শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১
প্রণব বসুরায়'এর কবিতাগুচ্ছ
প্রণব বসুরায়'এর কবিতাগুচ্ছ
★ মন্ত্র
কিছুটা নিজের মতো, বাকিটা সামঞ্জস্য করে
উঠোনের রোদ ভাগ করে নিই, চিরকাল
রোদ্দুর কখনও সেভাবে আসেনি, তাই
আমাদের ঘর কবে থেকে ভিজে থেকে গেছে
ছাঁটবার আগে নতুন ধান শুকিয়ে নিই উঠোন-রোদ্দুরে
লক্ষ্মীর পা থামে এসে আমাদের মাটির কুটিরে...
আমরাও দ্রব হতে থাকি
মিশে যাই চাঁদের লুন্যাটিক আদুল আভায়
তোমার নাভিতে আজ মন্ত্র দেব বলে
এই দ্যাখো, স্নান সেরে গা-ও মুছিনি...
★ দায়িত্ব
অসমাপ্ত কথা ঝোলে-- গাছ থেকে
যেন এক লাশ, হাওয়ায় দুলছে,
চোখ দু'টি উপড়ে আছে, বীর্য মাখা প্যান্ট এখনও ভিজে
ভিড় জমেছে, মেয়েরা আড়চোখে দেখে, ঘুমে চলে যায়!
যতক্ষণ না পুলিশ ও ছবিওলা আসে
এ লাশের দায়িত্ব আমিই নিলাম...
★ নাট্টোৎসবে প্রবেশ নিষেধ
সফল সম্ভোগের দ্যোতনা জাগাতে পারিনি বলে
এই আশ্চর্য রাত্রি মুখ ঢাকে লজ্জাবস্ত্রে—
আমরা শুরু করি যুদ্ধের কথা
বস্তুতঃ
কোন যুদ্ধেই জয়-পরাজয় স্থায়ী হয় না, তবু
পরাজয়ের গল্প কেইবা শোনায়!
এখন নীহারিকা থেকে কিছুটা আলো এসে
ধুয়ে দিচ্ছে যাত্রা-মঞ্চ
আমরাও বদলেছি পোশাক সাবেক কালের...
নাট্টোৎসব শুরু হয় হয়
এখানে দর্শকের প্রবেশ নিষেধ...
★ আনাচ কানাচ
ভাবো, এক লুপ্ত নগরী, বসে আছি—
তোমাদের হাতে গাঁইতি, শাবল, লম্বা ফিতে
কোমল আঘাতে প্রত্নচিহ্ন ফুটে উঠছে, আর
তোমাদের উল্লাস ছবি হয়ে...
এফোঁড় ওফোঁড় সেলাই হয়ে যাচ্ছে
পাথরের ভাঙা কাপ ও পিরিচ, মোমদানি
রাত্রি হলে চলে যাবে তোমরা বিপুল মদিরায়
আর আমি খুঁজে দেখবো আনাচ কানাচ
★ ঘটনাচক্র
দক্ষিণের জানলা বেয়ে ভেসে এলো শাঁখের আওয়াজ মৃদু, মাঙ্গলিক
আরো ছিল নানা কন্ঠের শব্দজট, হাসির তবক। তিথি-উৎসব...
উত্তরে নিরেট দেয়াল, তাই এই-ই আমার সীমিত কারাকক্ষ
তোষকছাড়া চৌকি ও মশারী আছে, বিদ্যুতহীন ব্যবস্থায়
বই খাতা, খাদ্যাখাদ্য একশ শতাংশ অপ্রাসঙ্গিক
দক্ষিণ দিগন্ত কিছুই কাছের নয়, ওইদিকে সাগর-- শুনেছি
ঘটনাচক্রে এঘরের জানলাটা ঐদিকে খোলে
★ কৃষ্ণগহ্বর
বহুদিন পরে ফের একবার নিধুবনে
সরাসরি লম্বা হয়ে শোওয়া—
আকাশ, চাঁদ, তারা হয়েছে উধাও
উচাটন বাজে শুনি নূপুর নিক্কণে, মৃদুময়...
ঝরণার ফোঁটা জলে জিভ পেতে ঈষৎ লবণ
যতেক ব্যঞ্জন সব স্বাদু করে দেয়
পরীর আখ্যান শুনি লোকমুখে, থাকে সূত্রধর
আনন্দ-ধ্বনি ওঠে কৃষ্ণগহ্বরে...
★ সংবাদ
চংক্রমণের পরে বৃষ্টি নামে খুব
তার আগে হাওয়ায় উড়েছে শাড়ি পাশের বাড়িতে
সদ্ভাব নেই তত যতটা রয়েছে কুটিল সংশয়
দু’টো বাড়ি ধুলো মাখে, রোদে পোড়ে একসাথে
আজ তারা বৃষ্টি মাখবে...
পঞ্জিকা কোন সিদ্ধান্তের শেষ বাচক নয় বলে
ভিন্ন লগ্ন, আলাদা নক্ষত্র হতে পারে, প্রায়ই হয়
তবে
আজ তারা একসাথে বৃষ্টি মাখবে—
আপাততঃ এটাই সংবাদ
★ তারা-কথা (২৩)
শব্দ বেজেছে কোন দূরে, কোথাও লুকোনো আছে ঢাক
মহুয়ার বনে কোন অছিলায় উৎসব শুরু হয়ে গেল
পাচার হচ্ছে মেয়ে এই ফাঁকে সীমান্তের কাঁটাতার ছুঁয়ে...
বনান্তরে যেতে পারি, এসব পেরিয়ে, শুতে পারি শিরীষতলায়
সুচারু শিল্পের কথা রটে যাক... লৌকিক গানে
★ তারা-কথা (২৪)
এসে গেছে উৎসবের কাল, শহরের শরীরে সেই ঘ্রাণ
নতুন পোশাকগুলি পৃথক চরিত্র হয়ে
ভিন্নতর বার্তা ওড়ায় বেলুনে বেঁধে, নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে
এসবের সঙ্গে আমার কোন আঁতাত নেই
তর্পণের তিল জল ভেসে যায় সঙ্গমের টানে
সেই জলে তৃষ্ণা মেটাবেন পূর্ব পুরুষ!
আকাশ ঢেকেছে মেঘ
ঘরে দেখি ঘি মাখা পান্তার থালা!
★ তারা-কথা (২৫)
চোখ ভারী, হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে
মনে হয় ধূপের ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাব
অপরিমেয় শূন্যতায় দেখা যাবে এক নতুন নক্ষত্র-- যার
কোন আলো নেই, শুধু চোখে পড়ে মহাকাশ গবেষণা যন্ত্রে
এসব প্রাক্তন কথা সরিয়ে রাখছি
মরুর শহরে ছাউনি পড়েছে
মরূদ্যানের সন্ধান পেয়েছি, যদিও
মরীচিকা বারবার ভুল পথে টেনে নিতে চায়...
কবি পরিচিতি ~
প্রণব বসুরায় বরাবর শ্রীরামপুর শহরের বাসিন্দা। কর্মসূত্রে
যুক্ত ছিলেন এলাহাবাদ ব্যাঙ্কে। প্রথম মুদ্রিত কবিতা ১৯৬৪
সালে। 'কন্ঠস্বর' পত্রিকা প্রকাশনা এবং 'শীর্ষবিন্দু' পত্রিকা
সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। দেশ, কৃত্তিবাস, কবি
সম্মেলন প্রভৃতি পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রকাশ পেলেও
লেখালেখি মূলত লিটল ম্যাগাজিনে।
প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ - প্রণয়রাংতা, এ বাড়িতে রান্নাঘর নেই,
ফ্রেডরিক নগরের বাসিন্দা, মাইনাস ডেসিবল ,
চর্বির মোম যেটুকু আলো দিতে পারে এবং রাতের সেলাই কল।
মীরা মুখোপাধ্যায়'এর কবিতাগুচ্ছ
মীরা মুখোপাধ্যায়'এর কবিতাগুচ্ছ
★ অপেক্ষা
প্রতিদিন আবহাওয়া অফিস বলে
তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যাবে দক্ষিণের প্রাচীন ঝরোখা
আমি সাবধানী তাই ভয় পাই, জানলা বন্ধ করি
সদ্যকেনা পর্দা সরাই
কিন্তু কোথায় !
তুমুল বৃষ্টির জন্য আর ভয় নেই
এখন অপেক্ষা করি।
হাট করে খোলা থাক
তার জন্য ঝরোখাদর্শন
★ বন্ধুর কথা
আমি প্রথম তাকেই দেখি এতো ঝকঝকে
বুদ্ধিদীপ্ত, টানটান এক কবি।
বৈরাগ রঙের দীর্ঘ পাঞ্জাবী ও জিন্স।
রেলের ওপারে থাকে...
কবিরা , বিশেষ করে আমাদের গ্রাম্যশহরে
একটু অগোছালো হবে, খানিকটা এলোমেলো
এরকমই চোখসওয়া
কিন্তু সে তেমন নয়, একেবারে অন্যরকম।
নিজের কবিতা নিয়ে তার খুব মায়া ছিলো, অহংকারও
'মাধবীলতা ' ও একটি 'রবীন্দ্রগানের ' মতো
তার স্মৃতিভারাতুর কিছু
শব্দচয়ন আজ ভারি মনে পড়ছে
সে নেই।
কিন্তু সত্যি কি নেই !
তাহলে কি করে লেখে সজ্জ্বল
"বেরিয়ে পড়েছি আজ অলৌকিক অক্ষরের খোঁজে"
★ বেলান্ত
কি করে এতটা পথ পেরিয়ে এলাম
ভাবলে অবাক লাগে
আজ আর ডাকনামে ডাকবার কেউ নেই
বুড়ি মাগী, আমি নাকি চন্দ্রমল্লিকা ...
হাসি পায়,
বার্ধক্যে কেমন যেন লজ্জা থাকে
স্বীকার করবে না জানি...
প্রোফাইল খুলে দেখো
আমরা সবাই যৌবনের মুখ এঁকে
অনুরোধ লিখে পাঠিয়েছি
★ ভাস্কর্য
সমুদ্রের তীরে বসে
উদাসীন আঁকছিলো ছেলেটি
ঢেউ এতোদূর এসে মুছে দিচ্ছিল না ঠিকই
তবে মাঝে মধ্যে ছুঁয়ে দেখছিল দৃশ্য
একবারই দেখলাম, সেও আঁকছে
সে আঁকছে একজন উদাস শিল্পীকে,
সমুদ্রের তীরে বসে যে আঁকছে
বালি দিয়ে সমুদ্রকেই
★ পথরেখা
যে পথ ধরে এসেছিলাম আমি
সে পথ হয়তো হারিয়ে গেছে একাই
উচিৎ ছিলো চিহ্ন রেখে আসা
সাদা ফুলের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া,
যেমনটি ঠিক যুগলপ্রসাদ দিতো
সন্ধ্যেবেলা সাদা ফুলের দিশা
অন্য কাউকে দেখিয়ে দিতো পথ
সকালবেলা একটু বসতে বলে
বাতাস করতো হাতপাখাটির মতো
যে পথ ধরে এসেছিলাম আমি
সে পথ তো আর ফেরার জন্যে নয়
ফেরার পথে আগুন জ্বলে ওঠে
কেমন আগুন, সেটাই তো বিস্ময়
★ মনখারাপের লেখা
যে নদী পেরিয়ে যাচ্ছি আমি
যে পাথরে বসে
একটু জুড়িয়ে নিচ্ছি
সে স্রোতে, সে শিলার শিরায়
তোমার আভাস মিশে আছে।
হিচ হাাইকিং করে চলে যাওয়া দলটি এখন
শহর পেরিয়ে গেছে,
তুমিও ওদের সাথে...
বৃষ্টি নেমেছে তাই
আমি একা জ্যোৎস্নায় ভিজে
পার হচ্ছি নদী
তোমরা যেদিকে গেছ
ঠিক তার বিপরীত দিকে
★ নস্টালজিয়া
আমাদের এদিকে আগে মাঠ ছিলো
উলুখাগড়ার বন
বর্ষার পর পরই চামর দুলিয়ে দেখা দিতো
আদুরে শরৎ ,
তখন মাঠের ধারে বসে থাকা
আঃ ! সে এক স্বপ্ন যেন...
মনে হতো চারিদিকে সমুদ্র সফেন,
নিজেকে কেমন যেন দ্বীপ মনে হতো
এখন সেখানে বহু বাড়ি উঠছে
কোথাও সমুদ্র নেই, উলুবন নেই
তবু আমরা বসে থাকি
বসে বসে দেখি ওদের বাড়ির প্ল্যান
আধুনিকতর বাথরুমের আয়োজন।
বিকেল হারিয়ে যায় ক্রমে,
উলুবন মিশে যায় মেঘে
আমাদের সাধ্য পেরিয়ে...
★ পস্থিউমাস
হয়তো দিনটা একটি রবিবার
গঙ্গার যেদিকটা দাহভূমি
সেদিকে একজন জল ঢেলে ধুয়ে দিলো
চিতা অবশেষ
হয়তো দিনটা তারা অন্যভাবে কাটাতে চেয়েছে
সপ্তাহে একটা ছুটি...
অথচ কোথায় কি, ফিরতে ফিরতে রাত
লোহা ছুঁয়ে , নিমপাতা দাঁতে কেটে তারা ফিরলো
সেদিনও সকালে ঠিক অন্য অন্য সপ্তাহের মতো
আমার সামান্য একটি লেখা বেরিয়েছে
আমার হলো না দেখা
হয়তো সেদিনও একটা রবিবার...
★ অথ মাধবীলতা
আমাদের জীবন থেকে এতো তাড়াতাড়ি
মাধবীলতার কথা মুছে যাবে ভাবিনি...
আমি তখনও চোখের উপর হাত রেখে
পাখি খুঁজছিলাম একটি কবিতা লিখবো বলে
অথবা মাধবীলতা
মাধবীলতার জন্য উঠোন না থাক
ছোট্ট একটা বারান্দা তো ছিলো !
