিন । এইজন্যই কবির ব্যক্তিগত জীবন সবসময় পাঠকের জানার প্রয়োজন আছে । 

এই আলোচনা শুরু করেছিলাম কবিতায় মহাসময় তথা কালখণ্ডের বিস্তার দিয়ে , শেষও করব সেই প্রসঙ্গেই । হয়ত কোনোদিন পৃথিবীর বুকে কোনো লণ্ডভণ্ড ঝড় , কিংবা মাটি ফুঁড়ে ওঠা কোনো প্রচণ্ড অগ্ন্যুৎপাত , হয়ত প্রবল সুনামি ঢেউ , তীব্র জলোচ্ছ্বাসে স্থলভাগ জুড়ে ক্ষ্যাপা প্রকৃতির উন্মত্ত তাণ্ডব ! সেইদিন সেই ধ্বংসলীলার সামনে দাঁড়িয়েও , বায়ু অগ্নি জলে মহাপ্রলয়ের মুখে দাঁড়িয়েও এই অসীম ব্রহ্মাণ্ডে কোনো না কোনো মহাপ্রাণের নাভিকুণ্ড থেকে ঠিক উচ্চারিত হবে ' ওঁ ' ! সঙ্গে সঙ্গে নবসৃষ্টিবার্তা , গাছ থেকে পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরে পড়বে ফুল । চারপাশে নরম মিষ্টি হাওয়া , সকালের কাঁচাসোনা-রোদ । সেই রোদ হঠাৎই মিলিয়ে হয়ত আকাশ ভরে উঠবে ঘন কালো মেঘে । অঝোর বৃষ্টিধারায় সুজলা সুফলা হবে মাটি । তারপর একসময় বৃষ্টি থামলে আবার চতুর্দিক আলোয় আলো । সঙ্গে নতুন মানুষ নতুন কাব্যভাষায় , নতুন আঙ্গিকে নতুন শিল্পনৈপুণ্যে , হয়ত নতুন নতুন কবিকে পুষ্পস্তবক মানপত্র সম্বর্ধনায় । 
... আর কবি দেবদাস ? ... ওই যে ওঁচলাকুড়ুনি , ঘুঁটেকুড়ুনি , ছুতোরকাকা , ঘরামিকাকা , ... ওই যে সে , যে নিড়িনি চালায় শস্যে বিদে দেয় খুঁটে তোলে আগাছা ! ... যদি সময়ের মহাস্রোতে ওরা থেকে যায় তবে সেই নবসময়ের প্রেক্ষাপটে দেবদাসও নিশ্চিত থাকবেন অনন্ত সৌরপথ পরিক্রমায় এই পৃথিবীর মাটিতে মানুষের অহংকার নিয়ে , পদস্খলন নিয়ে । ... রক্তমাংসে না হলেও কবিতাসংগ্রহে , নতুন কবির হাতে নতুন পাঠকের হাতে হয়ত কখনো কারো রঙিন কাগজে মুড়ে ভালোবেসে তুলে দেওয়া প্রীতি উপহারে । 

                                 ( শেষ ) 




লেখক পরিচিতি: সজ্জ্বল দত্তের জন্ম ৬ নভেম্বর ১৯৬৮। শৈশব, বেড়ে ওঠা এবং কবিতা লেখার শুরু থেকে জীবনের একটা বড় অধ্যায় কেটেছে চূর্ণী নদী তীরবর্তী রানাঘাট শহরে। পেশায় ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের কর্মচারী সজ্জ্বল দত্ত এখন বারাকপুর শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। বিগত শতকের নয়ের দশকের কবি ও আলোচক সজ্জ্বলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বাগত শ্রাবণ-জোনাকি' ( ১৯৯৭ - দাহপত্র)। পরবর্তীকালে প্রকাশিত - পোস্ট মর্টেম ( ২০০০- এই সহস্রধারা), দাগ ( ২০২০- বারাকপুর স্টেশন প্রকাশনী), অ্যালব্যাম ( প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থের একত্রিত দ্বিতীয় সংস্করণ - ২০২২- সায়ন্তন পাবলিকেশন) প্রভৃতি। কবিতাকেন্দ্রিক 'মধুবন' পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘ আট বছর। বর্তমানে বারাকপুর স্টেশন লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। 
   দেবদাস আচার্য সজ্জ্বলের প্রিয় কবিদের একজন। সাতটি পর্বে প্রকাশিত এই আলোচনায় একদিকে যেমন আলোচ্য কবিকৃতি নিপুণ দক্ষতায় পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে তেমনই আলোচক সজ্জ্বলের প্রজ্ঞাদীপ্ত কলম প্রমাণিত হয়েছে কষ্টিপাথরে। 

শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ২০২৩

ষষ্ঠ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

 "অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে"

সজ্জ্বল দত্ত



৬.

সমসাময়িক বাংলা কবিতা

দেবদাস ছ'য়ের দশকের শেষপ্রান্তের কবি । তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি "র প্রকাশকাল ১৯৭০ । প্রথম বই যে বছর বার হচ্ছে তার অন্ততঃ বছর দু-তিন আগে সেই কবি পুরোদস্তুর কবিতা লেখালেখির মধ্যে চলে এসেছেন - এমন অনায়াসেই ধরে নেওয়া যায় । সুতরাং দেবদাসের কবিজন্মের সূচনা নিশ্চিতভাবে ষাটের দ্বিতীয়ার্ধে । অবশ্য দেবদাসের কবিতার জনপ্রিয়তা মূলতঃ সত্তরের দশকেই । 
   এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেবদাসের সমসাময়িক বাংলা কবিতা বলতে কাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা হবে ? যে সময়ে দেবদাসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ , তার পাঁচ-ছ' বছর আগে থেকে বাংলা কবিতা মোটামুটি সেইসব সোনা ফলাতে শুরু করেছে , আজ পঞ্চাশ-ষাট বছর পরেও যাদের ঔজ্জ্বল্যে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়েনি । একের পর এক স্বর্ণময় কাব্যগ্রন্থ বার হচ্ছে তখন - উৎপল কুমার বসুর " পুরী সিরিজ ( ১৯৬৪ ) , কালীকৃষ্ণ গুহর " রক্তাক্ত বেদীর পাশে ( ১৯৬৭ ) , পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের " আগুনের বাসিন্দা ( ১৯৬৭ ) , " ইবলিশের আত্মদর্শন ( ১৯৬৯ ) , তুষার রায়ের " ব্যাণ্ডমাস্টার " ( ১৯৬৯ ) । হাংরি ও শাস্ত্রবিরোধী'র মত দুই বাংলাসাহিত্যজগৎ তোলপাড় করা সাহিত্য আন্দোলনে নিবিষ্ট পাঠকের বড় একটা অংশের কবিতাসংক্রান্ত ধ্যানধারণা  প্রবল ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে । ঠিক এইরকম একটি পটভূমির ওপর দাঁড়িয়ে দেবদাসের প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ । " লেখা " পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে দেবদাস আচার্য বলছেন যে প্রথমদিকের লেখালেখির সময় তাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল হাংরি জেনারেশন এর কবিদের আন্দোলন । তো , হাংরি কবিতা নিয়েই এ' আলোচনা তাহলে শুরু করা যাক । ... কবি অরুণেশ ঘোষের " এই আমার শহর " কবিতার কিছু অংশ : 
 
      " আমার বাপের রুমাল ছিল না 
                               অথবা তার বাপের 
     অথচ আমার মায়ের রুমাল ছিল 
                               এবং তার মায়েরও 
     অর্থাৎ রুমাল-সভ্যতা এসেছে 
                              মেয়েদের কাছ থেকেই 
     দুপুরবেলা ভাটিখানার বেঞ্চে বসে
                              আমার হাসি পায় 
    মাসিকের সময় গুঁজে দেবার জন্য যে ন্যাকড়া 
    কোন শতাব্দীতে তার কোলে ফুটে উঠল 
                              গোলাপফুল ? 
  ১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে 
     তার লেঙট 
  ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে 
  ১ রোবট নিজেকে মনে করে 
     আগামীকালের শাসক 
  ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময় 
  ১ অধ্যাপিকার যৌনাঙ্গে গজিয়ে ওঠে 
                              অশিক্ষিত কালো ঘাস 
   আর ১ পাগলকবি দু'পা ফাঁক করে 
   পেচ্ছাপ করে দেয় 
   শীতের ভোররাত্রে - 
                          মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর
   আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে  
                          বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা 
   আমি দুপুরবেলা ঘুরে বেড়াই " 

