রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

 ঈশানী রায়চৌধুরীর কবিতা 



এক পৃথিবী


ধরো তুমি, অন্য দেশে গেছ কাজ করতে...

তোমার পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছে... এক কুঠরিতে গাদাগাদি করে ঠুসে রেখেছে

...খাবার নেই, শৌচালয় নেই

কাকে ডাকবে গলা চিরে? কোন ভাষায় ডাকবে ? 

এদেশেও যদি অন্য রাজ্যে যাও  পেটের টানে.....

    হঠাৎ চাক্কা বন্ধ !

প্রাণের দায়ে ঘরের দিকে ছুটছ।খালি পা ফেটে চৌচির

.... বউয়ের কাঁখে নেতিয়ে পড়েছে শিশু !

ধর, বাড়ির কাছে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল যে মেয়েটা...

সে কি মরার আগে মা বলেনি ?

যাকে গ্যাসচেম্বারে ঢোকানো হচ্ছে, সেও তো মাতৃভাষায় প্রার্থনা করেছিল.... মায়ের মুখ মনে করেছিল!

তবে কোন সাহসে তোমরা আমার মাকে ফাঁসিকাঠে তুলতে চাও ?

যতক্ষন আমার বুকে রক্তবিন্দু আছে আমি কি ঝাঁপিয়ে পড়বো না !

  দস্যু   তোমরা  কজন!

  আমরা  এক  পৃথিবী!


আটপৌরে


মাতৃভাষা তুমি কেমন দেখতে! আমার মায়ের মত আটপৌরে, শাড়িতে  হলুদ,

 হাতে মাছের গন্ধ!

নাকি  শ্বেতশুভ্রা  তুমি     

         সরস্বতী!

মা বললে বুকে যে ঝিলিক মারে, তেমন করে ডাকবো তোমায়.... নাকি বিদ্যে  কমললোচনে  বলবো! 

যে চোখ আমায় পড়তে পারে.. জ্বর হয়েছে, না ক্ষিদে পেয়েছে । যে কোন চুরমার চন্দন হয়ে যায়

যার হাতে... তুমিই কি সে   

     মাতৃভাষা!

মাতৃভাষা, তুমি আমায় গান দিয়েছ..মা যেমন ভাত দেয়,

গল্প বলেছ..মা যেমন ঘুম পাড়ায় । বর্ণমালা হয়ে তুমি হাত ধরে আছ... যেমন হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছিল মা!


তোমাকে বুকের থেকে উপড়ে নিতে দেব না কাউকে

        লড়াই করবো !                

ভাষা শহীদের রক্তের দিব্বি!

      এই আমাদের শপথ !




 সুবিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় -এর কবিতা 



অনুবাদক 


আর কত দিন আমরা নিঃশ্বাসের অনুবাদ করব !


সিঁড়িতে পায়ের শব্দের অনুবাদ। 

হল্লার অনুবাদ। বঙ্গবন্ধুর অপমানের অনুবাদ।

সংশয় আর শঙ্কার অনুবাদ।

বেয়নেটের অনুবাদ। 

মেঘ আর স্রোতের মত রক্তের অনুবাদ। 


পরিচিত মুখের ওপর অপরিচিত মুখোশের অনুবাদ।

জীবনের অনুবাদ। আত্মার অনুবাদ।


মায়ের অনুবাদ আর তার চোখের জলের অনুবাদ। 

প্রতিবাদ এবং রাষ্ট্রের অনুবাদ। ঘামের অনুবাদ। 

আশা থেকে হাঁটতে হাঁটতে ঘোর নিরাশার বুদবুদে  

ঢুকে পড়ার অনুবাদ করব কতদিন আর। 



শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের পাকানো মুঠোর 

অনুবাদ করে দেবে এমন ভাষার খোঁজে 

চৌকাঠে চৌকাঠে , 

প্রান্তরে প্রান্তরে ,

অরণ্যে অরণ্যে

নদীতে নদীতে , 

মহাদেশ থেকে মহাসাগরের উত্তাল জলোচ্ছ্বাসে

খুঁজব কতদিন আর কতদিন !