কিন্তু জীবন থেকে মাধবীলতারা
কবে যেন মুছে গেছে
★ একগুচ্ছ বিষণ্ণ সিম্ফনী
আধো অন্ধকার ভ্যাপসা কুঠুরি ভেদ করে
পুরোনো কবিতাগুলোর কলার ধরে টেনে আনি
কখনও কখনও লিকলিকে নড়া ধরেও,
তারপর বসিয়ে দিই মন্দিরের সামনে
নে, ভিক্ষে কর
দূর থেকে লক্ষ্য রাখি কে কি পাচ্ছে....
ট্যারাব্যাঁকা লেখাগুলোর
সব খুঁত চোখে পড়ে
রাত নামুক, কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে
চোরকুঠুরিতে পুরে দেব
পরদিন আবার বাস টার্মিনাসের সামনে...
কবি পরিচিতি ~
বয়স ষাট। জন্মস্থান কলকাতা। কবি মীরা মুখোপাধ্যায়
বর্তমানে শিমুরালী - নদীয়া নিবাসী। চরম দারিদ্রের জন্য
প্রথানুগ লেখাপড়া বেশিদূর হয়নি। ডাকবিভাগে চাকরি
করেছেন। নির্ধারিত সময়ের দুবছর আগে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে
নেন। কারণ শরীর। লিখতেন অনেক আগে থেকেই, মাঝে
জীবনের কিছু অসহ ওঠাপড়ার জন্য বছর দশ-পনেরো
লেখালিখি বন্ধ ছিল, খানিকটা অভিমানেই।
কবির নিজের ভাষায় - "কিন্তু স্বেচ্ছাবসর নেবার পর একটা
স্মার্টফোন কিনলাম আর পিঁপড়ে মারার ঢংয়ে টিপে টিপে
টাইপ করে লেখা পাঠাতে শুরু করলাম। বা বলা যায় শিং
ভেঙে...। তোমাদের মতো ছেলে ছোকরারা নির্ঘাত হাসাহাসি
করো। এটুকুই, বলার বিশেষ কিছু নেই রে ভাই।"
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ছন্ন সেরেনাদ কিংবা... এবং অরোরা বোরিয়ালিস।
কবি বিপ্রতীপ দে 'র কবিতাগুচ্ছ
কবি বিপ্রতীপ দে 'র কবিতাগুচ্ছ
আবহাওয়া ।।
তুমি আর ডাকো না আমায়
জানি কী যেন সংকোচে
ভুলে মন দিয়েছ বলেই
প্রেমের বদনাম কি ঘোচে!
পথে দাঁড়াই ঝড়ে জলে
তুমি আসতে পারো পরি!
আমি একশো হাজার বার
যেন ভালোবেসেই মরি!
তুমি ফিনফিনে এক মেয়ে
চোখ দিঘল টানা টানা,
খুব পেয়েও কাছাকাছি
হল অর্ধেকটাই জানা!
বলো তেমন করে ভাবো
ঝড় আমার সে পাগলামো!
ঠিক আবার দেখা হবে
যদি অশ্রু হয়ে নামো!
তোমায়।।
ফুল ভেবেছি তোমায়
ভুল ভাবিনি তা তো,
কান্না দেব তোমায়
সযত্নে হাত পাতো!
ভেবেছিলাম পাতা
বৃষ্টিজলের ফোঁটা,
তুমি অনেক অনেক কিছু
প্রথম সূর্য ওঠা!
গান ভেবেছি তোমায়
চেনা মেঘলা দিনে,
নীল সাদা মেঘ তুমি
দেখেছি আশ্বিনে!
ভেবেছিলাম পাখি
অথবা তার নীড়ও,
আমার দিকে ওই জন্মে
আরেকটি বার ফিরো!
ভেবেছিলাম তুমি
আলো অন্ধকারও,
আজকে তুমি দিগন্ত
কাল আকাশ হতে পারো!
বিস্মরণের গান ||
আমাকে ভুলে গেছ?
দুচোখে কাঁপে জল!
ভেতরে ঝুঁকে দেখি
বিরহ সম্বল !
কিরণ ঝিকিমিকি
কুয়োর অতলে!
কোথাও পৌঁছব
অশ্রু পথ হলে!
সে-পথে যেতে চাই
জেনেছে পাখিও,
বলেছে গোধূলির
দিকেই তাকিয়ো!
ভুলেও ভুলে গিয়ে
রেখেছ স্মরণে,
এখনও ব্যথা চাই
নতুন ধরনের!
শিউলি লেখায় ||
এই নীলাকাশ ভীষণ চেনা
যেমন আমি তোমায় চিনি
ভিজে পাতায় তোমারই নাম
অন্য কারো নাম লিখিনি?
এই নীলাকাশ মন কেমনের
মেঘলা এখন আংশিকই তো,
দূর দিগন্ত সাজিয়ে দিলে
কখন কবে আমার ভিতর!
এই নীলাকাশ সাদামেঘের
দল বেঁধেছে পেঁজাতুলো,
খুব পুরোনো চিঠির জানি
আত্মীয় হয় মলিন ধুলো!
এই নীলাকাশ কাশফুলেরা
তোমার মতোই চেনে আমায়!
বুঝতে পারো কান্না কেন
তোমার দিকে গড়িয়ে যায়!
এই নীলাকাশ দেখছ তুমি
একলা একা জানলা খুলে,
পথের ক্ষতও শুশ্রূষা চায়
আজও ঝরা শিউলি ফুলের!
ওষ্ঠবর্ণ ||
ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রাখাটা শেখায় বিহঙ্গেরা,
বললে প্রথম চুমুর থেকেও শেষ চুমুটি সেরা!
বিসর্জনের পরে ||
কোথাও কিছু পড়ে থাকল নদী,
বুকের পাড়ে ঢেউচিহ্ন লেগে!
বোধন থেকে আজকে বিসর্জনে
অনুরাগের সিঁদুর ওঠে জেগে!
চেনা বাতাস হেমন্ত নিঃশ্বাসে,
আকাশ নীল,তাকায় ঝরা কাশও;
বিসর্জনের ব্যথার মতো তুমি
এখনও কি আমায় ভালোবাসো?
জীর্ণ ভাঙা ঘাট ছুঁয়েছে জল,
সেই প্রথমের স্পর্শটুকু রেখে!
কেউ জানে না এই নবমী নিশি
চোখের জলে তোমার কথা লেখে!
কোথাও কিছু পড়ে থাকল নদী,
বেলপাতা ফুল চাঁদমালা ও খড়!
তোমার মুখ মনে পড়ছে কেন
শেষ প্রতিমা বিসর্জনের পর?
দিগন্তরেখা তোমাকেই ||
আমাকে এখন মনে রাখবে না জানি,
বাগানে ছিলাম বৃষ্টির পাখি দুজনে!
ঠান্ডা লাগবে,সাবধানে ফিরো,চোখে জল;
মেঘের মতন এমন অতীত আমাদের।
শিশুরও তুচ্ছ ঘুমের ভেতর কান্নায়,
ভালোবাসা মানে নিভু নিভু আলো,লন্ঠন!
ঝোপঝাড় দিয়ে ঢেকে রাখা ওগো কাহিনি,
তোমার স্টেশনে রেখে আসা এক সন্ধে!
আলোগুলি ভিজে চুইয়ে নেমেছে বিদায়ে,
বলেছিলে,আর করবে না দেখা কথা দাও।
কত কতদিন নিজের কষ্টে মনোরম,
দলবেঁধে এসে পাখিরা আমাকে বোঝালো!
কিছুই করার ছিল না কেমন অসহায়,
ভাবতে পেরেছি দিগন্তরেখা তোমাকেই!
এখনও কেমন অপরিসীমায় ছড়ানো
চেনা কষ্টের হেমন্ত এত কুয়াশা!
রক্তরেখায় ।।
তুই মানে পাখি
তুই মানে ভিজে ফুল,
রোগা নদী যেন
গালের দুপাশে চুল!
তুই মানে মেঘ
মেঘেদের জলকণা,
ভালোবাসলেও
কাছাকাছি থাকবো না,
কেন বলেছিলি,
আমাকে বুঝিয়ে বল?
তুই মানে চোখে
আবার কাঁপছে জল!
তুই মানে কোনো
রক্তপাতের ফোঁটা,
মনের ক্ষতয়
চেনা ভিজে গল্পটা!
তুই মানে কোনো
সুগন্ধ অনুভূতি,
দুঠোঁটে চোখের পাতা ও
কপাল ছুঁতি!
তুই মানে কী কী
বোঝাতে পারি না তোকে,
গোধূলির আলো ছোঁয়
ভাঙা নৌকোকে!
পদাবলী ।।
আমি আর তুই
এ ওকে ছুঁই
শরীর এবং মন,
ভিজে সৈকতে
নখ দিয়ে ক্ষতে
এ কথা লিখেছি
কখন?
দশমী ||
এসেও ফিরে গেলে,
কান্না থেকে আবার তুমি নতুন কিছু পেলে ।
কবি পরিচিতি ~
কবি বিপ্রতীপ দে। জন্ম ১৫ আগস্ট, ১৯৬২। হাওড়া জেলায়।
বেড়ে ওঠা সোদপুর-নাটাগড়ের কলোনি জীবনে। প্রথাগত
শিক্ষা এড়িয়ে স্ব-শিক্ষিত হওয়াতেই সচেষ্ট থেকেছেন। কবিতায়
আত্মপ্রকাশ আশির দশকের শেষপ্রান্তে। নাট্যকার হিসেবেও
পরিচিতি পেয়েছেন।
পিতৃভূমি বাংলাদেশের প্রতি আজীবনের টান। বিচিত্র পেশায়
দিনগুজরানোর পরে বর্তমানে সাংবাদিকতা ও সম্পাদনায়
স্থিতধী। দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ করে চলেছেন একটি পাক্ষিক
সংবাদপত্র। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ভিজে স্টেশন, ইচ্ছে করছে বলে,
রেডবুক দারুণ পশ্চিম, পিপীলিকাদের ব্যথা,
লাইমীর উপকথাগুলি এবং শ্রেষ্ঠ কবিতা।
সজ্জ্বল দত্ত'এর কবিতাগুচ্ছ
সজ্জ্বল দত্ত'এর কবিতাগুচ্ছ
( আমার বাড়ির সামনে ছোট্ট একফালি মাঠ ,
তারপর আর একটা বাড়ি । সাজানো গোছানো বন্ধ ,
কেউ থাকে না সেখানে । কেউ থাকে ? )
★ তালা - ১
... তারপর লাগাতার লোহাঝালাই ফুলকি
কখনো হালকা কখনো জোরালো রঙ
আগুনে ফুটছে ছবি
যতটা সময় শুধু লাগিয়ে ঘোরাতে চাবি
অন্য ত্রিসীমানা --
খাবার
বাসস্থান
নড়াচড়া হাবভাব
সবটা কেমন যেন
ফাঁকা বাড়ি ঘুরিফিরি ...
পাঠক বন্ধু হে মেলাও আপন খাতা
খবর পেয়েছিলাম গোটা বারো বছরে
ফট্ করে একদিন কালীপুজো সাপবাজি
গোড়ায় আগুন দিলে কেউটে লম্বা কালো
সামনে গ্রীলের গেট ফাঁক গলে তলা দিয়ে ...
পেণ্ডুলামের মতো দুলছে বন্ধ তালা
নির্বিকার হেঁটে গেছি
সোজাসুজি এগিয়েছি
হাতে মোটা রিঙ-এ বাঁধা চাবি
★ বেডরুম - ১
সাপ বেরিয়েছি ফের অ্যাসিড তুচ্ছ করে
পারি না গো বন্ধুরা
এমন কি জন্য দেখি কেন হয়
কিলবিল করি গোটা ধবধবে বিছানা জুড়ে
ওপরে উঠতে থাকি
সত্যি পারিনা ... জ্বালা ...
পাকিয়ে দড়ির মতো
দোমড়াই মোচড়াই
জিভটা ঠেকিয়ে সোজা উঠতেই থাকি ... ঘুরি
নদী সাঁকো সমুদ্র সূর্যোদয় পাহাড় পর্বত টিলা
নীল বিষ ঢেলে যাই
জঙ্গলে ফণা তুলি
আছড়াই ছোবলাই
গোটা দাঁতে ভাঙা দাঁতে
এদিক ওদিক দেখে তৈরি গর্তে জলদি
শান্তি কিছুক্ষণ
শীতঘুম
★ বেডরুম - ৩
সদ্য গোঁফের রেখা হালকা দাড়ি গালে
লম্বামুখ তেজী টাট্টুঘোড়া আরামে উপুড় হয়ে
আমি তার পিঠে বসেছি এলিয়ে শুয়ে পড়েছি
উনুন জ্বলছে ... লাগাম ধরেছি শক্ত হাতে
খুরের ঠকঠক শব্দ ছোটার তালে তালে কোমর
রাস্তা ছুটছে আগুনের দিকে ...
দৃশ্য পাল্টালো ...
সামান্য কাঁপছে ছবি
একটু আগে খাওয়া মুঠোয় মাটনরোল
কাগজ খুলে যাচ্ছে
চারপাশে চিলিসস কাঁচালঙ্কা পেঁয়াজ নুন
চিলিসস দখল নিচ্ছে বোতল বোতল নামছে
ঘিরে ধরছে চতুর্দিক
আর কিছু মনে নেই
★ স্নানঘর
সাবান ভাসছে ভুতুড়ে সাবান
হাওয়া থেকে ম্যাজিকের মতো নাচছে শূন্যে
এপাশে ওপাশে গোল হয়ে
ঘুরেফিরে বাঁয়ে ডানে
আরো নীচে আড়াআড়ি সরছে নামছে
ঢেউ খেলতে খেলতে লম্বা মেঝের দিকে
আবার ওপরে উঠে
সাবান ভাসছে ফাঁকা ঝিরিঝিরি ফেনাজলে
কেউ কোথথাও নেই
একা হাতে বিছানায় লম্বা ধারালো ফলা
সামনে পিছনে সামনে পিছনে
ছুরিতে মাংস কাটছি
রক্তে ফিনকি
আগুন উড়ছে চোখ জ্বলছে ভেতর পুড়ছে
আ : কী আরাম দেখি ঝাঁকি মেরে আলো আয়
সাবান ভাসছিল ঝর্ণা টানছিল
অন্ধকার ফালাফালা
স্নানঘর ধোঁয়ায় ধোঁয়া
★ কিচেন
আবছা ওভেনের নীল শিখা
ভীষণ আবছা ...