উৎসবীজ , মৃৎশকট , সুভাষিতম বা তর্পণ এর কবিতার বিরাট বিরাট ক্যানভাসের সঙ্গে তো প্রশ্নই ওঠে না , এমনকি প্রথমদিকের কালক্রম ও প্রতিধ্বনি বা মানুষের মূর্তির সঙ্গেও এই কবিতার কোন তুলনা হয় না । দেবদাস আচার্য নিজে বললেও - না । মিল , প্রভাব কোনোদিক দিয়েই না । ছ'য়ের দশকে বহিঃপৃথিবীতে এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল যে তার প্রভাব আমাদের এখানে রাজনীতি , অর্থনীতি , সমাজনীতি , সাহিত্য কোনোকিছুতেই অস্বীকার করা যায় নি । বিশ্বব্যাপী ছাত্র-যুব-তরুণ সমাজের বিভিন্ন বিদ্রোহের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে আমাদের সংস্কৃতিতেও । তারই ফল হয়ত বা হাংরি জেনারেশনের কবিতা । বহির্বিশ্বের গতিপ্রকৃতি এবং তার ফলে কবিতার বিষয়ে , ভাষায় বিপ্লবের ঢেউ দেবদাস-কবিতাতেও পড়ে , কিন্তু হাংরি কবিতার থেকে তা সম্পূর্ণ আলাদা । 
         ১৯৯৮ সালে সমীর চৌধুরীর সম্পাদনায় " কথা ও কাহিনী " থেকে যে হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন বার হয়েছে তার মুখবন্ধে ' হাংরি জেনারেশন কেন ' শীর্ষক লেখায় সমীর চৌধুরী লিখছেন - " হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে অন্য যে কোন সাহিত্য আন্দোলনের মূল তফাত এইখানে যে , তেমন কোন দার্শনিক ভিত্তিভূমি থেকে এই আন্দোলন গড়ে ওঠেনি " । খোলামেলা ভাষা ও শব্দকে কেন্দ্র করে " আধুনিকতার শবদেহের ওপর উল্লাসময় নৃত্যের নামই হাংরি জেনারেশন " । 
আর দেবদাস-কবিতার প্রধান ভিত্তিটাই হল দর্শন । কোটি কোটি বছরের সভ্যতা তথা গোটা সৌরসংসারের বিবর্তনের ইতিহাস , যার কেন্দ্রে রয়েছে সেই আদি অকৃত্রিম মাটি আর মানুষ । শব্দব্যবহারে , ভাষাপ্রয়োগে দেবদাস যথেষ্ট অন্যরকম । হাংরি জেনারেশন কবিদের মত তিনি অক্লেশে ' পোঁদ ' শব্দটি লিখতেই পারেননি । তিনি লিখেছেন ' পাছা ' । এইখানেই তো এই কবিতাবিপ্লবের সঙ্গে দেবদাস-কবিতার অনেকখানি পার্থক্য । 
হাংরি কবিতা ছাড়া ছ'য়ের দশকের অন্য কবিদের কবিতায় আসা যাক । বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের প্রায় ছ-সাতটি দশকের মধ্যে ছয়দশকেই বাংলা কবিতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা সম্ভবতঃ সবচেয়ে বেশি হয়েছে । হাংরি আন্দোলন তো আছেই , তার পাশাপাশি মৃণাল বসুচৌধুরী , অতীন্দ্রিয় পাঠকদের শ্রুতি আন্দোলনের ধারায় আর একধরনের কবিতা । এক্সপেরিমেন্টাল কবিতা প্রচুর লেখা হওয়ার জন্য এবং কবিতার নির্মাণশৈলী ভীষণভাবে ছড়িয়ে যাওয়ার জন্যই সম্ভবতঃ আলাদাকরে ছয়ের দশকের কবিতার কোনো দশকভিত্তিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে না । কিন্তু এই দশকের অনেক কবিকেই তাদের নিজেদের-নিজেদের মত করে আলাদা বৈশিষ্ট্যযুক্ত বলে চিহ্নিত করা যায় । তুষার রায়ের কবিতা একরকম , অমিতাভ গুপ্তর কবিতা একেবারে একশো শতাংশ অন্যরকম । ভাস্কর চক্রবর্তী আবার আর এক ধরনের । অনেক বেশি মাত্রায় স্পর্শকাতর । উদাস বিকেলে একা একা বসে অদ্ভুত মনখারাপ নিয়ে পড়ার মত । 
তবে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যর মত একটা মিলের কথা উল্লেখ করাই যেতে পারে ।  ছয়ের দশকের কবিদের প্রতিক্রিয়ায় কেমন যেন একধরনের বিতৃষ্ণ ভাব , ছ'য়ের বেশিরভাগ কবি যেন স্বেচ্ছায় অশিক্ষিত হতে চেয়েছেন । হাংরি জেনারেশন বাদ দিলাম , দেবদাসকেও বাদ দিলাম , ছয়ের দশকের অন্য চারজন কবির কথা ধরা যাক । ধরা যাক , পবিত্র মুখোপাধ্যায় , রত্নেশ্বর হাজরা , কালীকৃষ্ণ গুহ এবং উৎপল কুমার বসু । বিশিষ্ট কবিতাসমালোচক বার্ণিক রায় তার " কবিতা : চিত্রিত ছায়া " গ্রন্থে ছয়ের দশকের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই চারজনের প্রথম তিন কবি সম্পর্কে কী বলছেন ? ... পবিত্র মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে আলোচনার শুরুতেই বলছেন -- " পবিত্রর সমস্ত কবিতার মধ্যে একটা ধ্বংস, অন্ধকার, ক্লেদ, বিষাদ, নিঃসঙ্গতা, মৃত্যুর আগুন, অবিশ্বাস, শীতলতা ও যন্ত্রণাবিদ্ধ উপলব্ধির তীব্র বিষময় সুরা অনুভব করা যায় " । ... রত্নেশ্বর সম্পর্কে বলছেন - " এ যুগের কবিদের ক্ষয়িষ্ণু জীবনবোধের মধ্যেও তাকে ছাপিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলোকিত চেতনার প্রত্যয়কে অতি সহজে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারেন তিনি । তার কবিতায় ক্ষুধার্ত বাতাস আর হাঙরমুখো পাতাল খেলা করলেও চেতনার হাস্যধ্বনির কাছে সব তুচ্ছ " । ... আর কালীকৃষ্ণ গুহর কবিতা প্রসঙ্গে তার বক্তব্য - " কালীকৃষ্ণ বহির্জগতের সমস্ত বেদনাজ্বালা রক্তক্ষরণ এবং একইসঙ্গে অন্তর্জগতের বেদনা বুকের ভেতর নিয়ে নিবিড় যন্ত্রণায় বাস করছেন । এখানে বহির্জগতের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই , নিবিড় হৃদয়ের অন্ধকারে প্রতীকের মত বহির্জগত তারার আলো নিয়ে জ্বলছে " । ... কিন্তু দেবদাসের কবিতা ? তার মূল জায়গাটাই যে দর্শন ! গভীরতম সমাজতান্ত্রিক দর্শনের সঙ্গে ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের নিবিড় মিশ্রণ ! সুতরাং  ... ... 

    উৎপল কুমার বসু ।  ' পুরী সিরিজ ' , ' আবার পুরী সিরিজ ' , ' লোচনদাস কারিগর ' ইত্যাদি সমেত উৎপল কুমার বসুর সমগ্র কবিজীবন অনুসরণ করে , দেবদাস আচার্যর পূর্বসূরি হিসেবে তুলনামূলক আলোচনায় আমার সবচেয়ে প্রিয় মন্তব্যটিই এখানে রাখি । ... আলোচক সুজিত সরকার । - " উৎপল কুমার বসুকে আমার বরাবরই এক বিদেশী কবি বলে মনে হয়েছে । বাঙালীকবি হিসেবে আমি তাকে কোনদিন ভাবতেই পারিনি । তার কবিতা পড়তে পড়তে কেবলই মনে হয়েছে , এ যেন কোন বিদেশী কবিতার অসাধারণ বাংলা অনুবাদ "    (  শব্দের নিজস্ব আলো : পৃষ্ঠা ৬৮ ) । উৎপল কুমার বসুর কবিতার নাম " অর্কিড " , " রা-রা-রা ডেমোক্রেসি " । গাছের নাম ব্যবহার করতে হলে শব্দ পাওয়া যাবে " ইউক্যালিপ্টাস " , নারীর নাম ব্যবহারের প্রয়োজন হলে শব্দটি হবে " মরিয়ম " । ... অন্যদিকে দেবদাস শতকরা একশোভাগ এই মাটির কবি , এই মানুষের , এই বাংলার গ্রামের কবি । তার কবিতার শব্দচয়নে চাষি বিদে দেয় , খুঁটে তোলে আগাছা , শস্যে নিড়িনি চালায় । 
          সর্ব আলোচনাশেষে নির্দ্বিধায় বরং দ্রুত এ'কথা মেনে নেওয়া ভালো যে পুরোদশকের কবিতা থেকেই দেবদাস-কবিতা একেবারে স্বতন্ত্র , অন্যরকম । কিরকম ? পরীক্ষানিরীক্ষার তেমন একটা ধার ধারেন না , তবে নিজস্বতা অবশ্যই পুরোমাত্রায় খুঁজে পাওয়া যায় । আসলে তিনি বিরাট বিরাট এক ক্যানভাসে প্রাণপণে খুঁজে বেড়ান নিজের তথা জীবনের অর্থ । বারবার বিভিন্ন কবিতায় তার এই খুঁজে ফেরা চোখে পড়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় । 

ক্যানভাস ১ - " নিঃসীম শূন্যের গহ্বরে কালো , ধূ-ধূ কালো , আকস্মিক পদস্খলনের / পর ছুটে যায় সেই শূন্যের ভিতরে অনুপরমাণুময় ধুলোঝড় " । ... নিজে ,তথা জীবন , তথা প্রাণের অর্থ - " সেই ঝড় থেকে মুক্ত অণু এক ভাসমান মহাশূন্য অতিক্রম করে / এসেছি এ' পৃথিবীতে , জল দাও আলো দাও স্থিতি দাও প্রাণবায়ু দাও " । ( উৎসবীজ ) 

ক্যানভাস ২ - " দুঃখ নয় শোক নয় ভালোবাসা নয় / সে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল সময়ের মাঝখানে , হাতে পেটানো ঘন্টা " । ... আর নিজে তথা জীবন তথা প্রাণের ব্যাখ্যা - " এক কোটি বছর ধরে ঠেলে এনেছি আজকের প্রচ্ছদ / মেঘ , বায়ু , ঘনঘোর জ্যোৎস্না ও অন্ধকার / উল্লাস , অশ্রু , যৌন-কীট / বিশাল ঐতিহ্য , সংগ্রাম " । ( মৃৎশকট ) 

ক্যানভাস ৩ - " এ পাশে পৃথিবী আর ওপাশে আকাশ " । ... জীবন তথা প্রাণ - " মাঝখানে / সবিস্ময়ে কাশীনাথ চেয়ে দেখে / কাণ্ডারীবিহীন নৌকা ভেসে যায় " । ( অগ্রন্থিত কবিতা ) 

         এরকম উদাহরণ আরো বহু বহু খুঁজে পাওয়া যায় । ফলতঃ অনায়াসে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতেই পারে যে সমসময়ের কবিতার সঙ্গে দেবদাস-কবিতা মেলে না । আর সত্যি বলতে কী দেবদাস-কবিতার বিস্তৃত পাঠশেষে এমনই মনে হয় যে , " সমসময় " নামক এত ক্ষুদ্র শব্দে কী আদৌ আটকে রাখা সম্ভব সূর্যের মত তেজস্বী এই কবিতাআলোর ঔজ্জ্বল্য ? 
                                ( আগামী পর্বে শেষ ) 

রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০২৩

পঞ্চম পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে"

সজ্জ্বল দত্ত  





৫ . 