প্রণয় প্রস্তাব


পানের খিলির মত মুড়ে নিচ্ছে সে। 


আবৃত হচ্ছি ক্রমে। 

আদৃত হচ্ছি স্মিত। 

আশ্রিত হচ্ছি আতপ্ত। 


ওলো বাংলা ভাষা , 

নতজানু আমি হাঁটু মুড়ে প্রস্তাব রাখি 

জীবন সঙ্গী হবে !




 হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা 




বর্ণপরিচয়
-----------

আকাশ ঘরে মেঘ এসে ঢুকলে আমাদের  উঠোন জুড়ে গাছের ছায়া এসে পড়ত। গামছা পরে বাবা গরুর মুখে ঘাস এনে দিত। ছোট ছোট পায়ে মাটির দুয়ারে দৌড়াদৌড়ি করলে বাবা নদীর ধারে নিয়ে যেত। দুজনে পাশাপাশি শুয়ে থাকতাম অনেকক্ষণ। নদীর ছলাৎছলে জেগে উঠলে বাবা বলতো, এটা অ। সন্ধেবেলা অ নিয়ে বাড়ি ফিরলে মা মুখে জন্মদিনের মিষ্টি দিত। 

ভাতের থালায় আওয়াজ উঠলে দুপুরের রোদ সোজা মাটির জানলা দিয়ে এসে মায়ের আঁচলে আলো ছায়ার খেলা শুরু করতো। আমরা ভাত মুখে দিয়ে হাসতাম। হাসির আওয়াজে ডুবে যেত ভাতের গন্ধ। মা রান্নাঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে কাঠের উনুনের গল্প বুনতো। ভাতের থালায় হাতের ছন্দে দুলতে দুলতে বাবা বলতো, এটা আ। অন্ধকারে মায়ের বুকের কাছে আ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।

খুব ভোরে বাবার হাত ধরে শিশিরে পা ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জমির আলে এসে বসতাম। ধান গাছের গায়ে হাত বোলানো শেষ হলে সূর্য উঠতো। বাবা চোখ বুজে বলতো, এটা ই। নতুন রোদে সোজা দাঁড়িয়ে আমি ই পড়তাম।

অনেক রাতে বৃষ্টি থামলে চাঁদ উঠতো। সেতুর ওপর বসে বাবা গান ধরতো, "আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে"। গান থামলে জ্যোৎস্নায় ভেজা গা থেকে উঠতো অক্ষরের গন্ধ। বুঝতে পারতাম এটাই ঈ। কাছের মানুষ পাওয়ার আনন্দে আমি ভুলে যেতাম রাতে আমাদের কোনো ভাত ছিল না।




 পৃথা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা



প্রিয় বর্ণমালা 


যেন অনন্তকাল বসে আছি এইভাবে ভোরের কুয়াশায়। আমার চোখের সামনে একে একে খুলে যাচ্ছে শহরের পৃষ্ঠাগুলো  আর খুলে যাচ্ছে অজস্র জানলা। কিছু ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে কিছু মুখ, জলতরঙ্গের মত ভেসে আসছে নারীকণ্ঠের রিনিরিনি। বেলা যত বাড়তে থাকে শঙ্খচিলের মত ডানা মেলে দেয় সময়। আর আমি মনের আকাশে খুঁজতে থাকি আমার প্রিয় বর্ণমালা। কখন যে গাছে গাছে কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে গেছে টের পাই নি। কিছু লিখব বলে খাতা খুলে দেখি আমার পাতায় পাতায় কখন যেন লেখা হয়ে গেছে  একুশে ফেব্রুয়ারির গান। 


প্রিয় বর্ণমালা 


এক দীর্ঘ মিছিলে দলে দলে চলেছে মানুষ। পায়ে পায়ে চলছে আলাপন। আমিও হাঁটছি তালে তাল মিলিয়ে তাদের সঙ্গে। যে গাছগুলো বিগত যাত্রাপথে নিষ্পত্র ছিল ক্রমশই ভরে উঠেছে কচি পাতায় আর আড়ালে আবডালে উঁকি দিচ্ছে রক্ত পলাশ, কৃষ্ণচূড়া। বড় উজ্জ্বল সেই রং। ক্রমশ ফুলে ফুলে সব গাছ ভরে গেলে ধ্বনিত হল গান। মিছিলে সামিল সবার পায়ে পায়ে বেজে উঠল জল-নূপুর। পায়ে পা মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই ক্রমশ এগিয়ে চলেছে ভাষাহীন স্তব্ধতায় অনন্ত  একুশে ফেব্রুয়ারির অন্তঃপুরে ।