তার সামনে শাড়িতে প্যাঁচানো
গোটা চকচকে কাগজ শরীর
ঘাড় ... গলা ... কাগজের হাত নড়ছে
নিঃশব্দে দ্বিতীয় মূর্তি
একটু লম্বা
দুটো ছায়া নড়াচড়া
কিছুটা স্পষ্ট এখন
এক বার্ণারে ডিম ফুটছে দুটো
আর একটায় কেটলি তাতছে
ডান হাত বুলোতে থাকি আমি
বাঁ হাতের কাঁধ অবধি নিজের
সমস্ত আঙুল তালুর চামড়ারস
সামনের রাইটিং প্যাডের কাগজে
ওপর নীচ মাঝখান
সাদা ফর্সা তেলতেলে
নীচ থেকে ওপরে ফের ওপর থেকে নীচ
পেনসিল ছুলে দিচ্ছে অদৃশ্য কেউ একটা
তীক্ষ্ম ছাল ছাড়ানো শিস
তেল মশলা লঙ্কাবাটায় ঝালঝাল
কবিতা লেখার শুরু
আবছা কিচেনে শুরু আমিষরান্না
★ স্যামসঙ গ্যালাক্সি
... সঙ্গে সঙ্গে সামনের গ্লাসভরা পেট্রলে
বারুদ গুলতে থাকি
মাঝরাতে আশ্চর্য রিংটোন
ও বাড়ি কলিং
নিমেষে চাঙ্গা জেগে স্বপ্নে আমি
চোঁ চোঁ করে মেরে দিই গ্লাসের তরলটুকু
কথায় শব্দে এ'বাড়ি ও'বাড়ি ছায়া
ছায়াপথে ভাসতে থাকি
বাপ মা বইপত্র বুলির তোতাপাখি
বগলে জাপটে ধরে
কালোগর্তে ফুটন্ত গ্যাসে
উন্মাদ পুড়তে থাকি
হাত পা ছুঁড়ে নাচতে থাকি জ্বলন্ত নাচ
মুখ খুলছে ভিসুভিয়াস
আধপোড়া বেজন্মা শালা
লাভা ... লাভা ... লাভা ...
★ আলমারি
শাড়িভর্তি আলমারি
রঙিন রাক্ষুসী
ও বাড়ি আপনমনে
ওরে বাবা ভয়ে কাঁটা
সারাঘরে আলো নেই ওই কোণ গাঢ় নীল
দেখছে হাঁটছে এগিয়ে আসছে
খড়ের পুতুল আমি নিজস্ব বিছানা জুড়ে
আলমারি দিয়ে চাপা
পিষে যাচ্ছি মরে যাচ্ছি
শাড়ি সালোয়ার টপ ওপর নীচ ওপর নীচ
কোন্ সমুদ্রে কোথায় রক্তে নুনবৃষ্টি
পাল্লা হাট গোদরেজ
যত গর্ত সুড়ঙ্গপথ উল্টো দুলে দুলে
বিচুলি উপড়ে ছিঁড়ে নুনের রক্তঢেউ
ঢেউয়ের ওপরে ঢেউ
দগদগে লাল দাগ
জ্বলছি জ্বলবো
কোন্ জন্ম কোন্ কালে
গ্যাসভর্তি লাইটার হাতে
ভেতরে কেউ একটা
স্বর্গআরাম সিঁড়ি
চুপচাপ শুয়ে একা হাত পা শরীর
ভয়ফয় পালিয়েছে
আলমারি উল্লাস প্রচণ্ড নিঃশ্বাস
শাড়ি দলবলে টানা খড়ের পুতুল দাহ
★ ড্রেসিং টেবিল
মদনং স্তবস্তুতি
বারোটায় প্রস্তুতি
চিরুণি কোমর চুল
লাল নাইটি সাদা ফুল
ম্যাগিহাতা উঁচু হাত
বগলে বাঘের পাত
হাতে ঘাত প্রতিঘাত
হায় রে জগন্নাথ
ঘড়িতে বারোটা দশ
গ্লেসিয়ার ফেটে ধ্বস
ক্ষিতি অপ তেজ বায়ু
ও বাড়িতে ডোবে স্নায়ু
কবি শিল্পী দাঁড়কাক
বগলে বিদগ্ধ বাঘ
জানলা-জানলা পথ
' ভালো ' ভাসছে ভাসে ' সৎ '
যেভাবে জোটাতে রুটি
খিদেপেটে ছুটোছুটি
তেমন এ' বাঘের ছোটা
মহাশূন্যে হাতে ওটা
দু'পাশে ড্রেসিং কাঁচ
ভাজা মাছটি ... মুখে লাজ
বিদগ্ধে ব্রহ্ম বশ
অনন্ত বারোটা দশ
উলুধ্বনি বাজে শাঁখ
জানলা সামান্য ফাঁক
★ ছাদ
ধাপে ধাপে মোটামুটি চল্লিশখানা সিঁড়ি
শুকনো জামাকাপড় কার্ণিশ থেকে তুলে
একটা একটা হাতে
হাওয়ায় দাঁড়াই একটু
ঘাম শুকোচ্ছি
আগুন বিদ্যুৎ নুন কালকেউটের বিষ
যতটা গভীরে গ্যাছে
চরাচর শুষে নিলে শরীর শোলার বল
আরো হালকা ধুলোকণা হাওয়ায় উড়ব যদি
আকাশে বাউলমেলা মিহিশব্দে একতারা
শিব-শিবাণী সুর কতটুকু দিতে পারি
বিকেল ফুরোনো রঙে বেশ্যায় ব্রাহ্মণে
সটান তুলে নে দেখি
পাগলা চরণদাস
টুকরো জড়িয়ে দে উত্তরীয় গেরুয়ায়
নাইটি জামা জাঙিয়া প্যান্টি ব্রেসিয়ার
ঢালুপথে ওপারে সূর্য
শেষ দু'একটা চিল
জানলা বন্ধ করে কালোপর্দা আধা টেনে
উঠে এসেছি
নামার সময় হল
এখনও মে'ন গেট খোলা পড়ে আছে
★ তালা - ২
যতটা সহজ খোলা বেরিয়ে আসতে কালঘাম
কোথা থেকে টেনে ধরে গরম জ্বলুনি
ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ সমানে ও'বাড়ির
ঘরবারান্দা রহস্যরোমাঞ্চ
তুমুল স্বপ্নঘোর
ছোট্ট ব্যাসের বৃত্তে পরিযায়ী পাখি আমি
ক্রমশঃ তলানি আলো
অবশ শব্দতাপ
পেছনে ছায়াভেতর ঝলসে পুড়িয়ে ফাঁকা
রক্ত বলছে স্থিরবার্তা এবার
ষাট... সত্তর...আশি
তালাচাবি ঠোঁটে নিয়ে একদিন সোজা
পাশে বটগাছ মগডালে
আশ্চর্য সবুজ বৃত্ত বায়ুভর্তি ছবিদেশ
চারপাশে নীচে কত ফাঁকা বাড়ি খোলা হাট
সাদা ডানা ঝাপটাই
এবার বিদায় চাবি
উজ্জ্বল নতুন তালায় হাল্কা মরচে তালায়
অনন্ত সরলরেখা
টানা ইতিহাস লেখা
চাবি ছুঁড়ে ফেলি সেই মহাপথ গতিস্রোতে
অপার অন্তরিক্ষ ... সাতঋষি সংসার
আগামীর ধ্রুবতারা আলোয়
কবি পরিচিতি ~
কবি সজ্জ্বল দত্তের বেড়ে ওঠা নদীয়া জেলার রানাঘাট শহরে।
পেশায় জীবনবীমা নিগমের কর্মী বর্তমানে বারাকপুর শহরের
বাসিন্দা। একসময় 'মধুবন' পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এখন
'বারাকপুর স্টেশন পত্রিকা'র সম্পাদক মন্ডলীর অন্যতম
গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : 'স্বাগত শ্রাবণ-জোনাকি', 'পোস্টমর্টেম' এবং 'দাগ'।
নিলয় নন্দী'র কবিতাগুচ্ছ
নিলয় নন্দী'র কবিতাগুচ্ছ
★ পিয়ানো
সেই যে শেষবার গীর্জায় পিয়ানো শুনেছিলাম, আর কাঁটার মুকুট থেকে ঝরে পড়েছিল পাখির পালক, সেই থেকে আমি পাখিদের ভাষা শিখে নিচ্ছি প্রাণপণ। হে পিতা, পালকেই লিখে রেখেছিলে উড়ানমন্ত্র। যে কুড়িয়ে নিয়েছিল পালক, তার ডানা গজিয়েছিল নাকি সে ঢুকে পড়েছিল সুদৃশ্য খাঁচায়, তার হিসেব রাখিনি। আমার দৃষ্টি ছিল পিয়ানোর দিকে। রিলেশন কর্ড, মাদার নোট আর লক্ষণরেখা। যে মেয়েটি ছবি আঁকে পায়রা বা পালক, আমি তার পাশে গিয়ে বসি। পাখিটিও ডানা মুড়ে বসে। পিয়ানো আবেশ। কুসুম, তোমার চোখের নীচে ধারালো চঞ্চু। ঠোঁট রাখি। অকারণ রক্তপাত। পিয়ানো না বিউগল ঠাহর পাইনা।
এখনো শিক্ষানবিশ। এখনো অসমাপ্ত পাখির বর্ণমালা।
★ মনে রেখো
এই আলস্য দিনলিপি মনে রেখো। এই জানালা, লেবুগাছ, ছাতারের দলবল, ভেজা পাজামা, আর লেলিহান অ্যাশট্রে পেরিয়ে লালমাটি, মনবাউলের আখড়া আর সহজিয়া শ্রীখোল, ভোলবদলের প্রস্তাব।এই ছেড়ে যাওয়া আমাকে মানায় না, তবু যাই। বাজারের ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে মাধুকরীতে বেরোই। আহা রাধে অঙ্গ, মোমের শরীর, কলঙ্কে ডুবে মরি। চাঁদ পিছলে যায়। ধরি চাঁদ, না ছুঁই চন্দ্রিমা। কানের কাছে তীব্র স্বরে কেউ নামগান গায়। "অকলঙ্ক নামে কলঙ্ক রটিবে, দয়াময় বলে কেউ ডাকিবে না"...তোমার ওই লালপাড়, এত দহন! জ্বলেপুড়ে খাক। বৈরাগ্য অঙ্গার। ও রাধে, ও বোষ্টমী, সংসারে ফিরে গেলে তুমি বুঝি পুড়ে খাবে ঘনচোখ! চলো, ফের নামগান হোক।
যারা মনে রাখে তারা পোশাকের রং ফিরেও দেখে না
★ দংশন
ডার্ক চকোলেট ছুঁড়ে দিয়ে সে চলে গেছে মনাস্ট্রির দিকে। বুকের ভিতর ঘন্টা পড়ে তথাগত স্তব। আমি চকোলেটে কামড় বসাই। দংশনে মিশে থাকে পাপ। এত সহজে পাপ বলে ফেলার মত তাড়াহুড়ো না থাকলেই ভাল হতো। টেস্টবাডে বাদামী ধারাপাত। বিষদাঁতে কোকো। শান্তির খোঁজ পেতে তখনো পাহাড়ি বাঁক, অপেক্ষার চূড়া। বেসামাল হাওয়ায় পতাকার দিকভুল। শরীরের সাথে লেপটে আছে সাদাকালো খুঁত। সে আমাকে ডুবিয়ে রেখে গেছে লোভে, পার্থিব পতনের ঘোলাজলে। আমি চেয়ে আছি অপসৃয়মান, ঘন্টা বাজছে, ধ্বনি প্রতিধ্বনি। পাঁক মুছে নিচ্ছেন তিনি। বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি...
মেঘের গায়ে চকোলেট মুছে ফেলার আগে
একবার পিছন ফিরে তাকিও
★ চিলেকোঠা
আমি তাকে চিলেকোঠায় খুঁজে বেড়াই।
বাক্সপ্যাঁটরায়, তাকে, খাটের নীচে, কার্ণিশে সর্বত্র
মনে হয়, যেন ভূতে পেয়েছে আমায়
লাফ দিয়ে জড়িয়ে ধরি, সোহাগ করি, আঁচড়াই কামড়াই
তারপর আনখশির চুম্বনপ্রস্তাব...
খবরের কাগজ গড়িয়ে পড়ছে
ভেঙে যাচ্ছে নৌকা, দাঁড়, অস্থির প্রতিবিম্ব
শিউরে উঠছে শরীর...
এ যাবৎ যা যা অতীব শারীরিক ঠিকানা চিলেকোঠা
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে, রান্নাঘরে ঢোকে
হলুদ লংকা মাখে আঁচলে মোছে
আমিও মুখ মুছি যেখানে সেখানে
তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই...
তুমিই তো মদিরা প্রণয়, খেলাচ্ছলে শেখাও বজ্রপাত।
★ প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক
প্রসঙ্গ বদলে যায়
টগবগে প্রেমপত্রে বিপ্লবের ঝান্ডা ওড়ে
অপাংক্তেয় কোনো রক্তিম বুলেট মুখ থুবড়ে পড়লে
নন্দর মা ঝাঁপ খোলে দোকানের, রুটি বানায়
চোলাই ঠেকে বেজে যায় তালপাতার ভেঁপু
বাড়ির কাছেই কোথাও ব্রক্ষ্মকমল ফোটে
বাতাস বয়ে যায় নির্ভার...
যে মুহূর্তে প্রেমকে মনে হয় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম
আর বিপ্লবকে গোলাপের ইনকিলাব
তখনই খিচুড়ির গন্ধ বেরোয়
অভিমানের বুকে ঝাঁট পড়ে
রোদের গায়ে উড়ে বেড়ায় কিচিরমিচির
মগজাস্ত্রে উৎসব বিনয়ী আলিঙ্গন
আলিঙ্গনের প্রসঙ্গ এলেই শ্লোগানের প্রসঙ্গ আসে
শহরের প্রসঙ্গ ও। ডাকপিয়ন আসে।
ফের বিলি করে প্রেমপত্র...