নান্দনিকতা

" If anything is beautiful besides absolute beauty , it is beautiful for no other reason than because it partakes of absolute beauty " -- প্লেটোর এই উক্তিকে যদি মেনে নিই তবে অবশ্যই লেখা যেতে পারে শিল্পে এই সৌন্দর্যসৃষ্টি পরম সৌন্দর্যেরই অংশমাত্র । কিন্তু ' সৌন্দর্য ' কথাটাই যে কত গোলমেলে তা বোঝা যাবে একটু বিস্তৃত আলোচনা করলেই । মোটামুটিভাবে ' সৌষম্য ' , ' কারণ ' এবং ' ফল ' অর্থাৎ relation , cause এবং effect এই নিয়ে হচ্ছে ' সৌন্দর্য ' । সৌন্দর্যতত্ত্বের ওপর চারটে প্রধান গ্রহণযোগ্য মত আছে । প্রথম মতটি প্লেটোর ( যেটি ওপরে বলা হয়েছে ) , দ্বিতীয় মতটি হচ্ছে " সৌন্দর্য হল রূপ-সুষমা , এক বিশেষ ধরনের কল্পনা । তৃতীয় মত - সৌন্দর্য তাইই , যা রসাস্বাদনের কারণ , আর চতুর্থ মতে সৌন্দর্য হচ্ছে প্রতিভার সৃষ্টি । এছাড়াও আরো অসংখ্য আপাতগুরুত্বহীন মত এই তত্ত্বকে ঘিরে পাক খাচ্ছে , কিন্তু সে বিষয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন । আমাদের আলোচ্য বিষয় হল দেবদাস আচার্যর কবিতার সৌন্দর্য , তার নান্দনিকতা । 
   সৌন্দর্যের আসল সাফল্য আনন্দমূল্যে আর কবিতায় তা আসতে পারে বিষয়ে , প্রকাশে , আসতে পারে শব্দচয়নে, যতিচিহ্ন ব্যবহারে , এমনকি আধুনিকতম কবি ও আলোচকরা দাবী করছেন কবিতায় পড়ে থাকা ফাঁকা স্পেসও নাকি নান্দনিকতার অন্তর্ভুক্ত । দেবদাস আচার্যর কবিতা যেহেতু প্রধানতঃ ন্যারেটিভ তাই গঠনগত প্রকরণগত সৌন্দর্যের চেয়েও বিষয়গত ও ভাবগত সৌন্দর্যের ব্যাপারটাই অধিক আলোচ্য । যেমন " মানুষের মূর্তি "র কবিতাগুলোর সৌন্দর্য আলোচনা করতে হলে তা করতে হবে মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের ধারণা থেকে । সোমনাথ হোড়ের ভাস্কর্য আর দেবদাস আচার্যর " মানুষের মূর্তি " একজাতীয় শিল্পমাধ্যম না হলেও সৌন্দর্যতত্ত্বের দৃষ্টিতে একই জাতের । 

" ছুতোরকাকা র‍্যাঁদা আর তুরপুন হাতে 
              বেরিয়ে পড়েন কাজে 
 করমালি চাচার হাতে ওলন-দড়ি 
 মাধবজেঠু দুটো বলদ আর বিদে নিয়েছেন সঙ্গে 
 আমার বাবাও সাইকেলে চাপেন 
 তার কেরিয়ারে থাকে রুটি আর আলুচ্চড়ি 
        আর কাপড় গামছার বোঁচকা "    ( অনুভব )

কোনরকম ন্যারেটিভ ও লিরিকের মিশ্রণ নয় , পরিস্কার ন্যারেটিভ । রক্তমাংসের মানুষের নয় , হাড়ের মানুষের ছবি । কিন্তু " মানুষের মূর্তি "র এই হাড়ের রাজত্বেও সুন্দর শব্দচয়নে কবিতার সৌন্দর্য কী চমৎকার ধরা পড়ে ! 

 "আমার ছোট্ট আর মিষ্টি মা রুটি ভাজেন 
 এবং তাকিয়ে থাকেন বাবার সেলাইকলের দিকে" 
                                                        ( খিদে ) 

এই যে " ছোট্ট আর মিষ্টি মা " এই হচ্ছে শব্দচয়নে সৌন্দর্য । বিরাট কোনো বিষয়ের প্রবাহে গা ভাসালেন না অথচ দুটি শব্দে দুরূহ নান্দনিকতা উঠে এল কবিতায় । 
         " মৃৎশকট " এর কবিতাগুলোয় বিষয়বস্তুকে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যাখ্যা করাই উদ্দেশ্য, ফলে এই কাব্যগ্রন্থের সম্পূর্ণ সৌন্দর্যই প্রকাশমহিমায় । আজ পর্যন্ত মহৎ প্রকাশ বলে যে সমস্ত কবিতা স্বীকৃত হয়েছে তাতে বিষয়ের মহত্ত্বকে প্রকাশ করেই " প্রকাশ " আপন মহিমা লাভ করেছে । " মৃৎশকট "এ এই প্রকাশসৌন্দর্যকে ব্যক্ত করার জন্য রয়েছে অজস্র রূপক , নতুন নতুন শব্দ , একেবারে কাঠখোট্টা গদ্যের স্টাইল আর একেকটি শ্লোকের জন্য অত্যন্ত সীমিত শব্দের ব্যবহার । 

   " একটা সাপ আমি যেতে দেখেছি আমার 
              শরীরের মধ্যে অন্ধকারে 
    তার নীল বিষ গলাধ:রণ করে এই শহরতলীর
              নিম্নবিত্ত বোধের মধ্যে চলাফেরা করি। " 
                                           ( ৬ নং শ্লোক ) 

এইভাবে রূপকের মধ্যে দিয়ে কবিতাটির শুরু তারপর ধীরে ধীরে মিশে গ্যাছে সময়ে এবং অবশেষে সময়উত্তীর্ণতায় আর একইসঙ্গে পাঠক ধীরে ধীরে ডুবে গেছেন ভাবসৌন্দর্যের আনন্দসমুদ্রে । আবার আলংকারিক প্রয়োগের সৌন্দর্যরূপ - " তার মেয়ের দেহের মতো ফসল গড়ে ওঠে মাঠে " । অসাধারণ উপমা ! ফসলের প্রতি কৃষকের যত্ন কবির কলমে কাব্যনান্দনিকতা প্রকাশে কতটা মমত্ব থাকলে এভাবে লেখা যেতে পারে ? 

কবিতায় নান্দনিকতার প্রথম কথা হচ্ছে তাকে দেহে মনে পরিস্কার কবিতা হতে হবে । কবিতা কী ? এ প্রশ্নের কোন প্রামাণ্য উত্তর যেমন এখনও তৈরি হয়নি , তেমনি সিরিয়াস পাঠকের কাছে কোনটা কবিতা আর কোনটা নয় তার একটা ধারণা কিন্তু তৈরি হয়েই আছে , কারণ কাব্যশিল্পের নৈপুণ্য ও প্রকাশদক্ষতা উপলব্ধি করার জন্য পাঠক সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকেন , ইংরেজিতে বললে একটা aesthetic attitude নিয়েই থাকেন । তাই দেবদাস যখন লেখেন - " এক স্থায়ী কাচের শরীরের মধ্যে আমার আত্মা স্থির হয়ে আছে " ( ' অস্তিত্ব ' : ঠুঁটো জগন্নাথ ) , তখন পাঠকের চৈতন্য সাড়া দেয় আর সঙ্গে সঙ্গে কবিতাশিল্প উত্তোরিত হতে থাকে আপন সৌন্দর্যসীমায় । 

      " For all good poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings " - বলছেন কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার ' poetry and poetic diction ' প্রবন্ধে । আর এই প্রবন্ধেই " কবি " সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন " while he describes and imitates passion ... " । ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই দুটি কথাই ষোলো আনার ওপর আঠারো আনা খেটে যায় দেবদাস আচার্যর কবিতা এবং কবি দেবদাস সম্পর্কে যদি পাঠক ' উৎসবীজ ' কাব্যগ্রন্থটি হাতে নেন এবং তার নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে মাথা ঘামান । নান্দনিকতা কিভাবে অনন্তর ধারণা থেকে ধীরে ধীরে মাটির পৃথিবীর সৌন্দর্যে নেমে আসতে পারে তার আদর্শ উদাহরণ " উৎসবীজ " । ... " আমারই চোখের মায়া নিয়ে তুমি খেলা করো , হে পৃথিবী / আরো কিছুকাল " - এইভাবে শেষ হচ্ছে উৎসবীজ । 

 আলোচনা এগোক । " উৎসবীজ " ছাড়াও " আচার্যর ভদ্রাসন " যে দেবদাসের কবিতার আর একটি অন্যতম প্রধান বাঁক , এ বিষয়ে আশাকরি যেকোনো দেবদাস-পাঠক নিঃসন্দেহ । " আচার্যর ভদ্রাসন " এর নান্দনিকতা বলতে বিষয়বস্তুর এক অন্যধরনের গাম্ভীর্য এবং সেইসঙ্গে কুশলী বর্ণময় এক রহস্যে ঘেরা মনোজাগতিক এফেক্ট তৈরি করা । ঘটনা , ক্রিয়া , চরিত্র , ভাবনা এই সবকিছু মিলিয়ে অন্যধরনের উপস্থাপনা যা অবশ্যই পাঠকমনের চূড়ান্ত নান্দনিক উদ্ভাস ঘটায় । 

  আরো এগোই । " সুভাষিতম " এ কল্পনা করা হয়েছে আত্মার নিগূঢ় কামনাবাসনার বৃত্তটি , তার বাহ্যসত্ত্বা , জৈবিক সত্ত্বা , মানুষরূপ ধারণ করে তার চলার পথ । 

" আত্ম-রিপুকে লেহন করার নাম জীবন 
  এই সহজ পথ 
  শ্রেষ্ঠ পথ "          ( সুভাষিতম ) 

সুখ-দুঃখ-ভয়-নির্ভয়-হাসি-কান্নাজনিত বাহ্যসত্ত্বা উদ্বেলিত গোটা সুভাষিতম জুড়ে, আর সাথে কাব্যনান্দনিকতা তার শ্রেষ্ঠতম সাফল্যে উত্তীর্ণ অন্তরজাগরণের আনন্দে। কবি দেবদাস নিজে কোন দার্শনিক মতবাদের প্রবক্তা না হলেও দর্শনের তুরীয়লোকে পৌঁছে গ্যাছেন এই কাব্যগ্রন্থে। জগতে ও জীবনে দ্বন্দ্ব আছে সত্য , কিন্তু আসল সত্য রয়েছে দ্বন্দ্বের সমাধানে। "সুভাষিতম"এ কোটি কোটি বছরের চলার পথ এবং তার বিভিন্ন দ্বন্দ্ব, আবার আপনা থেকেই তার সমাধান। ফলতঃ পাঠকের চৈতন্য আবার সাম্য ফিরে পায়। আত্মার সাম্যবোধ, নৈতিকবোধ চরিতার্থ করে এই কাব্যগ্রন্থ পাঠককে বিষয়ে, দার্শনিক উপলব্ধিতে চরম কাব্যনান্দনিক আনন্দদান করে ,সঙ্গে কবি নিজেও যেন এক পরম সত্যের কাছাকাছি চলে যান । 


 একের পর এক কাব্যগ্রন্থে কবির কাব্যিক নান্দনিকতার মাধ্যমে পাঠককে আনন্দদানের ক্ষমতার যেন ক্রমোন্নয়ন ঘটেছে । কথা হচ্ছে , লিরিককে বাদ দিয়ে রোম্যান্সকে বাদ দিয়েও কবি দেবদাস কিভাবে তার কবিতায় এই অপার সৌন্দর্যসৃষ্টি করতে পেরেছেন ? ... পেরেছেন , তার প্রধান কারণ - লিরিকের অভাব থাকলেও দেবদাসের কবিতা মোটেই ইস্তাহারধর্মী পদ্য নয় । তার কবিতায় শিল্পসিদ্ধি ঘটে কারণ পাঠকের কবিতা পড়ে জোরালো একটা প্রতিক্রিয়া হয় । সে প্রতিক্রিয়া ফুলের মত না হতে পারে , ফাগুনের দখিনা বাতাসের মত আবেশজড়ান না হতে পারে , কিন্তু বিষয়ে প্রকাশে এবং সর্বোপরি সারবত্তায় তা পাঠককে কোন এক অজানা মহাসমুদ্রের গভীরে ভাসিয়ে নিয়ে চলে । এই ভেসে যাওয়ার আনন্দই দেবদাস-কবিতার নান্দনিকতার প্রাণ । ... পাঠক কেন ভেসে যায় ? কারণ একদিকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা , অন্যদিকে জীবনের প্রবহমানতার বহু বহু বছরের বিবর্তন এবং সেই প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন, এই দুইই একসঙ্গে শিল্প হয়ে উঠে আসে পাঠকের অন্তরে । কিভাবে ? ... একটা উদাহরণ - 

             " আমার ঠোঁটের সামনে পায়েসের বাটি 
             আর আমি 
             শত চেষ্টাতেও ঠোঁট খুলতে পারলাম না । 
             #                 #                # 
              জিভে জল 
              আত্মবিহ্বল 
               #               #                  # 
               জীবন আমার কাটল এভাবেই " 
                         ( " স্পৃহা " : বিন্দু নয় রেখা নয় ) 

এই কবিতা অনায়াসে বুঝিয়ে দেয়, কেন লিরিককে বাদ দিলেও পাঠকের কাছে দেবদাস-কবিতায় নান্দনিকতার কোন অভাব কোন সময়েই পরিলক্ষিত হয় না । এই আলোচনার গোড়ার দিকে উল্লেখ করা সৌন্দর্য সংক্রান্ত প্রধান চারটে মতের মধ্যে দেবদাসের ক্ষেত্রে বোধহয় চতুর্থটিই সঠিক প্রযোজ্য - " সৌন্দর্য হচ্ছে প্রতিভার সৃষ্টি " । 

                                ( চলবে ) 


চতুর্থ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে"

সজ্জ্বল দত্ত

৪.



ছন্দ-ভাষা-আঙ্গিক 


একজন প্রকৃত কবি কখনো একভাবে একটা আঙ্গিক অনুসরণ করে একই ভাষায় সারাজীবন লিখতে পারেন না । ছন্দে , ছন্দভাঙায় , চোরাগদ্যে, টানাগদ্যে , গ্রাম্য শব্দপ্রয়োগে , অতিআধুনিক শহুরে শব্দপ্রয়োগে , যখন যেভাবে কবিতা আসে সেভাবেই লেখা হয়ে যায় । তবে অন্ততঃ ছন্দের ক্ষেত্রে  বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠতে পারে এইখানে যে , তার কবিতায় যেখানে ছন্দের স্বাভাবিক দোলাচল , সেই স্বাভাবিকতাকে তিনি সচেতনভাবে সেখানে পরিহার করছেন কিনা । করে থাকলে , কেন ? 

   " জৈব-রসায়নে ক্রোমো/জম কোষ কলা ৮+৬
    নির্মিত হয়েছে যার /প্রতিক্রিয়া হেতু ৮+৬ 
    বস্তু প্রাণে রূপায়িত /হয় , রূপায়িত ৮+৬ 
    হয় প্রাণচেতনায় /চেতনা বিন্দুটি ৮+৬ 
    ধ্যানে রূপায়িত হতে /পারে , ধ্যানলোক ৮+৬
    ভেদ করে সূক্ষ্ম বোধ-/লোক গড়ে ওঠে ৮+৬ 
                                         ( উৎসবীজ ) 

যেভাবে পর্ব ভাগ করা হল , সেইভাবে পড়লে অক্ষরবৃত্তের এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কি হতে পারে ? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে , এইভাবে তো কবিতা পড়া হয় না । ক্রোমোজম শব্দের মাঝখানে দুই পর্বের ভেদরেখা অর্থাৎ নিঃশ্বাসের বিরাম - এটা কবিতা পড়ার সময় মেনে নেওয়া কার্যত অসম্ভব । পাঠক কবিতা পড়তে গিয়ে বিশ্রাম নেবেন যতিচিহ্ন অনুযায়ী , যতিচিহ্নের ব্যবহারও হয় ঠিক সেই কারণেই । কবি চাইলে এক্ষেত্রে সেই অনুযায়ী লাইনগুলি লিখতেই পারতেন । সেক্ষেত্রে হত - 

"জৈবরসায়নে ক্রোমোজম কোষকলা 
নির্মিত হয়েছে ,   
যার প্রতিক্রিয়া হেতু বস্তু প্রাণে রূপায়িত হয় , 
রূপায়িত হয় প্রাণচেতনায় , 
চেতনাবিন্দুটি ধ্যানে রূপায়িত হতে পারে , 
ধ্যানলোক ভেদ করে সূক্ষ্ম বোধলোক গড়ে ওঠে"। 

         এইবার একেবারে পরিস্কার গদ্যকবিতা । পাঠক পড়বেনও এইভাবে । কিন্তু কবি নিশ্চয়ই এক্ষেত্রে ছন্দের ধারণা স্বেচ্ছায় দিতে চেয়েছেন , সেই কারণেই এই ফর্মে লিখেছেন । সুতরাং সচেতনভাবে ছন্দ পরিহার করেননি কবি দেবদাস , বরং যেখানে হয়ত গদ্যে লিখলেও হত , সেখানে ছন্দ রাখতেই চেয়েছেন । 

আবার ৮ + ১০ ফর্মের অক্ষরবৃত্ত  : 

 " আকাশের নীচে ম্লান / জনপদ ঘুমায় এখন 
  পৃথিবীর ঘূর্ণনের / আদিশব্দ শোনা যায় শুধু 
   অথৈ রাতের কালো / আলো হয়ে ভাসায় প্রান্তর
   সিদ্ধাচার্য মগ্ন হন / গূঢ়-লোকে মানস-ভ্রমণে " । 
                    ( ' অখণ্ডধ্বনি ' : আচার্যর ভদ্রাসন )

এখন কথা হচ্ছে , এই যে ৮+৬ , ৮+১০ ইত্যাদি দেখা হল , অক্ষরবৃত্তে মাত্রানির্ধারক অক্ষর বড় , না ধ্বনি বড় ? অধিক আলোচনার অবকাশ নেই , একটি উদাহরণে দেখা যাক বিদগ্ধজনে কী বলেন! " কবিতার ক্লাস "এ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : " অক্ষরের চাইতে ধ্বনি বড় ।  অক্ষর তো আর কিছুই নয় ধ্বনিরই একটা দৃশ্যরূপ মাত্র । আসলে যা ধর্তব্য , তা হচ্ছে ধ্বনি । তাই চোখের নয় , কানের রায়ই শিরোধার্য " । ... কিন্তু মিলন যেখানে রীতিসিদ্ধ নয় , শ্রবণ কি সেখানে অসবর্ণ বিবাহে অনুমতি দেয় ? দেবদাস আচার্যর কবিতায় - দেয় । দেবদাসের ছন্দ-ছন্দভাঙায়-ছন্দের পরীক্ষায়  চোখ ও কানের মিলন এতই স্বাভাবিক এবং মুন্সিয়ানার সঙ্গে যে পড়তে গিয়ে একচুলও কোথাও আটকায় না । 

      " এই তার / স্থিতি প্রতি/ভাস 
       দুপাশের / এ কঠিন / মায়ামুখ / ঘাস 
       আলো করে / 
        তার রক্ত / ঝরে 
        .
        .
        .
         