★ যতিচিহ্ন
থেমে যাওয়া অনিবার্য ছিল।
তোলপাড় হয়ে যাচ্ছি ঝড়ে
হাত বাড়িয়ে বুঝে নিচ্ছি বৃষ্টির সম্ভাবনা
শিকড়ের মায়া এড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছে পাখি
ভিটেমাটি ছেড়ে পথে বেড়িয়ে পড়েছে মানুষ
বুকে ভর দিয়ে হেঁটে আসছি।
থামতে চাইছি, পারছি না
কমা, সেমিকোলন, ড্যাশ কেউ থামাতে পারছে না
আমাদের কঙ্কাল দুলছে, দুলছে শূন্য ভাতের থালা
অদূরে স্থবির সমুদ্র ব-দ্বীপের জটলা
বৃষ্টি এসে গেলে বলয়গ্রাস ভেঙে যাচ্ছে পানপাত্র
ভয় হয়। থেমে যাওয়ার ভয়। অ্যানিমিক ভয় যেন।
ভোকাট্টা ডেকে ওঠে কেউ। বাতিল লাটাই হয়ে
ঝুলে থাকি ল্যাম্পপোস্টে। চরৈবেতি আমার জন্য নয় শুধু একান্তে ছাদ আর দেয়াল মেরামতির কথা ভাবি।
★ দুপুর ভিয়েন
এখন হেমন্ত। দুপুর ঝিমিয়ে এলে কমলা রঙের রোদ গুড়ের জিলিপি দাঁত দিয়ে ছিঁড়ি। আলজিভে টসটস রসের ভিয়েন। ছাদ মাদুরে রেললাইন সমান্তরাল। কোথাও পাহাড় জেগে আছে। কোথাও বা জাহাজ মাস্তুল। তবু পাহাড়ের সাথে সমুদ্রের দেখা হয় না আর। অনৈতিক দাঁড়িপাল্লায় উঠে বসি, নামি। নীরা উড়ে যায়। পৈতৃক বাগানে ফল খসে পড়ে টুপটাপ। আমি আমশাখে নীরার পাশে গিয়ে বসি। চুমু খাই। দুপুর ভিজে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে ছোটখাটো ভুলচুক। মুদ্রাদোষ ঠোঁট ফুলে ফুলে ওঠে। চিহ্নিত অঙ্কের সমাধান চেয়ে বসে প্রতিবিম্ব। পেট্রোলের দাম বাড়লে আবার ভাবতে বসি কতদূর গুরুদোংমা! পথ ছোট হয়ে আসে। দুপুর দীর্ঘ হয়। আমিও ছাদজুড়ে সাজিয়ে রাখি অক্সিমিটার, অক্ষয় মালবেরি...
★ প্রেয়ার সং
প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে গেয়ে উঠি, "এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার"। ছাত্ররা চমকে উঠে জনগণমন থামিয়ে দেয়। ছাত্রীরা গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে। বিভূতিবাবু ফিসফিসিয়ে বলেন, "কী হচ্ছে এসব?" " আপনার আমলেরই গান তো। আপনি কখনো সুচিত্রার প্রেমে পড়েননি? " সোমা দিদিমণি ত্যারছা তাকান। ইহাকে কি কটাক্ষ বলে? আমিও কিছু কিছু বুঝি, ও দখিন হাওয়া, প্রার্থনা সংগীতের মানে! জেগে ওঠে জলপ্রপাত। জেগে ওঠে টিফিনবক্স, রং পেনসিল, ক্যারাম করিডোর। বাহার গেয়ে উঠলে রেডিও গেয়ে ওঠে কাছে কোথাও। রেডিও গাইলে ফার্স্ট বয়। গেয়ে ওঠে আচারওয়ালা, আইসক্রিমওলা। পরিচালন সমিতির সভাপতি ভারী মুখে বলে ওঠেন, "এই সক্কালে সন্ধ্যাসঙ্গীত! বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না! " কার্ণিশে দুটি পাখি মুখোমুখি এসে বসে। এখন পড়ার বইয়ে বিকেল রঙের নদী, গৌরী মাঝির দাঁড়। তরণী তোলপাড়।
প্রতিদিন জনগণ গাইবো না আর
বসন্তের প্রথম দিনে "প্রথমত আমি তোমাকে চাই"...
★ কৃষিকাজ
শরীর
নীলরং কলহের পর বিলিয়ে দিয়েছি তোমাকে
মেয়েটি বেহালা বাজাচ্ছিল
চাঁদের আলোয় সেঁকে নিচ্ছিল তার হাত
কার্পেটে পড়েছিল নিতান্ত অগোছালো শয্যাদৃশ্য
প্রতিটি স্বপ্নদোষ প্রিজমের মত বর্ণালী শীৎকার
প্রতিটি বিবাহ যেন মনোজাগতিক বায়োস্কোপ
পুরুষ রং অশ্বারোহী ধেয়ে আসে দ্রুত
টগবগ টগবগ...
কৃষিকাজ শিখে নিলে
আমিও মেয়েটির কানে কানে ধানের শিষের গান গাই
তোমার ভিতরে তুমি একা
আমার ভিতরে আমি একা
তবু কোনো পুরনো গীটার আর অষ্টাদশী লেডিস সাইকেল
জেনে গিয়েছিল বিরহের অন্য নাম শরীর কামনাতাড়িত...
★ শূন্য এবং শৃঙ্গ
একটি শূন্য চেয়ার এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা
চেয়ার শূন্য কেন সে তর্কের মীমাংসা হয়নি এখনো
যে পাহাড়ের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ায়
তার সাথে সম্পর্ক রাখি না...
তবু মোমোশপ থেকে ঘুরেফিরে তাকেই দেখতে থাকি
কাঞ্চনজঙ্ঘা ফিকে হয়ে আসে স্তনশৃঙ্গের পাশে
উপত্যকা বেয়ে নামে দর্শকাম পিঁপড়ের সারি
আমি তো বরফদানা গলনাঙ্ক খুঁজি
গড়িয়ে নামছে দেখো আমাদের প্রাচীন প্রণয়
গড়িয়ে নামছে আচম্বিত অভিঘাত
জলপ্রপাত...
যে পাহাড়ের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়
আমি তাকে দেখেও দেখি না
শূন্য চেয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকি
চেয়ার কেন শূন্য সে কথা ভেবেও ভাবি না
আর্যভট্ট নই, তাই শূন্য আমার বিষয় নয়
কেবল আঙুরফলের কথা ভাবি,
বৃত্ত বা টক যাই হোক...
মেঘে ঢেকে যাওয়ার আগে ব্যালেরিনা পাহাড়ের গান
কবি পরিচিতি ~
কবি ও সম্পাদক নিলয় নন্দী পেশায় শিক্ষক। রাণাঘাট শহরে
বেড়ে ওঠা। তবে বর্তমান নিবাস কল্যাণী, নদীয়া। কবিতা
উচ্চারণ এবং শব্দসন্ধানে ব্রতী। বাতিঘর অনলাইন ব্লগজিন
সম্পাদনা করেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'বাসন্তিকা বাসস্টপ'।
রঞ্জনা ভট্টাচার্য্য'এর কবিতাগুচ্ছ
রঞ্জনা ভট্টাচার্য্য'এর কবিতাগুচ্ছ
★ কোলাজ
১
রাজনৈতিক সিংহাসনে
লক্ষ্মী গণেশ বসে মাঝে মাঝে আল্লার
দিকে আড়চোখে তাকায়,
আল্লার একাকীত্বের স্বর যীশুর ক্রুশে
গিয়ে ফিসফিস করে বলে, হলুদ
ছোপ লাগা আঁচলে লেগে আছে বিপ্লব। ওর আলতায়
জেগে আছে দ্রোহকাল। এক চোখে রাধাভাব, আরেক
চোখ ছায়াপথ। গনগনে আঁচ ছাড়া তিনি রান্না করেন না।
২
প্রতিটি স্টেশনে ভাবি নেবে যাব,
একটু নেশাগ্রস্ত প্রেত পিছন
পিছন যাবে, সমস্ত স্টেশনের দেওয়ালে
শ্যাওলা লেখা দেখাবে। তারপর... আনাড়ি ঈশ্বর এসে
শ্যাওলা তুলতে তুলতে সময় ফেরত চাইবে সুদে ও আসলে।
সংলাপ ভুলে আমি ঈশ্বরের
নাড়ি ধরে দেখব , সময় চলছে টিকটিক টিকটিক...
দূর থেকে হুইসেল ,
ট্রেন আসছে ঝমঝম ঝমাঝম...
৩
আত্মজীবনীর ছাইগাদায় লুকিয়ে রাখবো তাকে।
উলোটঝুলোট গোবর-মাটি দিয়ে গড়া খড়ের পুতুল
কালকূটের সাথে দেখা করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি ।
তার সমস্ত শরীরে জীবনানন্দের ঘ্রাণ...
করতলে পাখির বাসার চিহ্ন এঁকে
দিতে গেলে অভিশাপ দেয়, জন্ম জন্ম
ঘর বেঁধে থাকার,
তার ফেরা হবে না জেনে জেগে থাকে
অন্ধ আয়না, পূর্ব জন্মের পথ বেয়ে নেমে আসে শ্রমণা,
যাত্রা করে ছাইগাদার দিকে।
কালকূটের চোখে জল, জীবনানন্দ ট্রাম দেখে
ফেরত আসেন হিজল গাছের নিচে।
৪
গোধূলি রঙের চোখ দিয়ে ডাকলে
আমি ঝরা পাতা উড়ে যাই।
হৈমন্তী কুয়াশার পিছল আলোয়
দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যায় প্রেম,
উপত্যকা জুড়ে থাকে মৃত্যুর পূর্বাভাস,
জ্যোৎস্নার জঙ্গল জড়িয়ে
পাতাখসা শরীর কোল
খোঁজে মাথা রাখবে বলে।
চুম্বনে কেঁপে ওঠে নীহারিকা...
৫
মা ঠিক আমার সামনে দৌড়োচ্ছে,
কিছুতেই ধরতে পারছি না,
সামনের গর্তটাকে লাফ দিয়ে পেরিয়ে
যাব ভেবেছি, তার আগেই পাশ না কাটিয়ে গর্তে পড়ে গেল মা,
ইচ্ছে করেই,
কেন মা?
সব গর্ত লাফিয়ে পেরোনো যায় না,
সব গর্ত পাশ কাটাতে নেই,
কোনো কোনো গর্তে পড়ে গিয়ে উঠতে
শিখতে হয়...
৬
কলসি দড়ির দিকে প্রেম চোখে তাকালো যেই,
ভাঙ্গা ঘরের কোণ থেকে প্রতিক্রিয়াশীল আলো দড়ির খরখরে
নির্লিপ্ততা দেখালো।
দড়িকে সাপ হয়ে যেতে দেখে কলসি বোঝে হামলাবে না কিছুতেই ...
ছলাৎ ঈর্ষা, আর ভেজা শপথ নিয়ে অপেক্ষা করছে কলসি একটা গলার।
যাকে দেখলে দড়ির আচমকা জল তেষ্টা পাবে...
কলসির দিকে হাত বাড়াবে।
৭
যার নামে কোনো মামলা নেই সেই
ছা-পোষার বড় লজ্জা!
ভাত ফুটিয়ে খায়, গাঢ় তেতো চায়ের লিকারে গলা ভিজিয়ে
আকাশের মেঘটাকে দেখে, মনে হয় সুপ্রিম কোর্ট...
ওখানে গিয়ে মামলা ঠুকে দিলে হয়... ভাবে... কার নামে...
সেটা মনে পড়ে না,
নোটবুক খুলে এক এক করে শত্রুর নাম লেখে...
চাল, ডাল, তেল, আটা..
উঁহু...
সব কেটে কুটে লেখা হয়...
মাছ-মাংস...আমিষ... আমি ইস...
৮
লাইট হাউজের করুণ বুনোফুল দৃষ্টি,
অপারগ চোখে ঝড়ে উল্টানো জাহাজ দেখে,
আলো ফেলে স্তব্ধ হয়, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবে, নাবিকেরা
মাস্তুল ধরে ফিরে আসুক... যেমন...
হাসপাতালের করিডোরে মুমুর্ষু সন্তানকে রেখে পিতা
এক কোণে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
৯
কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আগে
স্বপ্ন পায়,
ঘুমের স্টেশনে নির্জীব কুয়াশায়
হাঁটতে থাকি নরম রেল লাইনের উপর শক্ত শক্ত পা ফেলে।
চারপাশে মোলায়েম আলোর মতো পাহাড়ের গা বেয়ে
নেমে আসে জীবনের ভুল চুক,
প্রবাহিত জলের স্থিতিস্থাপকতায়
লেখা হয় যাওয়া-আসা। আগুন আগুন
দুঃখ বেদনার কাদামাটি মেখে কান্নার গায়ে সব লেপেপুছে আসে।
স্বপ্নের সাদাকালো রঙ রুকস্যাকে লিখে রাখে... বর্ণান্ধতা অভিশাপ।
★ বিপ্লবী ঈশ্বর
ঈশ্বর লন্ঠন হাতে,
কালোর মধ্যে
নিহত
রঙকে প্রাণ দেবেন
বিপ্লবী ঈশ্বর,
একহাতে আলো আরেক হাতে
তুলি,
আঁধারের মৃত্যুর কথা দেয়ালে
লেখা আছে,
লেখা আছে রঙের জন্মের কথা
কালোর ভিতর,
শয়তানের ছায়া বিপরীতে অন্ধকার
ঘনক হাতে হেঁটে দাঁড়ায়,
ঈশ্বর ও শয়তান মুখোমুখি,
একজন আছে তাই আরেকজন
মুখ মোছে,
দুজনেই দুপথ দিয়ে হেঁটে মানুষের
শিয়রে এসে দাঁড়ায়।
সময় প্রসারিত হয়, সময় সঙ্কুচিত ...
কবি পরিচিতি ~
রঞ্জনা ভট্টাচার্য্য পেশায় শিক্ষিকা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ
'আঁধারের বাউলগান'। গান শোনা আর বই পড়া নেশা।
ঈশাণী রায়চৌধুরী'র কবিতাগুচ্ছ
ঈশাণী রায়চৌধুরী'র কবিতাগুচ্ছ
★ চন্দ্রাতপ
আলিঙ্গন- আড়াল দেব ভালবাসা হলে...