        কার মুখ /মনে পড়ে ?/ভেসে আসে /
                                  কার ক্লান্ত / গীত ? 
        মানুষের /জন্যে থাকে /পাপবিদ্ধ /শীত 
        মানুষের /জন্যে থাকে /শীত "   
                              ( মৃৎশকট ৭৭ নং শ্লোক )

 বৈশিষ্ট্য : কবিতাটির শুরুতে প্রতি লাইনে একটা করে চারমাত্রার পর্ব বাড়ছে , শেষে গিয়ে প্রতি লাইনে একটা করে চারমাত্রার পর্ব কমছে । নিঃসন্দেহে ছন্দের একটা ভাল পরীক্ষা । 

        তবে দেবদাস কখনোই ছন্দকে তার কবিতার প্রধান উপজীব্য বিষয় করে তোলেননি । সেই কারণে ছন্দে লেখা কবিতাতেও তার পর্বসমতা আদর্শের অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম । সেই ব্যতিক্রমের দৃষ্টান্তগুলো খুঁটিয়ে বিচার করলে মনে হয় কোথাও সেগুলো স্বাভাবিকভাবে হয়ে গ্যাছে , আবার কোথাও বা অনবধানতাপ্রসূত । সপাটে ছন্দে শুরু করলেও কোথাও হঠাৎ একমাত্রা পড়ে গেল , বা একমাত্রা বেশি এসে ছন্দপতন ঘটাল , এমন বহুক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে । 
        থাক সে প্রসঙ্গ । গদ্যকবিতার আলোচনায় আসা যাক । গদ্যকবিতায় চোরাছন্দের ক্ষেত্রে আধুনিক বাংলা কবিতায় সবচেয়ে বেশি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন সম্ভবতঃ অরুণ মিত্র । তবে দেবদাসের গদ্যকবিতার চোরাছন্দ মোটেই অরুণ মিত্র প্রভাবিত নয় । অরুণ মিত্রের চোরাছন্দের প্রয়োগ এমনই যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গদ্যে যেন পদ্যের আভাস তৈরি করে । আর দেবদাসের চোরাছন্দ এমন যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পদ্যে যেন গদ্যাভাস তৈরি করে । তবে নির্দ্বিধায় বলে নেওয়া ভালো , অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু চোরাছন্দের দিকটা ধরলে এ বিষয়ে অরুণ মিত্রের কৃতিত্ব দেবদাসের থেকে অনেক বেশি , আর দেবদাসের বিশেষ কৃতিত্ব হল আবেগ সংযত , স্পন্দন স্তিমিত , ফলে গদ্যাত্মক বাকপর্বের ব্যবহার অধিকতর । 

      "এইসব অস্থায়ী রেখার 
       কোনো আদি নেই বা অন্ত নেই 
       আদি ও অন্তহীন এই রেখা-সকলের 
                  কোন শূন্যতাও নেই বিরামও নেই 
        শেষ হওয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় 
                  শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায় " ।
                                                ( সুভাষিতম ) 
   ' নেই ' জনিত এবং ' শুরু হয়ে যায় ' , ' শেষ হয়ে যায় ' জনিত এতগুলি গদ্যাত্মক বাকপর্ব কী চমৎকার   গদ্যকবিতাভাস তৈরি করেছে ! আদতে গদ্যকবিতার প্রাণ হল কবিতার সম্পূর্ণ শিল্পব্যঞ্জনা সঙ্গে নিয়ে লেখার ধরনে গদ্যভিত্তিকতা । মৃৎশকট ও মানুষের মূর্তির অধিকাংশ কবিতাই এই ধরনের ।  তবে দেবদাস আচার্যর সবচেয়ে বড় পারদর্শিতা ভাবপর্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে । একটা বা দুটো পর্ব অকারণ এনে ফেলেন কিন্তু তা বোঝায় অনেক । 

 " একটা বড় বোধ ও হৃদয়ের দিকেই ছুটে চলেছে 
                        মানুষের মেধা -- 
                                লম্বা -- যতি-চিহ্ন-হীন " 
            ( নিজের মতোই দেখেছি : ঠুঁটো জগন্নাথ ) 
ঠিক এইরকম 'লম্বা' এবং 'যতিচিহ্নহীন' এর মত ভাবপর্বর উদাহরণ দেবদাস-কবিতায় অজস্র দেখা যায়।
          রবীন্দ্রনাথ লিপিকা , বলাকা , পুনশ্চ এই সমস্ত কাব্যগ্রন্থে মুক্তছন্দের ধারণায় যে ধরনের গদ্যকবিতা লেখার ধারা শুরু করেছিলেন , বহু সমালোচকের মতে তা আজকের আধুনিকতম গদ্যকবিতার ধাঁচের প্রথম ধাপ । রবীন্দ্রকবিতার দ্বারা কোনরকম প্রভাবিত না হয়েও দেবদাস আচার্য রাবীন্দ্রিক মুক্তছন্দের ধারণায় দীর্ঘকবিতা লিখেছেন । উদাহরণ : ঠুঁটো জগন্নাথ এর ' ১৯৮২ ' পর্যায়ের কবিতা ' নিজের সঙ্গে কথা ' , কিংবা অগ্রন্থিত ' কারখানার কবিতা ' । 
         দেবদাস ছন্দে , গদ্যে দুইধরনের কবিতাই প্রচুর লিখেছেন - এই হল সারকথা । বেশ কিছু সনেটেরও সন্ধান পাওয়া যায় অনুসূচিত কবিতায় , অগ্রন্থিতও দু'একটি রয়েছে । সনেটেও যথারীতি তিনি বিশৃঙ্খল । তার সনেট পেত্রার্কীয় না শেক্সপীরিয়ান এ ব্যাপারে গবেষণা করা অর্থহীন । ৪+৪+৪+২ এবং ৮+৬ দু'ধরনের সনেটই তিনি লিখেছেন । কিন্তু মিলের কোন নির্দিষ্ট নিয়ম কোনটাতেই নেই । পেত্রার্কীয় সনেটের মিল ( কখখক কখখক চছজ চছজ ) কিংবা শেক্সপীরিয়ান সনেটের মিল ( কখকখ গঘগঘ পফপফ চচ ) তার একটা সনেটেও পাওয়া যায় না। " পেখেরা " কবিতায় ক এর সঙ্গে গ এর মিল আবার চচ মিল , " মাদারি " কবিতায় ক এর সঙ্গে গ এর মিল এবং এক্ষেত্রে চচ মিলও নেই । বরং বলা ভালো চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের কিছু কবির মত মিলহীন সনেটই লিখেছেন তিনি । তবে একথা অনায়াসে বলে দেওয়া যায় বুদ্ধদেব বসু বা বিষ্ণু দে র মত সনেটের মেজর কবি দেবদাস কোনদিনই নন । দেবদাসের ছন্দের প্রাণ অন্য জায়গায় যা আগেই আলোচনা করা হয়েছে ।   

               #                   #                 # 



কবিতা নির্মাণে ছন্দ ছাড়া অন্য যে বিষয়ের প্রধান ভূমিকা থাকে তা হল ভাষা ও আঙ্গিক । বহু বহু কবির ভীড়ে একজন কবিকে আলাদা করে নেওয়া যায় তার কাব্যভাষা দিয়ে । বাংলাভাষায় মাইকেল মধুসূদন , রবীন্দ্রনাথ , জীবনানন্দর মত সময় অতিক্রম করে যাওয়া কবিরা সবাই একেকটি নতুন কাব্যভাষা নতুন কাব্যআঙ্গিকের জন্ম দিয়েছেন আর পরবর্তীতে এই  ভাষা ও আঙ্গিকগুলি ঘিরে লালিতপালিত হয়েছেন অসংখ্য অজস্র কবি । 
এখন প্রশ্ন হল নতুন কাব্যভাষা ব্যাপারটা ঠিক কী যা একজন কবিকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে পারে । এই বিষয়টি ভালো করে বোঝার প্রয়োজন । কাব্যভাষা তৈরি হয় একইসঙ্গে শব্দ এবং তার অর্থের পৃথক পৃথক অথচ সম্মিলিত প্রয়োগের ওপর । এই দুটো বিষয়ের কোন নতুন রকমের একত্রিত প্রয়োগের সৌকর্ষ ও সৌষ্ঠব থাকলে কাব্যিক শিল্পজনিত ভাবসৌন্দর্য্যে পাঠকের কাছ থেকে তা সহজেই আলাদা একটা ভালোবাসা আদায় করে নিতে পারে , যা এর আগে ওই ভঙ্গীতে প্রয়োগ করে আর কেউ দিতে পারেননি কবিতায় । ... কঠিন , ভীষণ কঠিন ! সেই কারণেই প্রচুর মানুষ কবিতা লিখলেও শেষঅবধি 'সকলেই কবি নয় , কেউ কেউ কবি ' । 
     দেবদাস আচার্যর কাব্যভাষার প্রাণ হচ্ছে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে থাকা মানুষের ভাষা যা আদৌ কবিতার ভাষা হতে পারে কিনা এ নিয়েই অত্যন্ত রক্ষণশীল পাঠক তর্ক করতে পারেন  । 

১ . " চোদ্দপুরুষের চোতবোশেখের এই ফাঁকা মাঠ আমাদের " 
২ . " গভভ থেকে বেশ কটা খালাস করেছি পরপর 
      একটা কুকুরে খেল , দুটো মোলো ওলাওঠা রোগে " 
৩ . " এক চালান পাঠাবার পর নাচব ধেনো খেয়ে 
৪ . " বাড়ির উঠোনে তার বউ ঘুঁটে দেয় 
    ছেঁড়া ইজের পরে তার বাচ্চাকাচ্চা তোবড়ানো বাটিতে মুড়ি খায়"। 

    ভাষার বিস্ফোরণ ! নয় কি ? ভাষা এমন বিষয় যে সেই ভাষার সঙ্গে প্রাণগত যোগ না থাকলে কবিতায় তার প্রয়োগের ক্ষেত্রকে অনুধাবন করতে একটু অস্বস্তি হতে পারে । এই অস্বস্তিকে স্বস্তিতে পরিণত করে দেয় কাব্যভাষার প্রয়োগজনিত আঙ্গিক । দুইয়ের সম্পর্ক তাই অবিচ্ছেদ্য । 
    জীবনানন্দ থেকে শুরু করে চল্লিশের দশকের সুভাষ নীরেন্দ্রনাথদের ছন্দ আশ্রিত নগরসভ্যতাকেন্দ্রিক প্রতিবাদের কবিতা , রোম্যান্টিক কবিতা.... তারও পরে পঞ্চাশের দশকে সুনীল শক্তি শঙ্খ শামসুরদেরও সেই একই নগরকেন্দ্রিক রোম্যান্টিক কবিতা ( তফাৎ হল পঞ্চাশের দশকে রোম্যান্টিক কবিতায় আবেগ ও যৌনতা দুইয়েরই তীব্রতা অনেক বেশি ) পড়ে পাঠক মুগ্ধ হয়েছেন ঠিকই , কিন্তু শুধুমাত্র মুগ্ধতাই কবিতাকে স্থায়ী করে যেতে পারে না , যতক্ষণ না পাঠক সেখান থেকে নতুন কাব্যভাষা ও আঙ্গিকের সন্ধান পান , এবং তার প্রয়োগের ক্ষেত্রকে স্বস্তি দিয়ে অনুধাবন করতে পারেন । 
   কবি দেবদাস কবিতা লিখতে এসেছেন ছয়ের দশকের শেষপ্রান্তে , এবং এসেই পূর্বাপর সমস্ত প্রথাগত ভাষানুসন্ধানের বাইরে একটা অন্য আঙ্গিক অন্য ভাষার সন্ধান দিয়েছেন যা তার কবিতানির্মাণে চমকপ্রদ ভূমিকা নিয়েছেন । আভিধানিক শব্দের বাইরে গ্রামের মানুষের নিজস্ব কথ্যভাষা দেবদাসের কবিতায় এসেছে এই সমস্ত মানুষের প্রতি তার একান্ত মমত্ববোধের সাক্ষ্য হিসেবে । আর যে আঙ্গিকে তিনি তা ব্যক্ত করেছেন তাতে এই ভাষা আর আঙ্গিক মিলেই তৈরি করে দিয়েছে তার কবিতার দর্শন । .... সুতরাং দেবদাস আচার্যর কাব্যভাষা আঙ্গিক একান্তভাবেই তার নিজস্ব , যা কোনদিন পাঠকের বিদ্যামনস্কতা দাবী করে না , কিন্তু তবু তার মুখোমুখি হয়ে সব পাঠককেই সামান্য থমকে দাঁড়াতে হয় । আধুনিকতম কবিরা সামাজিক বিবর্তনের ফলে উদ্ভূত শব্দকে কবিতায় ব্যবহার করতে সদাসচেষ্ট ঠিকই , কিন্তু সেই ব্যবহারেও শব্দের শুদ্ধীকৃত রূপই লেখা হয় । অন্যদিকে দেবদাস সপাটে ব্যবহার করেন একেবারে স্বাভাবিক শব্দ ফলতঃ তার কবিতারূপী কথন হয়ে ওঠে অনেক বেশি জীবন্ত ।  

       " তারপর সে হেউউ শব্দ করে 
        লম্বা একটা ঢেঁকুর তোলে "   ( শুভেচ্ছাপত্র ) 

কিংবা 

          " কিন্তু সে এবার 
            গ্রিলে বসেই শব্দ করল 
           : কুউ
            কুউউ 
            কুউউউ "( শব্দ-ভূত : বিন্দু নয় রেখা নয় )

      এই ' হেউউ ' এবং  ' কুউ কুউউ কুউউউ ' জাতীয় শব্দ দেবদাস আচার্য এতটাই সঠিক নৈপুণ্যে প্রয়োগ করেন , যে তা যেকোন সময়ে তার কবিতাকে সাধারণের মোড়কে অসাধারণ পর্যায়ে তুলে নিয়ে যেতে পারে অতি অনায়াসে । এই ভাষার সঙ্গে পাঠকের কবিতায় নিবিড় পরিচয় না থাকায় কমবেশি একটা বিড়ম্বনার সম্ভাবনা থেকেই যায়, কিন্তু পাঠক সেই বিড়ম্বনা আরাম করে কাটিয়ে উঠতে পারে স্বতঃস্ফূর্ত এক নিজস্ব কাব্যময় আঙ্গিকে সেই ভাষা প্রযুক্ত হওয়ায় । আর আঙ্গিকের এই নিজস্ব প্রয়োগই কবির এ' হেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাষা থেকে কবিতাকে পাল্টে পাঠকের কাছে নিয়ে আসে পাঠকের ভাষায় তার নিজের মত করে । 
                                                ( চলবে ) 

সোমবার, ২০ মার্চ, ২০২৩

তৃতীয় পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

''অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে''

সজ্জ্বল দত্ত


৩.

দর্শন ও মূলভাবধারা 


 আধুনিক বাংলা কবিতার কবিদের মধ্যে যাদের কবিতায় নিছক বাকসর্বস্বতা তাদের এমন কোন জোরালো দাবী নেই যে তাদের নিজস্ব জীবনদর্শন এবং তাকে জড়িয়ে কবিতার অন্তর্নিহিত দর্শন নিয়ে আলোচক মাথা ঘামাক , আলোচকেরও নেই সেই দায়বদ্ধতা । কিন্তু প্রকৃত বোধসম্পন্ন কবির কবিতার দর্শন ও মূলভাবধারা ঠিক কোন্ পথে কিভাবে আসে তা নির্ধারণ করতেই হয় , নাহলে আলোচনা থেকে যায় অসম্পূর্ণ । আর এও ঠিক , ব্যাপারটা কোন নির্দিষ্ট  ফর্মুলায় হয় না । রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যেমন বেশিরভাগ আলোচকই একমত যে রবীন্দ্রকবিতার দর্শনের মূল ভিত্তি হল উপনিষদ । " ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যথ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ " । কিন্তু সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত স্বল্পসংখ্যক কয়েকজন বলছেন ' রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন সমাজবিজ্ঞানী , তার দর্শনের মূল ভিত্তি হল আধ্যাত্মিক জড়বাদ । রবীন্দ্রনাথের মত এমন আশ্চর্যভাবে কবিতায় বিপ্লবের ব্যাখ্যা আর কেউ দেননি । 

   কবি দেবদাস আচার্য সম্পর্কে চোখ বুঁজে বলে দেওয়া যায় যে উনি সমাজতান্ত্রিক ধারণার কবি । 

   " আমি ফিরে এসেছি তোমাদের মধ্যে 
    বারবার ফিরে এসেছি 
    এই মধু ও গম , ধানের শিস হাতে 
    এই লাঙলের ফলা হাতে 
    প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে, প্রতিটি জনপদে, 
    আমাকে স্পর্শ করো এবং উদ্দীপিত হও " । 
                ( রাজা বিক্রমাদিত্য বলেন : উৎসবীজ ) 

এই লাইনগুলি পরিস্কারভাবে তার প্রমাণ । কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মানে তিনি কি মার্কসবাদী ? শ্রেণীসংগ্রাম, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ধারণা তার কবিতায় তেমনভাবে চোখে পড়ে কি ? 
 কবি দেবদাস অবশ্যই সমাজতান্ত্রিক ধারণার কবি নন , তিনি ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের কবি ।  

   " সবাই চলে যায় উৎসমুখ থেকে 
    নিরবচ্ছিন্নভাবে, নিরবধিকাল । 
    কালও চিহ্নহীন হয়ে যায়, স্মৃতি লুপ্ত হয় 
    রূপান্তরে পরিবর্তিত হয়ে যায় মহাকালও । 
          #             #           #            # 
    নদীতে পুরোনো ঢেউ পুনর্বার জাগ্রত হয় না , 
            অতিক্রান্ত সময়ও কখনো 
            ফিরে তাকায় না পশ্চাতে । 
                  #             #             #             # 
            একদিন ধীরে ধীরে এই চিরগতি মিশে যায় 
            জরা-মৃত্যুহীন এক অন্তহীন গতির বলয়ে " । 
                             ( ' অমর ' : তর্পণ ) 

          এইবার কী প্রমাণ হয় , দেবদাসের কবিতায় অসাধারণভাবে এই দুইয়ের মিশ্রণ ? মাটি আর মানুষের সঙ্গে আত্মার যে নিবিড় সম্পর্ক সেটাই সকলের চেয়ে বড় নিত্য সম্পর্ক । যে মুহূর্তে কবি , তোমার মধ্যে এই সত্ত্বা জেগে উঠবে , সেই মুহূর্তে কবি তুমি সমস্ত জগৎ সংসার বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তোমার কবিতায় কাছে টেনে নিতে পারবে । অন্তরের সবকটি দ্বার উদ্ঘাটিত হবে , উঠে যাবে তুমি শ্রেণীচেতনার ঊর্ধ্বে । 