মন ভারি নরম লাজুক,
আলতো আদরে থাক
চাকভাঙা - সুখ।
নিষিদ্ধ তকমা দিলে? উঁহু,
চাঁদও তো ঢেকে রাখে মেঘ ,
চুমুর চকোর অভিলাষে।
পানপাতা পুড়ে যায় আগুন দহনে।
ছায়া থাক বোরজের নিরালা কোণায়...
চোখের আগুন বড় নির্মম
আগলাও বুকে করে...
ভালবাসা লেগে থাক ঠোঁটে
চোখে মুখে, আঠালো আশ্লেষ!
মাটিতে প্রসব নামে জলের নরমে।
ভ্রুণের মতন কাঁচা গন্ধ
পাখির পেটের ঘন গরমে
রোঁয়া তোলে নিপুণ বিশ্বাস ।
মা নিষাদ ত্বমগম ! প্রেম চায় পাতার আড়াল।
শ্রাবণ আড়াল করে রাই-সই, কৃষ্ণ-কিশোর কাছে এলে।
ঋতুমতী মাটির গভীরে শস্য নামে
বৃষ্টির বীর্যপাত হলে !
★ হয়তো
নিঃশব্দ অশ্রুপাত হলে -
সবাই শুনতে পায়না, ভাবে
শিশির হাঁটছে দূর্বাডালে।
পাতার আড়ালে কুঁড়ি ফোটার
তোড়জোড় করলে ভাবে
মনখারাপের সোঁদা সুগন্ধ!
বলতে পারো ভাবনা
কেন দৃষ্টিহীন!
রেখে চলে যায় জলের
ওপর আবছা ঋণ!
★ আরণ্যক
চল আজ তুমি-আমি অরণ্যে হারাই...
আঙ্গুলে আঙ্গুল জুড়ে, চোখে মেখে চোখ
ডালপালা ছেঁড়া রোদে ভিজি কিছুক্ষণ
ঘাই হরিণীর ডাকে মদালসা মন।
শুকনো পাতায় পায়ে এস্রাজ বাজে ...
কোথাও দূরের বনে মাদলের হাঁক
তোমার গভীর শ্বাস পাতার পিরিচে
মহুয়ার নেশা ঢালে আদিবাসী নাচে।
দেহাতি মেয়ের মত তাগড়াই লতা
বুকেপিঠে জড়িয়েছে
প্রেমপ্ৰিয় গাছ
এক গাছ বাঁধা হলে আরেক গাছের
হাতখানা ধরে থাকে বেণীর বাঁধনে
এখানে স্বাধীন প্রেম লোকলাজ নেই...
এখবর এ বনের পাতারাও জানে।
এরপরে ছায়া কিছু ঘন হয়ে এলে...
এই বন শিহরণ... এই রস মেখে
চুপিচুপি শুয়ে পড়ি পাতা পিঠে রেখে ।
এ আকাশ এই ঘাস এই ফিসফাস...
পাশাপাশি তুমি-আমি আর মহাকাল ।
কোন কথা বাকি নেই শুধু অনুভব...
আলো হাওয়া মেখে পাখি নৃত্যে মাতাল।
হঠাৎ চমকে বুঝি শিকড় গজালো
তোমার ও শরীর জুড়ে ডালপালা এল
আমি - তুমি-অরণ্যে নেই কোন ফাঁক
অস্তরবি বুনে দিল আলোর সোহাগ!
শঙ্খ লাগাই
আলতাপেড়ে মন এয়োতির মত লাজুক.....
কলমিলতার কচি শরীরে গা শিউরোনো নরম।
আমাকে ঐ জলজ যৌনতায় আশ্লেষে বাঁচতে দাও !
বারুদের বীভৎস নরক আসঙ্গ থেকে বাঁচাও।
ওগো আমি চোখ ধুয়েছি জোছনার তরলে...
গুঁড়ো গুঁড়ো ঠান্ডা সবুজে ভরপুর পাকস্থলি
কটা দিন জীবনকে বেঁধে রাখি মধুমঞ্জরী পাকে...
তারপর মেনে নেব নরকাগ্নি তুষ, যদি দাও!
আজ এসো সরীসৃপ প্রেমে শঙ্খ লাগাই !
দেখা হলে
চোখ খুলবো না!
এত স্মৃতির স্লাইড নামবে...
নানা চেহারার ছবি ফুটবে...
যা দেখতে চাই... চোখের ওপর আঁখিপল্লবে আটকে যাবে ।
সব ছাড়িয়ে... সব জড়িয়ে কিই বা তোমায় দেখতে পাবো!
তার চেয়ে থাক চোখের ভেতর আরেক চোখের লেন্সবন্দী...
তোমার ছায়া আমার মতো।
নতুন করে আজকে আবার তোমার কাছে হারবো না!
তুমি যা দেখ আমার মুখে সে সুখ যদি খুঁজে না পাই...
আমার চোখে আগের মত সেই রোমান্স আছে কি ছাই
তার চেয়ে বেশ তোমার সামনে অনুভবেই তোমায় ছোঁব -
চোখের ভেতর আরেকটা চোখ জেগে থাকুক তোমার মুখে
সে চোখ তোমায় রোজ এঁকে নেয় নিজের মনের উড়ান ভরে
মাটির চোখে দেখতে গিয়ে আলোর আদল যদি হারায়!
সেই ধাক্কা সইবে না গো যে চোখ আছে রক্ত ধারায়!
মন কেমন
একটা বয়স ছিল যখন মন কেমন করলে জল আসতো চোখে...
জীবনের তাতাপোড়া দিনগুলো সেই জলে ভিজে নরম কাদার মত আগলে রাখত!
ধীরে ফোঁটা ফোঁটা শক্তি জমলো জলে..
ছোট কাঁটা উপড়ে ফেলার সাহস জমলো বুকে,
সে এখন দেখতে পায়... ফুটপাতে জরাজীর্ণ মাকে আঁকড়ে শৈশব...
হুপিং কাশি নিয়ে ভারা বেয়ে উঠছে মজদুর...
নৃশংস অ্যাসিডে ক্ষতবিক্ষত মেয়ে !
বিশাল বস্তা নিয়ে আস্তাকুড় ঘাঁটছে অসহায় শিশু!
না আর চোখে জল আসেনা বরং আগুন ধরে যায়!
বুকে হাতুড়ির ঘা পড়লে আমি মন কেমনকে
মশালের মত লেলিহান তুলে ধরি!
একটা দুটো.. করতে করতে শেকল বানায় অনেক হাত ।
তাদের চোখে শপথ!
বন্ধু, মন কেমন যদি করতেই হয়... এদের মন দাও!
মন ভাল হওয়ার আশ্চর্য মলম আছে এদের কাছে!
ভোরের আলো
ঘাস উঠেছিল বুকের উঠোন জুড়ে -
তখন আমার বয়স ভোরের আলো ।
কচি কিশলয় নিজের গন্ধে চুর ,
মন জুড়ে তার বিদ্যুৎ চমকালো ।
তুমি ডেকেছিলে উড়িয়ে দীঘল ভুরু -
শক্ত মুঠিতে ধরেছিলে ফনা বেণী ,
কি জানি কি দেখে রহস্য মাখা চোখে -
এড়াতে পারিনি জীবনের হাতছানি ।
হঠাৎ সময় ঝাপট মারলো ঝিলে
শুঁষে তুলে নিলো সকালের মিঠে আলো ।
ক্ষীণ হতে হতে ভেসে গেল চেনামুখ
বেসামাল করে জীবনই তো ফিরে দিল !
এখন কঠিন সময়ের সাথে ঘর...
পলি জমে জমে ম'রে গেছে সেই নদী।
খুব মেপে বুঝে জীবনের পথে হাঁটি...
আজকে আমার হারাবার ভয় নেই...
শক্ত হয়েছে পায়ের তলার মাটি ।
জংধরা কিছু দরজা ভাঙছে রোজ
দখল নিচ্ছে রোদ - জল ভিজে মাটি !
বয়ে যাওয়া দিনে বিঁধে আছে কত ব্যাথা...
মনখারাপেরা হাপর চালায় বুকে।
তবু জানি ঠিক আসবেই ফিরে তুমি -
ছায়াপথ ধরে অভিসার সংগমে ।
আমি আজও আছি পুরোনো গন্ধ মেখে...
স্মৃতিপথ চেয়ে প্রতীক্ষা সংযমী।
রসাতল
যেতে যেতে খানিক রোদ রেখে যাচ্ছে শেষ বিকেল,
বিষণ্ণ তবু রক্তাভ ।
বকের সারির পিঠে তির্যক দিন।
এই তো সময়!
টেনে রাখা বোতামটা ছিঁড়ে গেল।
এখন সোডার বোতল হয়ে ভেঙে
যাক অন্ধকার।
আঃ কি আরাম !
জলের ভেতরে জল
লোনা স্বাদে হেঁটে যায় রাত।
ঘুমের থেকে বেছে বেছে সুখ
খুঁটে খায় দুঃস্বপ্ন !
কি নরম রোদের তোয়ালে!
ভোররাতে শুকতারা
নিভুনিভু হলে
অন্ধকার ঝাঁট দিয়ে
ডুব দেব
পরম রসাতলে ।।
রাত কোজাগরী
খেজুর রসের মত
হালকা সোনালি ফাঁদ পাতে
কোজাগরী চাঁদ!
মধুর তীক্ষ্ম গন্ধে অবশ স্মায়ু -
জোড়া মদালসা ঘোর ।
আকাশে কে হানা দেয় হিম অবসাদ মেখে ?
নিশিকুটুম্ব চোর?
অদেখা মাকড়সা এক নিশিঘোরে বুনে চলে জাল...
অশ্বিনী কৃত্তিকা রোহিণীরা ধরা পড়ে, জানে মহাকাল।
বাসার দেওয়াল ফুঁড়ে উঁকি দেয় বেহায়া নাগর
পাখি কাঁপে ডানাজুড়ে মন্ত্রমুগ্ধ
এ কোন প্রহর!
রসকলি আঁকে রূপো- জোছনায়
রাধিকা সজনী
কোথা গেলে কানু পাই কালো সখা
মরকত মণি !
নদীর নরমে মেখে জোছনারা পানসি ভাসায় ...
ভেসে চলে
নিরুদ্দেশে...
জলের গন্ধ জুড়ে ধোঁয়া ওঠে অগুরু আবীর...
চাঁদচরা গরম বাতাসে।
লক্ষ্মীপ্যাঁচার মত সাদা মেঘে স্বর্ণলক্ষী চাঁদ...
রহস্যবিলীন রসে মুগ্ধ করে
চরাচর...ভেঙে দেয় বাঁধ।
এসো আজ এ কুহকে তুমি আমি
চেতনা নিবিড়।
বুকে তবু জেগে থাক শারদশিশির
মাখা সোনালি শিবির।
খুদকুঁড়ো
চাঁদের অমোঘ টানে, ফুলে উঠে
বুক ভ'রা নদী,
নিজেকে উজাড় করে দিতে চায় যদি...
খুদকুঁড়ো যা ছিল মুঠোভরা ঘাস,
তোর দরজায় দেবে সবুজ বিশ্বাস।
সকালে পায়ের পাতা ছুঁয়ে দিস যদি...
টের পাবি নরম সে মেঘলা সুবাস।
কবি পরিচিতি ~
কবি ঈশানী রায়চৌধুরী নিবিড় গ্রামের অনুষঙ্গে বড় হয়েছেন
তাই সহজ জীবনে বাঁচেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
স্নাতকোত্তর আর ন্যাশানালাইজড ব্যাঙ্কের কর্মসূত্রে বহু
মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ। যুক্ত আছেন এন জি ও'র সঙ্গে
যেখানে মূলত সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ হয়। কবিতা
ছিল রক্তে এক অন্তর্লীন অনুভব হয়ে। প্রকৃতি , বই আর
কবিতা ...এই তিন ভালবাসা।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'আমি শুধু আমিই বনফুলে'।
ইন্দ্রাণী পাল'এর কবিতাগুচ্ছ
ইন্দ্রাণী পাল'এর কবিতাগুচ্ছ
★ অভিবাদন
অস্তিত্বহীনতার ওপারে আমাদের দেখা হয়েছিল
আমি তখন শরীর থেকে বর্ম অস্ত্র ঢাল খুলে ছুঁড়ে ফেলছি।
সহজ লোকের মতো জীবন আমাদের নয়
আমাদের পৃথিবী এক ট্রামের তলা থেকে ঘষটাতে ঘষটাতে
অন্য এক ট্রামের তলায় পিষ্ট হতে আসে।
জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ হয়ে খেলতে নেমেছি
সবার সব প্রশ্নের উত্তরে নীরবতা লিখি।
যে আমাকে দিনরাত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আমি তাকেই
বাহবা দিই, হাত তুলে অভিবাদন জানাই আর
না-হওয়া কবিতাগুলোর ভেতর থেকে গোপন আস্কারা
টের পেতে থাকি।
★ ঘুড়ি
বস্তুত একটি সবুজ রঙের ঘুড়ি উড়তে থাকে
তার ছায়া লাট খেতে খেতে এসে পড়ে
শিবমন্দিরের চাতালে
আমি কখনই কিংবদন্তির গল্পে বিশ্বাস করিনি
যেভাবে ঘুড়িটা তার ছায়ার স্বতন্ত্র অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না
মানুষে মানুষে দূরত্ব এক ইঞ্চিও নয়
অথচ কী অগম্য এই ব্যবধান!
★ ছুরি
ফাঁকা এক ডাকবাক্সের ফিসফিস শুনতে শুনতে
হেঁটে চলেছি রাত্রিবেলা। স্বপ্নে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছি বারবার
যখন একটা বিশাল মাথাওলা চাঁদ
এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় সরে গেছে
মুখ আর মুখোশগুলোকে বিদায় জানিয়ে
ভুল রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেছি যজ্ঞের আঙিনায়
কোনো দূরাগত দিব্য উপদেশ আমাকে ছুঁতে পারেনি
মাথার মধ্যে একরাশ চিঠি এলোমেলো পাক খেয়েছে শুধু
অস্বাভাবিকতা আমাকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছিল।
★ মুখোশ
সেসব মানুষ উড়ে বেড়ায় তাদের বুকপকেটে গোলাপ থাকে
দিনরাত একটা হলদে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে থাকি
সঙ্গী নির্বাচনে ভুল হয়ে যায়।
আমার হাসি আমি উড়িয়ে দিয়েছি চৌরাস্তায়
দিনরাত ঢলোঢলো মুখ নিয়ে অভিনয় করে গেছি:
তুমি কি টালা পার্ক থেকে এক্ষুণি বেরিয়ে আসছো ?
এখন হাওয়াতেও বিষ। ভালবাসাতেও।
আমি কি কোনোদিন এই মুখোশ ছেড়ে বেরোতে পারব না!
★ মাপ
আমরা সবাই রেস্টুরেন্টে দু'চারটে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে বসি
অপেক্ষা করি কখন শূন্যতা এসে গ্রাস করবে
সেইসব অশ্রুমোচনের কথা তোমাকে বলবো না
মেঘে মেঘে ভেসে যায় ভেলা আর আমরা সবাই
স্নো-পাউডার মেখে বিকেলের হাওয়া খেতে বেরোই।
তোমাকে দেওয়া সব কথা রাখতে পারিনি
নক্ষত্র কবেই ঝরে গেছে
আলোকবর্ষ দূর থেকে টেরও পাইনি। তবু বেঁচে আছি
যতদূর চোখ যায় টুকে রাখছি
অতিদূর অন্ধকার ভেদ করে বয়ে আসে হাওয়া।
রাস্তাগুলো ফাঁকা হয়ে এলে
মাথার মধ্যে জ্বলে ওঠে একটা দপদপে আলো
আর আমি লেপের তলায় তোমাকে খুঁজে চলি।
আপাতত ঘষা কাঁচ দিয়ে পৃথিবী দেখি দিব্যি মানিয়ে নিচ্ছে
সবাই ঢুকে পড়ছে যে যার খোলের ভিতরে
যদিও একটা মাপও কারো জুতসই নয়।
★ হাত
এবছর যত চেনাজানা আছে সব শেষ হবে।
আমরা আবার আদিম হাতের স্পর্শে
জেগে উঠব।
শরীর জুড়ে উৎসব---
তোমাদের সঙ্গে এখনও দেখা হলো না
এ বছর শীত নামবে খুব তাড়াতাড়ি।
★ গোধূলি
তারপর ফিরে পাওয়া না-পাওয়ার মধ্যবর্তী সময়টুকু
গড়িয়ে যায় গোধূলির দিকে
লোহার রেলিং থেকে উড়ে যায় একটি দাঁড়কাক
তার ছায়া ঘিরে নীরবতা এসে বসে।
আমরা মুখ বাড়াই উটের গ্রীবায়
যে যার আস্তিনে গোটানো তাস
কে কখন করে দেবে কোন চালে কিস্তিমাত
কেউ আগাম জানে না
এভাবেই আমাদের ঘাসের অন্ধকার গাঢ় হলে
মুছে যায় কাদাজল হিম ঘূর্ণি
আমাদের পরবর্তী গোধূলিরা অপেক্ষায় থাকে
একটি অস্তগামী দীর্ঘ বিকেলের।
★ পায়রা
চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য শবের মধ্যে
মুখগুলি আলাদা নয়। পাখিরা সব জানে
তেপান্তরের পার থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসা
রাজপুত্র, সেও
আমাদের মধ্যে এখন শুধুই অবসরকালীন সন্দেহ
অথচ সভ্যতা সেই কবে থেকেই পশ্চাদবর্তী।
নিরবচ্ছিন্ন ছায়ার আড়ালে কোনো সুখ নেই
তবু একটি দুটি পায়রা ঢুকে পড়ে অলিন্দে
রক্তের ভিতরে টের পাই তাদের ঝটপটানি।
★ নির্বাসন ভেঙে
একজন্ম ছুটে চলেছি চাঁদের উপর দিয়ে
এই গিরিকন্দর কদম্বমূল নির্জনে দাঁড়ায়
হয়তো দু'একটা কথা বলে হাওয়ার ভেতর
অশরীরী শোঁ শোঁ গলিতে প্রহরারত আদিম কুকুর
তোমারই ছায়ার পাশে গুটিসুটি বসি
দু'একটা শিখা দেখলেই ছুটে যাইনি চন্দ্রাহতের মতন
একজন্ম হেঁটেও হারাতে পারিনি কিছুই
তাই বুকের ভেতর বয়ে বেড়াচ্ছি আস্ত একটা ঘর
এভাবেই বারবার ফিরে আসি দিকচিহ্নহীন
নির্বাসন ভেঙে; ধূ ধূ হেমন্তের দিকে পিঠ করে দাঁড়াই।
★ মায়ানগরী
আমি আগামীর সমস্ত কথা ভুলে যাব
ভুলে যাব নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোর কথা
কড়িকাঠের দিকে চেয়ে থাকা
আত্মহত্যাপ্রবণ এক একটি বিকেলের কথা
হয়তো কোনোদিন সোনালী ব্যাঙের মতো লাফিয়ে উঠব
কোণা এক্সপ্রেসওয়েগামী বাসে
আমাদের আরো একটু কাছে সরে আসবে পৃথিবী
আর বিপিনবাবু রোজই হেলতে দুলতে অফিস যাবে
"তোমরা এইদিকে সরে এসো
অ্যাম্বুলেন্সটাকে যাবার রাস্তা করে দাও---"
বলেছিল মাইক হাতে সুদর্শন যুবা
অথচ আমাদের স্বপ্নে একটাও ডাকটিকিট ঝরে পড়েনি।
কবি পরিচিতি ~
কবি ইন্দ্রাণী পাল পেশায় শিক্ষিকা।
ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত।
প্রকাশিত বই নেই।
পৃথা চট্টোপাধ্যায়'এর কবিতাগুচ্ছ
পৃথা চট্টোপাধ্যায়'এর কবিতাগুচ্ছ
★ হরিণীর সুখ
১
নদীর সুজন বুকে রাখতেই পারো
অনন্ত উপোসী ঠোঁট। হংসিনী জল
কেটে কেটে , অবাধেই যেতে পারো
গভীরতা মেপে। তুমিও মরাল হতে পারো
ধূপছায়া জলে...
২
ভূমিকা ছিল না কোনো, ছিল না ছলনা
দেহজ সুখের ছিল জমাট পসরা
কল্লোলিত জলের ফোয়ারা।
পাতাকুড়ানিরা কবে নিয়ে গেছে
বনতলে ঝরে পড়া পাতা।
তবে কি আজকে শুধু পাতার ফসিল !
৩
উপোসী ঠোঁটের এক পুরোনো অসুখ
কদমের ফুলে মুখ রেখে খুঁজে নিতে চায়
হরিণীর সুখ, অবারিত অধিকারে।
তখনো কি দোষ দেবে দীঘল গ্রীবার ?
টেনে কি নেবে না প্রিয় সুগন্ধি শরীর ?
শব্দ মায়া জানে যারা চুপ করে থাকে
এইসব সংসার প্রতীকী সংলাপ ।
৪
কোনো কোনো সম্পর্কের মাঝে
তিরতির বয়ে যায় ফল্গু ধারা
চাঁদোয়ার ফুটোফাটা দিয়ে
আলো এসে ধুয়ে দেয় নদীর শরীর
বাতাস বিবশ হয় আহুতির ক্ষণে
৫
কায়া তরুবর পাঁচটি সে ডাল
শাখায় শাখায় দোলে অগণিত লোভ
হরিণী আপন মাংসে বৈরী হয়।
বসন্তের হাওয়া দিলে
গন্ধ শুঁকে সাপ আসে,
শিস্ দিয়ে উড়ে যায় নামহীন পাখি
শিকড় একান্তে ঢোকে মাটির গভীরে
৬
ক্রমশই নামা আর গভীরতা খোঁজা
খুঁজে যাও বালতি দড়িতে
একবার নামিও কলস
কূপের আনন্দধ্বনি পাবে
উচ্ছ্বসিত জলের আবেগে
৭
নিমফুল গন্ধ মেখে রঙিন পাখায় ,
ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি ওড়ে বাতাসের টানে ।
৮
তির্যক ঠোঁটের কোণে অনুপ্রাস প্রেম,
কখনো ঝিলিক দ্যায় দুর্যোগের রাতে।
দুহাতে সরিয়ে রাখি জঞ্জালের স্তূপ
সব স্রোত এইখানে এসে করে থাকে চুপ।
মৌনতায় ভরা থাকে আদিম বাসনা
রাতের জবায় কোনো নিষেধ থাকে না।
৯
এই এক পুরোনো অসুখ, নষ্ট ঘুম।
কামিনী গাছের ঝোপে সাপ আসে,
ধীরে ধীরে খুলে যায় আদিম খোলস,
গলে পড়ে মাদুলির মোম।
যে রাতে পাগল হয় বাঘ রতি
সেই কথা লিখে রাখে রমণ পুরাণ।
১০
তর্জনীতে লেগে থাকে জীবন বিষাদ
ভাষাহীন তরল প্রদাহ
নির্বেদ সময় ধরে অনন্ত শাসন
মানচিত্রে মেলা থাকে দেহ
চলো ফের খেলি সেই পাখিদের খেলা
কেউ এসে ছিঁড়ে খাক হরিণীর সুখ
উপোসী ঠোঁটের সেই পুরোনো অসুখ ...
কবি পরিচিতি ~
পৃথা চট্টোপাধ্যায়'এর জন্ম মুর্শিদাবাদে। বহরমপুরে স্কুলজীবন কাটিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর। বর্তমানে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। শৈশব থেকেই মায়ের অনুপ্রেরণায় সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ এবং লেখালেখির হাতেখড়ি বিদ্যালয়ের দেওয়াল পত্রিকায়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্র পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা প্রকাশিত হয়। নিভৃত কবিতাযাপন বেশি পছন্দের । কবিতা ও মুক্তগদ্য লিখতে ভালোবাসেন। বিভিন্ন কবিতার বই ও পত্র-পত্রিকার আলোচনা করে থাকেন। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেশ, কবিতা পাক্ষিক, সুখবর, ডেইলি হান্ট, দৈনিক বজ্রকন্ঠ, কবিতা আশ্রম,বারাকপুর স্টেশন, মল্লসাহিত্য, আর্ষ, শতাব্দীর কলকাতা প্রভৃতি পত্রিকায় এবং ই-ম্যাগাজিনে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'উল্কি আঁকা নদীজল' ।
রাজদীপ ভট্টাচার্য'এর কবিতাগুচ্ছ
রাজদীপ ভট্টাচার্য'এর কবিতাগুচ্ছ
সংসার
১
তিনি আসবেন এমন ভেবে
বিছিয়ে রাখি মন
আর কিছু নেই, এই মাত্র
আমার আয়োজন
২
তাঁর জন্য ফুল ফোটে
হাওয়ায় দোলে পাতা
আপন ভোলা সাঁই আমার
খেয়াল করেন না তা
৩
সূর্যকে রোজ ছুটি দেন
চাঁদের পালা আসে
তিনিই দিন তিনিই রাত
পৃথিবী মান্দাসে
৪
সবকিছুরই প্রভু তিনি
সবার তিনি শিষ্য
তিনি মালিক, ধনীর ধনী
সর্বহারা নিঃস্ব
৫
তিনিই চাকা, তিনিই রথ
তিনিই সারথী
তিনিই জাড্য, তিনি দ্রুতি
অগতি ও গতি
৬
তিনিই আমি তিনিই তুমি
এক আধারে সব
তিনি আকাশ তিনি ভূমি
শব ও উৎসব
৭
কোথাও নেই শুরু, তাঁর
কোথাও নেই শেষ
সবকিছুরই মাঝে তিনি
থাকেন নিরুদ্দেশ
৮
তাঁরই জল, তাঁরই বাতাস
তিনিই লবণ, চিনি
তিনিই ক্ষুধা, তিনিই খাদক
এবং আমিই তিনি
৯
তাঁর কাছেই আসা, ফিরে
তাঁর কাছেই যাওয়া
তাঁর কাছেই থাকা এবং
তাঁকেই খুঁজে পাওয়া
১০
তিনিই আমি, আমিই তিনি
সকল সারাৎসার
আমিই তিনি, তিনিই আমি
জমাটি সংসার
কবি পরিচিতি ~
রাজদীপ ভট্টাচার্য কবি ও সম্পাদক।বারাকপুরে বেড়ে ওঠা।
ভূগোলে স্নাতকোত্তর। পেশায় শিক্ষক।
বিভিন্ন সময়ে 'কলাম', 'উনপত্র' প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন।
বর্তমানে 'বারাকপুর স্টেশন পত্রিকা'র সম্পাদক।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ -- 'ম্যাজিক চেয়ার', 'বিষাদ বৃক্ষের ফুল' এবং 'বাড়ি ফেরার পথ'।
সোমবার, ৫ জুলাই, ২০২১
দেবদাস আচার্যের সাক্ষাৎকার
মুখোমুখি দেবদাস আচার্য
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজদীপ ভট্টাচার্য
রাজদীপ ~ নমস্কার দেবদাস বাবু। প্রথমেই বারাকপুর স্টেশন পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমরা যারপরনাই আপ্লুত।
দেবদাস ~ বেশ বেশ, ঠিক আছে, বলো।
রাজদীপ ~ একটি বিষয়ে ধোঁয়াশা প্রথমেই কাটানো প্রয়োজন, আপনার জন্মসাল বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম দেখতে পাই। যদি আপনি এ বিষয়ে আলোকপাত করেন।
দেবদাস ~ আসলে সরকারি নথিতে আমার জন্ম ১৯৪২ সালে ৩ জুলাই। সেসময়ে বাবা স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে কিছুটা আন্দাজে এরকম লিখেছিলেন। কিন্তু মায়ের কাছে আমি শুনেছি আমার জন্ম ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে। মানে শ্রাবণ মাসের শেষের দিকে।
রাজদীপ ~ তাহলে দেশভাগের সময় আপনার বয়স ছয় পেরিয়েছে। পূর্ববঙ্গের স্মৃতি কিছু মনে পড়ে এখনো?