কবি দেবদাস আচার্যর কবিতায় প্রথম থেকেই পাওয়া যায় এই জীবনদর্শন । শ্রমের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা আর সেই সঙ্গে কোষে কোষে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া ভারতীয় দর্শন । জীবাত্মা ও পরমাত্মা দু'য়েরই স্বচ্ছ বোধ বা ধারণা তার কবিতার দর্শনকে , কবিতার মূলভাবধারাকে এক সর্বোচ্চ পর্যায়ের আসন দিতে পেরেছে । দেবদাস আচার্যর আত্মজীবনীর যে একটি অংশ ' গল্পসরণি ' পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল , তার থেকে জানা যায় তার কিশোর বয়স থেকে উদ্বাস্তু জীবনের কথা , অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের জন্য পরিবারের অন্যদের সঙ্গে নিয়ে একটা সময়ে নিরন্তর সংগ্রামের কথা যা হয়তবা তাকে দিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক দর্শনের অনুভূতি । পাশাপাশি পিতা ও মাতার প্রভাবে এবং সম্ভবত: কিছুটা সদব্রাহ্মণকূলে জন্মের কারণেও ধীরে ধীরে তার মনে জেগে ওঠে ভারতীয় দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা । এই দুইয়ে মিলেই তিনি কাব্যিক সুষমায় লিখে যেতে পেরেছেন সৃষ্টির বিবর্তনের প্রকৃত ইতিহাস, আর সঙ্গে ইঙ্গিত দিয়ে যেতে পেরেছেন সভ্যতার আগামী গতিপথের দিকে । তবে তার কাব্যভাবনার শুরুর দিকটা কিন্তু অনেকটাই খেটেখাওয়া মানুষের দিনলিপি । এইখান থেকে প্রথম উল্লেখযোগ্য মোচড় " উৎসবীজ " , এবং দ্বিতীয় " আচার্যর ভদ্রাসন " । 
   " উৎসবীজ " পৃথিবী থেকে শুরু করে গোটা সৌরজগৎ , ছায়াপথ , সেখান থেকে আরো দূর মহাশূন্য ব্যপী ছুটে বেড়ানো এক প্রচণ্ড কম্পন , যা এগিয়ে নিয়ে যায় সহস্র লক্ষ কোটি বছর ধরে সময়ের ইতিহাসকে । নিছক বস্তুবাদী সমাজতান্ত্রিক ধারণায় একে আবদ্ধ রাখা যায় না । দেবদাসের পূর্ববর্তী কাব্যগ্রন্থগুলি থেকে " উৎসবীজ " এই কারণে পৃথক । উৎসবীজে দেবদাস লিখছেন : 

    " ছিল এ জগৎ শুধু 
      বস্তুভারে ক্লান্তিকর , নিরেট , নিষ্প্রাণ , 
      অন্ধকারে অগ্নিরাশি মহাতারকারা 
      ছড়ায় লোলুপফণা , অদৃশ্য-গহ্বর 
      গ্রাস করে ভ্রাম্যমান বস্তুপিণ্ড , শিলা । 
      প্রাণের নিনাদহীন জড় ছায়াপথ 
      নিরন্তর প্রসারিত হয় , অবিশ্রাম 
      ছোটে নিজ গ্যালাক্সিতে , বস্তুর পাহাড় 
      সংখ্যাহীন পরিমাপহীন , কোন গতি 
      অন্তহীন খাতে করে নিয়ন্ত্রণ ওই 
      অগ্নিময় নিষ্প্রাণ বস্তুর জঙ্গল " । 

প্রাণের বহুপূর্ব থেকে এই উৎসবীজ-বিস্তৃতির সূচনা । আর ব্যক্ত প্রাণকে কিভাবে বলা হচ্ছে এই কাব্যগ্রন্থে ? 

       " একটি কণিকামাত্র , সৌরকক্ষে স্থিত 
         ছায়াপথে লুক্কায়িত , আহ্নিক গতির 
         নিয়ন্ত্রণে ঘূর্ণমান , ভৌম-প্রেক্ষাপটে 
         অস্তিত্ববিহীন প্রায় , অতীন্দ্রিয় ধ্যানে 
        আভাসিত হয় শুধু , ব্রহ্মাণ্ডলোকের চেতনায়। 
        তবু তার জন্যে সমারোহে 
         বহির্বিশ্বের সব নক্ষত্রপুঞ্জের 
         নিজ নিজ মহাকাশে উড়ল পতাকা , 
         ওঁ-ধ্বনি জাগরিত হল নাভি থেকে 
         ব্রহ্মাণ্ডলোকের " । 

" উৎসবীজ " এর পরের কাব্যগ্রন্থ " আচার্যর ভদ্রাসন " । সেখানেই প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে চমৎকারভাবে বস্তুবাদী ও আধ্যাত্মবাদী দর্শন মিশে গেছে । ' আচার্যর ভদ্রাসন ' এর কবিতাগুলো লেখার স্টাইল একেবারে অন্যরকম । সিদ্ধাচার্যরূপী কবির ইন্দ্রিয়জগতে চেতনায় যা ধরা পড়ছে তাই এখানে কবির কবিতার মূল ভাববস্তু । কিছুটা যেন নাড়িচক্র সাধনার মত , যেন চর্যাপদের কবিদের সাধনারই আধুনিক রূপ , যেন দেহবাদী থেকে ক্রমশঃ দেহাতীতে যাওয়ার চেষ্টা । সিদ্ধাচার্য শূন্যবাদী , নির্বাণ-পিপাসু । সিদ্ধাচার্যর সাধনসঙ্গিনীর লালপেড়ে মোটা শাড়ি । পেচক , শব ও শিবা সিদ্ধাচার্যের গান শোনে । পদ্মের ওপর বসে নৈরাত্মমণি তাকে কোলে তুলে নেন । এইসব বিবিধ অনুষঙ্গে প্রমাণ হয় লুই পা , কাহ্ন পা র চর্যার দর্শনের আধুনিক রূপ , যার প্রতিটি স্তরে কবি আঁকড়ে ধরেন মানুষকে । " উৎসবীজ " এর কবিতা মানুষ তথা প্রাণের ঊর্ধ্বে আরো অনেককিছু । আচার্যর ভদ্রাসন-এ --

       " রাত ঘন হয় , আর অতিপ্রাকৃতিক 
         ব্রহ্ম-পদ্ম ফুটলে ডেকে ওঠে ডোমের কুকুর 
        #                   #              #                 # 
         এই প্রসারতা অন্তহীন , 
         তারও পরে আছে বিশুদ্ধ ধ্যান 
         তারও পরে ? 
         #                   #               #                 # 
         সিদ্ধাচার্য ভ্রষ্ট সন্ন্যাসী 
         তার তৃতীয় নয়ন 
         অশ্রুতে ভেসে যায় । " 

   এই অশ্রু মানুষ ও মানবতার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার অশ্রু , ব্রহ্মপদ্মের পাশাপাশি ডোমের প্রসঙ্গই তার প্রমাণ । গোটা ' আচার্যর ভদ্রাসন ' কাব্যগ্রন্থেই কবির সংবেদনশীল মন এমনি করে খুঁজে ফিরেছে চলমান জীবনযাপনকে আর আকুল প্রার্থনা করেছে এই মায়ামমতাময় জীবনে মানুষের সঙ্গে যেন আজীবন থেকে যেতে পারেন । নাড়িচক্রে মূলাধার থেকে আজ্ঞা পর্যন্ত সবকটি চক্রে যেমন একেকটি পদ্মের মুখ খোলে আর একেকটি জগৎ উদ্ভাসিত হয় , তেমনি এখানেও পর্যায়ক্রমে একে একে যেন খুলে যেতে থাকে জীবনের একেকটি পর্দা । 

   " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি " প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেবদাস আচার্যর কবিতার দর্শন একটি নির্দিষ্ট দিকের সন্ধান করেছে । " মৃৎশকট "এ তা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে । তারপর " মানুষের মূর্তি "র খেটে খাওয়া মানুষের ছবি এবং আরো আরো বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের পথ পার হয়ে প্রথমে " উৎসবীজ " তারপর " আচার্যর ভদ্রাসন "এ মিলিত হল দুই প্রান্তের দুই দর্শন এবং তৈরি হল দেবদাসের কবিতার নিজস্ব দর্শন যা পরবর্তীতে ঠিক ঠিক উত্তরিত হয়েছে " সুভাষিতম "-এ , "তর্পণ"-এ । 

    " প্রতি মুহূর্তের এই পৃথিবী 
       যে গতিতে ঘূর্ণায়মান 
       তার চেয়েও দ্রুতগতিতে ঘূর্ণায়মান 
       চেতনার জগৎ "          ( সুভাষিতম ) 

এই চেতনার জগৎ প্রবলভাবে আছড়ে পড়েছে বর্তমান পৃথিবীতে , খুঁজে ফিরেছে ইতিহাস , সভ্যতার ভিতরে-বাইরে কালের প্রতিটি ক্ষুদ্রাংশে এবং অবশেষে ভালোবাসার আকর্ষ ছড়িয়ে দিয়েছে মানুষের জন্য , ঈশ্বর বা শয়তানের জন্য , সকলের জন্য , সবকিছুর জন্য । মানুষ , ঈশ্বর , শয়তানের এই সাম্য এক নির্বিকার আসক্তির প্রবাহ -- এই পৃথিবী । 

দেবদাস আচার্যর কবিতার দর্শন ও মূলভাবধারা সময়ের বয়ে চলা এবং তার সমস্ত উপাদানকে সঙ্গে নিয়ে এক আশ্চর্য আলোয় উদ্ভাসিত । যা বিস্তৃত বিলুপ্ত ছিল , কবিতার জাগ্রতক্ষেত্রে এসে তাকে রহস্যে একেবারে অভিভূত করে দিচ্ছেন কবি দেবদাস। সমস্ত চেতনাই যে এক অখণ্ড ও অবিচ্ছিন্ন - এই তত্ত্বকে প্রত্যক্ষ করতে হলে দেবদাসের কবিতার বিস্তৃতপাঠ অবশ্য প্রয়োজন। দেবদাস-কবিতায় চেতনা অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে একটা হাইফেনের মতো, যা অনায়াসে মিশে যেতে পারে জড়ের সঙ্গে, আর পাঠক আমরা নিমেষে জড়রাজ্যকে জড়িয়ে জড়রাজ্যের বাইরেরও সমস্ত বিষয় নিজচেতনায় ধারণা করতে সমর্থ হই। 

                                    ( চলবে ) 

শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০২৩

দ্বিতীয় পর্ব: অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

          

''অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে''

সজ্জ্বল দত্ত



   ২ . 