দেবদাস ~ তা অনেকটাই মনে আছে। আমি এক আত্মজৈবনিক গদ্য 'দেবদাসের জীবনপ্রভাত'এ লিখেছি অনেকদিন আগে। ১৯৮০-৮১ সালে পরমা'তে তা প্রকাশ পেয়েছে। 'অবভাস' তাকে বই করে ছেপেওছে। আমাদের বাড়ি ছিল কুষ্টিয়া জেলার আলমডাঙ্গা স্টেশনের কাছে বন্ডবিল গ্রামে। গ্রামটি স্টেশন থেকে দুই-তিন কিঃমিঃ দূরে। বাবার সাথে হেঁটে স্টেশনে যেতাম বেশ মনে আছে। বাড়ির উঠোন থেকে পেয়ারা গাছে চড়ে দূরে রেলগাড়ি যাওয়া দেখতাম।
রাজদীপ ~ কবি দেবদাস আচার্যকে নয় একজন বরিষ্ঠ মানুষ হিসেবে আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই, কারণ এই প্রশ্ন করার সুযোগ খুব কমে এসেছে। স্বাধীনতা যেদিন এলো সেই দিনটির কথা আপনার কিছু মনে পড়ে?
দেবদাস ~ তা বেশ মনে পড়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭। সেই তেরোই আগস্ট রাত বারোটায় গ্রামের স্কুলে পতাকা তোলা হয়েছিল। পরদিন ভোরবেলা স্বাধীনতা উৎসবে আমার ঠাকুরদাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমিও সেই সাথে গিয়েছিলাম। মনে আছে ওখানে কয়েক বস্তা সাদা বাতাসা রাখা ছিল। অনুষ্ঠান শেষে আমাকেও একমুঠো বাতাসা দেওয়া হয়েছিল। মানুষজনের মনে তখন খুব উল্লাস। অথচ পরবর্তিকালে আর কোনোদিন সেখানে ফিরে যেতে পারিনি। এত কাছে তবু যাওয়া হয়নি।
রাজদীপ ~ দেশভাগের পরে দর্শনা হয়ে সবাই রানাঘাটে চলে আসলেন, তাইতো?
দেবদাস ~ হ্যাঁ, ট্রেনে রানাঘাটে আসার পরে বাড়ির মেয়েরা পাশের ছোট হোটেলের ঘরে রইল। আমরা দেড়দিন মত রানাঘাট প্ল্যাটফর্মেই পড়েছিলাম। সেখান থেকে বীরনগর। অবশেষে বছর দেড়েক পরে কৃষ্ণনগরের কাছে রাধানগরে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা হল। সেই থেকে আমি এখানেই আছি।
রাজদীপ ~ পড়াশোনা শুরু হলো কৃষ্ণনগর এ. ভি. স্কুলে?
দেবদাস ~ ঠিক বলেছ। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ঠিকই, কিন্তু কয়েক মাস ক্লাস করে আর এগোতে পারলাম না। কারণ কৃষি দপ্তরে চাকরি পেয়ে গেলাম ইতিমধ্যে।
রাজদীপ ~ আপনার সাহিত্যজীবনে আসি এবার। যতদূর জানি আপনি গদ্য দিয়ে জীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে কবিতায় আসা।
দেবদাস ~ হ্যাঁ, তা বলা যায়। তবে প্রথম দিকে স্কুলে কবিতা, গদ্য সবই লিখেছি। কলেজে যখন পড়ি আমার গল্প স্থানীয় লিডিং পত্রিকাগুলিতে ছাপা হতো। তবে সাথে সাথে কবিতাও লিখেছি। দুটোই পাশাপাশি চলছিল। পরে এসে জুটল নাটক, ১৯৬৫ সাল নাগাদ।
রাজদীপ ~ প্রাথমিকভাবে প্রত্যেকের একটা নাড়া বাঁধা হয়। আপনার ক্ষেত্রে বৃন্দাবন গোস্বামীর আড্ডাই কি সেই আশ্রয় ছিল?
দেবদাস ~ হ্যাঁ, তবে তারও আগে সুশান্ত হালদারের একটি ছাপাখানা ছিল 'মুদ্রণী' নামে। আমি যখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন 'হোমশিখা' নামে একটি পত্রিকায় আমার গল্প ছাপা হয়েছিল। একদিন সামনে দিয়ে যাচ্ছি সুশান্তবাবু ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন যে অমুক গল্পটি আমার লেখা কিনা। বললাম। শুনে খুব প্রশংসা করলেন। আমাকে ওনার ওখানে যেতে বললেন। ওনার কাছেও আলোচনা হতো। যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন একটা উপন্যাস লিখে ফেলেছিলাম। একটা প্রকাশনী সংস্থা ছাপতে চেয়েছিল কিছু টাকার বিনিময়ে। তাই আর হয়নি। এর পরেও আমি দুটি উপন্যাস লিখেছিলাম। ছাপাও হয়েছিল। একটার নাম মনে আছে 'পাখিরা পিঞ্জরে'। তবে এই দুটি উপন্যাসের আর কোনো অস্তিত্ব আমার কাছে নেই। তাছাড়া অনেক গল্প লিখেছি বিভিন্ন পত্রিকাতে। সে সব হারিয়ে গেছে। তবে সম্প্রতি 'মতিগতি' বলে একটি গদ্যের বই প্রকাশ পেয়েছে। সেটা খানিকটা গল্পগাছা টাইপের। ১৯৬৫ সাল নাগাদ বৃন্দাবন গোস্বামীর 'সেতু' সংস্থার জন্য একটি নাটক লিখি। সেটা অভিনয় হল। এরপর আইপিটিএ এর স্থানীয় সংস্থার জন্য নাটক লেখা শুরু করলাম। ১৯৬৭ থেকে ৭২ পর্যন্ত টানা ওদের জন্য 'হাতুড়ি', 'চাকা', 'মহাভারতের কথা' প্রভৃতি অনেক নাটক লিখেছি। তার মধ্যে ১৯৭১ সালে কৃষ্ণনগর রবীন্দ্র ভবনের আমার লেখা 'মেঘ মেঘ' নামে একটি নাটক করি। সেটা ছিল শ্রুতিনাটক। তখন সুধীর চক্রবর্তী তাঁর নাম দিয়েছিলেন স্বরাভিনয়। এমন শ্রুতিনাটকও তখন অনেক লিখেছি। তবে সে সব হারিয়ে গেছে। আমি কিছুই রক্ষা করতে পারি না। আমার তখন একসাথে সব চলছে গল্প-কবিতা-নাটক। কোনটা আঁকড়ে ধরব তার ঠিক নেই।
রাজদীপ ~ এবার বলুন অরুণ বসুর ভূমিকা আপনার জীবনে।
দেবদাস ~ অরুণ বসু 'অজ্ঞাতবাস' নামে পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সেবার এসেছিলেন কৃষ্ণনগরে একটি কবিতার আসরে। সেই অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ার জন্য আমিও নাম দিয়েছিলাম। যাই হোক উদোক্তারা আমাকে পড়ার কোন সুযোগ না দিয়েই মাইক গুছিয়ে ফেললো। আমি প্রতিবাদ করলাম। কিন্তু তারা আমাকে কবি বলে মানতেই রাজি নয়। (দীর্ঘ হাসি) তা এসব দেখে অরুণ বাবু আমাকে বললেন যে "আপনি কি কবিতা পড়তে চান?" আমি বললাম "হ্যাঁ, সে তো চেয়েছিলাম। কিন্তু পড়তে দিচ্ছে কোথায়!" উনি বললেন "আপনি পড়ুন, আমি শুনবো"।
সেই সময় কবিতা অত গুছিয়ে রাখতাম না। যাহোক ভাঁজ করা কাগজে গোটা চারেক কবিতা ছিল। বার করে পড়লাম। অরুণ বাবু বললেন "যাক, আজকে তাহলে আপনার কবিতা শুনতেই এসেছিলাম"। উনি চারটে কবিতাই নিয়ে নিলেন। ওনার পত্রিকায় ছাপলেন। এরফলে আমার একটা কবি পরিচিতি তৈরি হলো। এভাবে লিটল ম্যাগাজিন আমায় কবি বানিয়ে দিলো। অন্যান্য সম্পাদকও কবিতা চাইতে শুরু করলেন। এজন্য অরুন বসুর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। উনিই স্থির করে দিলেন আমার পথ।
রাজদীপ ~ আপনার কবিতায় বিস্তারিত প্রবেশের আগে আরেকটা বিষয় জানতে চাই। আপনি চোখের সামনে খাদ্য আন্দোলন, নকশাল আন্দোলন দেখেছেন। এইসব ঘটনা আপনার লেখায় কি প্রভাব ফেলল?
দেবদাস ~ হ্যাঁ, প্রভাবতো পড়েইছে। 'কালক্রম ও প্রতিধ্বনি' নামের মধ্যেই সেই ছায়া আছে। কাল বা সময়ের প্রতিধ্বনি। তখন যুগটা ছিল প্রতিবাদ-প্রতিরোধের। যুগের সেই প্রতিবাদী চরিত্র আমার প্রথম বইতে গভীর প্রভাব রেখেছে। বুঝতে পারছ, তখন হাংরি জেনারেশনের প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অরুণ বসুর অজ্ঞাতবাসেই সুনীল গাঙ্গুলী একটি গদ্য লিখেছিলেন। তাতে মোদ্দাকথা তিনি বলেছিলেন যে বাংলা কবিতা তিনশ সাড়ে তিনশো শব্দে আটকে গেছে। নতুন শব্দ নতুন ভাষা তৈরি হচ্ছে না। আমি আমার কবিতায় সেই শব্দ আনতে চাইলাম। 'কালক্রম ও প্রতিধ্বনি'র 'সে নিড়িনি চালায় শস্যে' বা 'আমার জলের পোকা' এই কবিতাগুলি দেখবে। তাদের ভাষা, বিষয় ভাবনা - এসব বাংলা কবিতায় নতুন।
"এক শানকি পান্তা আনে মেয়ে তার গামছা দিয়ে বেঁধে / ঠিলেয় করে জল, সরায় করে কাছিমের ডিম / সে মধু ভাঙে গাছ থেকে, মধু দিয়ে পান্তা ভাত খায় / সে পান্তা খায় আর হুলুই দেয় গরু-বাছুর দেখে / তার মেয়ের নাকছাবির মতো ফসল রমরম করে। "
রাজদীপ ~ আপনার লেখা ধারাবাহিকভাবে পড়লে আমরা খেয়াল করি যে একদম প্রথম দিকে 'কালক্রম ও প্রতিধ্বনি' নির্ভেজাল মানুষের কথা বলে। 'মৃৎশকট'এ সেই ক্যানভাস বড় হয়ে যায়। এই পৃথিবী, নক্ষত্রলোক কবিতায় ঢুকে পড়তে থাকে। আবার 'মানুষের মূর্তি'তে ফিরে আসে চারপাশের খেটে খাওয়া মানুষেরা। আপনার বাবা-মা। পুনরায় 'আচার্যের ভদ্রাসন'এ আপনি সেই বিশ্বসংসারের ডাক শুনতে পেলেন। এরপরের কাব্যগ্রন্থ 'তর্পণ' থেকে শুরু হলো তীব্র আত্মখনন। এভাবে মাটির কাছাকাছি জীবন, মহাপৃথিবীর ডাক এবং নিজেকে খনন --এই তিনটি চেতনাস্রোত মিলেমিশে নির্মাণ হলো কবি দেবদাস আচার্যের। এ বিষয়ে আপনার কি মনে হয়?
দেবদাস ~ একদম ঠিক। আসলে 'আচার্যর ভদ্রাসন' এর আগে পর্যন্ত আমি সহজে রিয়াক্ট করতাম। যা দেখতাম তাই লিখতাম। একটি বইয়ের ব্লার্বে লিখেছিলাম "জীবন আমাকে যা দিয়ে থাকে আমি তাই কেবল জীবনকে ফিরিয়ে দিতে পারি। এর বেশি শিল্প আমি পারি না, এর বেশি অঙ্গীকার আমি করিনি"। তখন আমি খুব অবজেক্টিভ। আমার তখনকার লেখায় দেখা যাবে, ফুলকপি হাতে কেরানি আসছে। মানে আমার কবিতা তখন উঠে আসছে প্রত্যক্ষ জীবন থেকে নেওয়া বোধ হতে। হতদরিদ্র-দরিদ্র-সংগ্রামী জীবনের কথা বাংলা কবিতায় ছিল না। "আমি যত কবি কামারের, মুটে-মজুরের"- এই বলে কবি চলে গেছেন। স্পর্শ করতে পারেননি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় কিছু ছোঁয়া আছে। কিন্তু এই প্রান্তিক জীবনকে বাংলা কাব্যে প্রতিষ্ঠার কাজ ইতিপূর্বে হয়নি। আমি বাস্তব জীবন থেকে উঠে আসা নির্যাস আমার কবিতায় ধরার চেষ্টা করেছি।
এই বাস্তব জীবনের বাইরে ছিল আমার ধ্যানের জীবন। এই সময়ে খড়ে নদীর ধারে একটা বাড়ি করে আমি চলে আসি। মূল শহরের বাইরে এই নির্জনে চলে আসার পরে আমার মনে হলো সেই চর্যাপদের সাধকদের কথা। যারা নগরের বাইরে নির্জনে সাধনরত থাকতেন। আমারও মনে হলো, আমাকে ঘিরে রয়েছে হাজার বছরের আবহমান বাংলা। যার কোন পরিবর্তন হয়নি। একটা জনজাতি, যারা শুয়োর পোষে। একটা শ্মশান রয়েছে। সেখানে কাপালিক আছেন। বড় আকাশ। বিশাল চাঁদ। অনেক আলো। গাঢ় অন্ধকার। শহরের ভিড়ে এমন দেখা যায় না। কিন্তু এই উপান্তে বসে সবই যেন বড় মনে হত, অখন্ড মনে হত। ফলে আমার মধ্যে অদ্ভুত অনুভূতি হল। আমি নিজের ভিতরে সেই চর্যাপদের ধ্বনি খুঁজে পেলাম। তারই প্রকাশ ঘটল 'আচার্যের ভদ্রাসন'এ। এ একপ্রকার জীবন সাধনা, যার স্বাদ অন্যরকম।
রাজদীপ ~ এরপর আপনার বাবার মৃত্যু আপনার কবিতায় ছায়া ফেলল --
দেবদাস ~ আমার বাবা চলে গেলে ১৯৯২ সালে। এর ফলে ধীরে ধীরে আমার অন্তর্গত মন আরও বিকশিত হল। 'আচার্যের ভদ্রাসন' থেকেই হচ্ছে, তবে এ সময়ে অন্তর্দর্শন আরো প্রকট হল। তার ফলেই এল 'তর্পণ'।
রাজদীপ ~ প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যের প্রতি তাগিদ কীভাবে এবং কেন উপলব্ধি করলেন?
দেবদাস ~ আমি ষাটের দশক থেকে কবিতাযাত্রা শুরু করেছিলাম। সেই সময়ে লেখকদের মধ্যে একটা দ্রোহ ছিল। বিভিন্ন সামাজিক, রাষ্ট্রিক দমন চলছে চারপাশে। একটা ভাঙ্গনের দশক। তাই এসব থেকেই আমাদের মনে একটা চেতনা গড়ে উঠেছিল যে, যা কিছু প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা আছে তা কবিতা-গল্প-নাটক-থিয়েটার -- যাইহোক এসবকিছুকে ভেঙে একটা নতুন জায়গায় যেতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান বলতে একটা সংস্থা। তারা ব্যবসা করে, তাই সাহিত্যকে তারা ব্যবসার নিরিখে দেখবে। যা চলবে বাজারে তাকে রাখবে, বাকি ফেলে দেবে। আমার তাই মনে হত যে পণ্যসাহিত্য আমি নেব না। সাহিত্যের একটা স্বাধীন বিকাশের ক্ষেত্র থাকবে। কাউকে খুশি করার জন্য সাহিত্য হবে না। তাই কলেজ জীবন থেকেই আমার মনে এই প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানসিকতা গড়ে ওঠে। তাই যা প্রতিষ্ঠিত সত্য, তা সত্য নয়; তার চেয়েও বড় সত্য আছে-- এটাই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। সে অর্থে রবীন্দ্রনাথও প্রতিষ্ঠানবিরোধী। সজনীকান্ত প্রমুখের প্রতিষ্ঠিত ঘরানার বাইরে তাঁর অবস্থান। মাইকেল মধুসূদন প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী। তাই তাঁর 'মেঘনাদবধ কাব্য'এর প্যারোডি বেরোলো 'ছুছুন্দরী বধকাব্য' নামে। তিনি প্রতিষ্ঠিত কাব্যধারাকে প্রবল আঘাত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন "অলীক কুনাট্য রঙ্গে, মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে"। প্রতিষ্ঠান বিরোধীরা গলা উঁচু করে বলে না যে তারা প্রতিষ্ঠানবিরোধী, কিন্তু তাদের কাজে তা প্রকাশ পায়।
প্রকৃতির নিয়ম প্রগতি। যা আছে তাকে অতিক্রম করে যাওয়া। তাই একে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা যেমন বলা যায় তেমনি স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবেও দেখা যায়। আমি আমার লেখায় বারবার বলেছি যে সঠিক কথাটি 'প্রতিষ্ঠানবিরোধী' নয়, 'অপ্রাতিষ্ঠানিক'। কারণ চিরকাল প্রতিষ্ঠানবিরোধী কিছু থাকে না। আর আজকের বিরোধী একদিন বর্তমান প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। তাই বিরোধী তখন প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। এজন্য 'অপ্রাতিষ্ঠানিক' বলাটাই শ্রেয়। প্রতিষ্ঠানকে অতিক্রমের মধ্য দিয়েই সাহিত্যের অগ্রগতি। আর তা পণ্যসাহিত্য করে না। একমাত্র লিটল ম্যাগাজিনই পারে অপ্রাতিষ্ঠানিক হতে।
১৯৮৯ সালে কৃষ্ণনগরে আয়োজিত 'শতজলঝর্ণার ধ্বনি' খুব সাফল্য পেয়েছিল। বাংলা ও বাংলার বাইরে থেকে বিপুল সমাবেশ হয়েছিল। তখন ধারণা ছিল যে লিটিল ম্যাগাজিন আসলে প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে হাতমস্ক করার জায়গা। আমরা সেই ধারণাকে মুছে দিতে চেয়েছিলাম। বলতে চেয়েছিলাম যে লিটল ম্যাগাজিনই একমাত্র সৃজনশীলতাকে রক্ষা করতে পারবে। নতুন বিকাশের ক্ষেত্র খুলে দিতে পারবে। সেটা 'প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা' বললে তাই। আর আমি তাকে বলি 'অপ্রাতিষ্ঠানিকতা' বা 'প্রতিষ্ঠান নিরপেক্ষতা'।
রাজদীপ ~ এবার 'ভাইরাস' সম্পর্কে শুনতে চাই। 'ভাইরাস' পত্রিকা প্রকাশ করার কথা ভাবলেন কীভাবে?
দেবদাস ~ এখন ভাইরাস শুনলেই ভয় লাগে! (মজার হাসি) সব করোনা ভাইরাস হয়ে গেছে !
রাজদীপ ~ অথচ তখন কবিতার সংক্রমণ ছড়ানোর জন্যই এই নাম দিয়েছিলেন, তাই না?
দেবদাস ~ ঠিক বলেছ, সেই সময় আমার মনে হয়েছিল যে একটা পত্রিকা করলে হয়। এমন একটা কাগজ করব যার ভারে নয় ধারে মূল্য হবে। চার পৃষ্ঠা লিফলেট এর মতো। ভাসিয়ে দেবো মহাকাশে। সে তার গন্তব্যে পৌঁছাবে। যাইহোক নাম এমন দেওয়ার কারণ ভাইরাস অতি ক্ষুদ্র, কিন্তু তার প্রভাব ব্যাপক। আমাদের কাগজও তেমনি হবে। আমাদের সেই ক্ষুদ্র কাগজ মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করবে কবিতার শক্তিতে।
ভাইরাসের নামপত্র আমারই আঁকা। আমিই সম্পাদনা করতাম। বন্ধু প্রিয় বিশ্বাস আমাকে কাগজের দাম দিয়ে সাহায্য করতেন। ১৯৭৫ এর ডিসেম্বরে প্রথম সংখ্যা প্রকাশ পায়। এরপর মার্চ ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়মিত ভাইরাস প্রকাশ পায়। তারপর আর্থিক কারণেই বন্ধ হয়ে যায়।
রাজদীপ ~ এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনার কবিতায় সেভাবে কোথাও যৌনতা আসেনি। অথচ সমসাময়িক অন্যান্য কবিদের কবিতায়, হাংরি লেখাপত্রে প্রবলভাবে তা প্রকাশ পেয়েছে। এটা কি আপনি ইচ্ছাকৃত করেছেন, নাকি এটাই আপনার স্বাভাবিক প্রকৃতি?
দেবদাস ~ না, ইচ্ছাকৃত নয়। আমার কবিতায় নিজের স্বভাবকেই আমি উন্মোচিত করে এসেছি। তাই এটা আমার প্রকৃতিগত। তবে দুটো কবিতার নাম এক্ষেত্রে আমি বলতেই পারি, যেমন 'টনিক' আর 'বাণিজ্য সুন্দরীর প্রতি লিরিক'। তবে সেটাও পুরোপুরি বাস্তবিক যৌনতার প্রকাশ নয়, সেখানে একটা অন্য আক্ষেপ আছে।
রাজদীপ ~ ১৯৪১ থেকে এখন ২০২০, দীর্ঘ ৭৯ বছর পেরিয়ে এসেছেন আপনি। আজ পিছন ফিরে তাকালে নিজের জীবনকে কীভাবে দেখেন? কী মনে হয়, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা! কী বলবেন একে আপনি?
দেবদাস ~ এটাই তো বলা মুশকিল। তবে জীবন খুব মোহময়। কত বিচিত্র ভঙ্গিমা তার। কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। জীবন খুব মোহাচ্ছন্ন করে বটে। কিছুতেই হারাতে ইচ্ছে করে না। এ এক ভয়ানক আশীর্বাদ যে আমি এই জীবন পেয়েছিলাম!
রাজদীপ ~ এই মহাশূন্য; এই চৈতন্যময় জগৎ আর অচৈতন্যের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করেন কোথায়?
দেবদাস ~ আমি বলেছি আমার লেখায়, "আমি তুচ্ছ প্রাণ এক"। মহাব্রহ্মান্ডের মাঝে ভাসতে-ভাসতে আসছি। যেখানে সুযোগ পাচ্ছি বিকশিত হচ্ছি। আমি বিজ্ঞান অত জানি না, অনুভূতি দিয়ে যতটা বুঝি আমার বিস্ময়কর লাগে।
রাজদীপ ~ এখানে আপনার একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। নাম - 'না-থাকার পর থাকাটুকু'।
" উবে যাওয়া কর্পূর যেমন / গন্ধ হয়ে থাকে / কিছুক্ষণ // ওই কিছুক্ষণটুকুই প্রকৃত কর্পূর // পৃথিবীতে হয়ত আমারও / এ প্রকার উদ্ভাসিত / অল্প কিছুক্ষণ থেকে যাবে / অপসৃত হওয়ার পরও"
এবার উল্টোটা জানতে চাই আপনার কাছে। মৃত্যুকে কীভাবে দেখেন আপনার দৃষ্টিতে?
দেবদাস ~ এইতো! মৃত্যুচিন্তাটাই আমি করতে চাই না (ছেলেমানুষী হাসি)। দর্শনের আলোয় বরং একটু মোলায়েম করে নিই ব্যাপারটা। আমার কবিতায় বলেছি আলোর সরণি বেয়ে চলে যাব। ওই ডাইরেক্ট 'মৃত্যু' শব্দটা আমি পছন্দ করি না।
( কবিতা : আলোর সরণি
একফালি রোদ / ব্যালকনিতে নেমে এল / মনে হল একফালি আলোর সরণি / অনন্ত থেকে নেমে আসা // কেউ নামবেন ওই পথে পৃথিবীতে, ভাবি // নামলেন, ক্ষণকাল / আলোর ইশারা হয়ে // ইশারার টানে ও পথেই / আমিও একদিন / উবে যাব")
রাজদীপ ~ এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দের মৃত্যু দর্শনের তফাৎ আপনাকে কীভাবে ভাবায়?
দেবদাস ~ আসলে ভারতীয় দর্শন কে সম্পূর্ণ আত্মস্থ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে মৃত্যু মানে রূপান্তর। একরূপ থেকে অন্য রূপে যাওয়া। আত্মা অবিনশ্বর। অন্যদিকে জীবনানন্দ দাশ অন্যভাবে প্রবল সেন্সুয়াস। একজন নিবিড়, আত্মমগ্ন, নিজেকে গভীরভাবে ভালোবাসার মানুষ। নিঙড়ে পেতে চান এই পৃথিবীকে। এটা বিদেশি দর্শন থেকে আসা -- " Drinking life to the less"।
রাজদীপ ~ বেশ, এবার আপনার প্রিয় কবিদের নাম শুনি।
দেবদাস ~ সেইভাবে বলা মুশকিল। তবে বড় স্প্যানে যদি বলি তবে তিনজন আমার খুব প্রিয়। তাঁরা আন্তর্জাতিক মানের কবি ; মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশ।
রাজদীপ ~ আর সমসাময়িককালে পছন্দের ছবি?
দেবদাস ~ সমসাময়িক সবাই তো বন্ধু আমার। সেভাবে বলা কি ঠিক হবে! আমি সবাইকেই ভালবাসি, পছন্দ করি। তাদের কবিতায় আমি লালিত হয়েছি।
রাজদীপ ~ আপনি ষাট দশকের কবি। তার পরেও পাঁচটি দশক পেরিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলা কবিতা কতটা এগিয়েছে বা কোথাও আটকে গেছে কি? আপনি এ বিষয়ে কি মনে করেন?
দেবদাস ~ আমি সাদামাটা ভাষায় কথা বলি। দেখ উত্তরণ ঘন ঘন হয় না। তার জন্য সময় লাগে। তবে প্রগতি ক্রমাগত চলে, একটা অন্তর্লীন প্রবাহের মত। সেটা বজায় রয়েছে। ষাট দশকের পরে বাংলা কবিতায় বেশ কিছু বাঁক এসেছে। তাই উত্তরণ আর প্রগতির মধ্যে তফাৎ রয়েই যায়। অলীক কুনাট্য ভরা দীর্ঘ সময় পেরোনোর পরে মধুসূদন বাংলা ভাষার উত্তরণ ঘটিয়ে ছিলেন। এরপর লিরিক কবিতার ধারায় এলেন বিহারীলাল, আর তার চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটল রবীন্দ্রনাথে। তারপরে জীবনানন্দ নতুন ভাষা ও শৈলীতে আবার এক উত্তরণ ঘটালেন। এভাবেই চলে। প্রগতি চলতেই থাকে, আর সহসা দীর্ঘ সময়ান্তরে আসে উত্তরণ।
রাজদীপ ~ এই মুহূর্তে বাংলা ভাষায় কত নবীন কবি অক্ষর সাজাচ্ছেন। একজন সিনিয়র কবি হিসেবে তাদের কী বলবেন?
দেবদাস ~ আমি আর কী বলব! আমি তো তাদের লাইন আপ করে দিতে পারি না। আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই তাদের।
রাজদীপ ~ ব্যারাকপুর স্টেশন পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। এভাবেই সৃষ্টিশীল থাকুন আরো দীর্ঘ সময়। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
দেবদাস ~ তুমিও ভালো থাকো। আমার অনেক ভালোবাসা জেনো।
★ বারাকপুর স্টেশন পত্রিকা দ্বারা সম্পূর্ণ সংরক্ষিত। এই সাক্ষাৎকারের অন্য কোনো রূপে ব্যবহার অনুমোদন সাপেক্ষ।
শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে
"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত ৭ . " And miles to go before I sleep And miles to go before...
-
ভ্যাকুলিঞ্চুক সজ্জ্বল দত্ত " Our resistance will be long and painful but whatever the sacrifices , however long the s...
-
''অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে'' সজ্জ্বল দত্ত ২ . মানুষের মূর্তিই কালক্রমের প্রতিধ্বনি ...
-
"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত ৬. সমসাময়িক বাংলা কবিতা দেবদাস ছ'য়ের দশকের শেষপ্রান্তের কবি । তার প্রথম কাব্যগ্...