             মানুষের মূর্তিই কালক্রমের প্রতিধ্বনি
 
        " সে নিড়িনি চালায় শস্যে , বিদে দেয় , 
          খুঁটে তোলে আগাছা 
                   #            #          # 
          সে যায় মাঠে , যখন কাকপক্ষী ওঠে 
         সে যায় মাঠে , তার বৌ ঢেঁকিতে ধান কোটে 
         যখন মোষের শরীর ছুঁয়ে সারা মাঠে 
                            অন্ধকার নামে 
         সে ফেরে বাড়ি, মোষের পিঠে চেপে 
                  #               #           # 
        সে বিদে দেয় মাঠে , আর ফসল ডাঁসা হলে 
        কাকতাড়ুয়া পুঁতে দেয় ,
        গরুর খুলি ঝুলিয়ে দেয় ক্ষেতে । 
       সে পগার কেটে জল আনে গেঁড়ে-গর্ত থেকে 
       তার মেয়ের মতো ঘাগরা দুলিয়ে 
                             ফসল খেলা করে ,
       আলের ওপর দৌড়ায় সে বনবিড়ালের মতো, 
      সে নিড়িনি চালায় শস্যে , বিদে দেয় .... " 

এই ছবিতে যে শ্রেণির মানুষের মূর্তি , তাকে নিয়ে যুগ যুগ ধরে লেখা হয়েছে কবিতা , তৈরি হয়েছে অসংখ্য শিল্পকর্ম । দেবদাস আচার্যর " মানুষের মূর্তি " নামে একটি কাব্যগ্রন্থ থাকলেও এই লাইনগুলো কিন্তু তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি "র একটি কবিতার । এখন কথা হচ্ছে , কালক্রম কিসের প্রতিধ্বনি করছে এই জিজ্ঞাসার কোন উত্তর দেবদাসের এই কাব্যগ্রন্থে আছে কিনা । " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি "র প্রকাশকাল ১৯৭০ , তারপর " মৃৎশকট " ১৯৭৫ , তারপর " মানুষের মূর্তি " ১৯৭৮ । কালক্রম ... ও মৃৎশকট এর কবিতার উদাহরণ পাঠক আগে পেয়েছেন , এবার " মানুষের মূর্তি "র একটা-দুটো কবিতার কথা শোনা যাক । 

         ১ . " আমার বাবা সেলাইকল চালান 
               এবং তার ঘামে ভিজিয়ে দেন রুটি 
               সেই রুটি খেয়ে আমাদের এত স্পর্ধা 
               যা সব কুলি-কামি'দের থাকে "। (স্পর্ধা)    
                                                
         ২ . "ঐ আমার বাবা হেঁটে যাচ্ছেন , 
                ধুকড়ি গায়ে 
                তাঁর হাঁটু অবধি ধুলো 
                তাঁর চলার পথে বেজে উঠছে 
                শঙ্খ, ঘন্টা, খিদে, শ্রম -- "  ( বাবা )         

     এই দুটো কবিতাংশের ' বাবা ' আর প্রথমে উল্লিখিত কবিতাটির ' সে ' , এই দুইয়ের মধ্যে কোনোরকম কিছু চরিত্রগত মিল ? ... " কালক্রম ও প্রতিধ্বনি " এই নাম থেকেই স্পষ্ট যে মহাকালের ধারণার ওপর প্রধানতঃ জোর দিতে চেয়েছেন কবি । তারপর " মৃৎশকট " , কোটি কোটি বছর ধরে কালের তথা সভ্যতার বিবর্তনের কথা । তারপর " মানুষের মূর্তি " , আসল যাকে ঘিরে মহাকাল বা সভ্যতার বিবর্তন ধ্বনিত , যা না থাকলে পুরো প্রসঙ্গই অর্থহীন । এই মানুষের মূর্তি ' ছুতোর কাকা'র , 'ন্যুব্জা বৃদ্ধা'র , 'আমার বুড়িমা'র , 'নীল রঙের জামা প্যান্ট পরে রেলের খালাসী গোপেশ্বর কাকা'র , যাদের সঙ্গে নিয়ে কবি দেবদাস আচার্যর হেঁটে যাওয়া অনন্তপথ । হেঁটে যাওয়া মানে কার্পেট বিছোনো রাস্তায় নয় , হাঁটু অবধি ধুলোর রাস্তায় । মাটি আর মানুষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে থাকা কবি এই পথেই ধীরেধীরে অতিক্রম করছেন মহাকালের একেকটি চূড়া।
" ঘুম ও জীবনের মধ্যে রয়েছে এক পরিশ্রম "
  ঘুম ও পতনের সন্ধিক্ষণে নিরীহ মানুষেরা 
  দু'পাশে সাদা দেওয়াল , 
  মাঝখানে পৃথিবীর বয়স হারিয়ে যাচ্ছে " । 
'কালক্রম ও প্রতিধ্বনি'র কবিতার শুরু এইভাবে । আর এই তত্ত্বই পরবর্তীকালে ছবি হয়ে উঠে এসেছে 'মানুষের মূর্তি'র প্রতিটি কবিতার প্রতিটি স্তরে । পরিশ্রমী নিরীহ মানুষ পতনের সন্ধিক্ষণে যুগে যুগে দেশে দেশে । তারা 'ছুতোর কাকা' , 'ঘড়ামী কাকা' , 'গাড়োয়ান পিসেমশাই' বা হয়ত 'পাঁউরুটি হাতে মিস্ত্রীদাদু' , আবার সমষ্টিগতভাবে তারাই এরা যারা ১৯৪০-৪১ সালে বর্মা থেকে দলে দলে ইভ্যাকুয়ায় আসে , তারাই এরা যারা প্রবল বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়ে দু'মুঠো অন্নের আশায় ভিড় করে স্কুলবাড়িতে । দেবদাস আচার্যর কবিতায় এদের মূর্তিই মানুষের মূর্তি , এদের জীবনকাহিনীরই প্রতিধ্বনি করে কালক্রম । সময়ের কালক্রমকে তিনি দেখতে পান এইভাবে : 
  " এই এক সময় বটে , 
     তেজস্ক্রিয় বাতাসে আমরা উড়াই ফানুস 
    আমাদের প্রেতযোনি আমাদেরই বুকের ভিতর
    খোঁড়ে উচাটন , 
    যা ছিল সম্পদ সব 
    তীব্র জারকে খসে ধ্বস হয়ে মিশেছে মাটিতে 
    অথচ আমরা এক ছায়ালোক বৃত্তরচনা করি 
    প্রাণপণ সুতো ছেড়ে ছেড়ে " 
              ( এই এক দুঃসময় ) 
দুঃসময় থেকে ধীরে ধীরে সময়ে আস্থা রাখেন তিনি সত্তর দশকে । " তখন গামবুট পায়ে বিপ্লবী গেরিলার মতো মেঘ নেমে আসে / পৃথিবীর খুব কাছে , প্রায় প্রতিটি ঘরের দরজায় " .... ( ঝড় : সত্তর দশক ) । আর এই বিপ্লবী গেরিলাদের জড়ানো কাব্যরূপ ঠিক কেমন ? " মাঠ ঘাট ঢুঁড়ে ফেরে তীরন্দাজ , / খামারে আগুনধরা শস্যের ওপরে তারা নাচে ! / সমস্ত জগৎজোড়া বাতাস উন্মাদ করা আর এক সময় প্রায় আসে " ... ( হাজার তীরন্দাজ এই দেশ জুড়ে ) । 



   এই হল কালক্রম । আর তার প্রতিধ্বনি করে তারা যারা নিড়িনি চালায় শস্যে, যারা পেরেক ঠুকছেন ভাঙাচোরা আলমারিতে, যারা সেলাইকল চালান এবং তার ঘামে ভিজিয়ে দেন রুটি । কালক্রমের প্রতিধ্বনি করে মানুষের মূর্তিই । মানুষ বলতে তাবৎ খেটে খাওয়া মানুষ । দু'দুটি বিশ্বযুদ্ধ উত্তর নগরসভ্যতার পৃথিবীতেও যাদের জীবনধারা সেই একই স্রোতে , ঘুম ও পতনের সন্ধিক্ষণে । তাদের ছোট ছোট ব্যথা , ছোট ছোট সুখের মুহূর্তগুলি ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে ঘামের সঙ্গে মিশে । তবু তারই মধ্যে তাদের আবেগ প্রিয়জনের জন্য তাদের মমত্ববোধ কবি দেবদাসের কলমে : 
    " সারা দুপুর প্রখর রোদ্দুরের মধ্যে 
             মা সংসারের কাজ করেন 
     আর বিড়বিড় করে মাঝেমাঝেই বলেন - 
    তুই জানিস খোকা , হাটে ছায়া আছে তো ? "

' আজ ' মানে তাদের কথা । ' কাল ' মানেও তাই । আর মহাকাল ? সেই ঘুরেফিরে ' ... তাদের ঘিরে একটু একটু করে বড় হতে থাকি , প্রতিদিন একটু একটু করে ' 

                                          ( চলবে ) 

  

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...