 সুতনু হালদারের কবিতা 


ভাষাসৈনিক


যুবক রোদ্দুরের আলজিভ

নিছক তৃষ্ণার প্লাজমায় ভরা 

অক্ষর দিয়ে মেপে চলে তীব্রতা


ঘুম ঘোরে জেগে থাকে স্বর্ণকায়া


মুখমণ্ডল জুড়ে জন্মিয়েছে অজস্র প্রবাল

সমস্ত চঞ্চলতায় আচ্ছাদিত ফেনিল সাগর

কাকভোরে শুধু এক নয় 

প্রতিদিন সুনিপুণ জ্যোতিষ্ক


একটু একটু করে ভাষাসৈনিকের

ডমরু শীৎকার শোনা যায়


নাভিকুণ্ড জুড়ে জাগ্রত হয়ে ওঠে

দুরন্ত শস্যকণার প্রাণবন্ত ডিকোডিং 


পৃথিবীর মেনোপজ


তারপর হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ নদী হয়ে যাই

                        ।। 

নদীর ভেতরে লুকিয়ে থাকা স্মৃতিকথা

এগিয়ে এসে আলিঙ্গন করে


সমস্ত আলিঙ্গনের নেপথ্যে

কয়েকটা একত্রিত দুপুর উতলে ওঠে


আলঝেইমার আক্রান্ত জলে 

আবেগ-শিশিরের নাদব্রহ্ম

পৃথিবীর মেনোপজ মিইয়ে 

রক্তের রোঁয়া ওঠা নির্যাস

                    ।।

ভ্রাম্যমাণ জলস্তম্ভে অগোচর ভাষ্যকার


ভাষাশহীদ 


ডিভাইডারে ওঁৎ পেতে বসে থাকে স্ফটিকার ট্যুইট 

বীজমন্ত্রের লুব্রিকেটে চুরমার বিস্ফোরণ! 

কয়েকটা শব্দ...রক্ত, ভাষা-শহীদদের আর্তনাদ


নিরবধি উচ্চারণ ওঁঃ স্বাহা, 

ভেঙে যায় আগুনের ব্যারিকেড 

পুচ্ছকেশে বিনম্র ধোঁয়া, লজ্জাবস্ত্র;

কাজের গ্রাফিক্সে ঘিলু, সম্মতিতে

গর্জে ওঠে ফেব্রুয়ারির একুশ


সীমানার চিন্ময়ী অঙ্গরাগে

ডিনামাইটের পর্যটক মিম 


প্রতিটা শব্দই আসলে

এক একটা ভাষা আন্দোলন




 গৌতম বাড়ই এর কবিতা 



এখনও বেঁচে আছি তোমার ঠোঁটের শব্দে


ভাসমান ঠিক আধখানা চাঁদ নেমে আসে

বালিকাটির মতন স্বচ্ছ নদীর জলে

রাত গভীর হলে চাঁদ আর তার প্রতিবিম্ব

কোলাকুলি করে খোলা আকাশের নিচে

এই নদীটির জলে।


পর্বত হতে চেয়েছিল শূন্য বুকে

আঁধার রাতে উড়ছিল যক্ষের মতন মেঘ

বালাম নৌকোর সারি ঘাটে- ঘাটে

মা যে শূন্যতা এঁকেছিল বুকে নীলনভে উড়ে

মাতৃভাষায় সে শূন্যস্থান পূরণ করছিলাম

মনে পড়ছিল

হাসতে হাসতে জননী একদিন বলেছিল-

তোর ঠোঁটে যে যাদুকথা দিলাম

একদিন সেই শব্দ নিয়ে তুই বেঁচে থাকবি

আমার মায়ের মুখের ভাষা

যা নিয়ে অবিকল ঝড় বৃষ্টিতে এখনও বেঁচে আছি।



মনে ঠাঁই একুশের দিবসে


আমাদের সেই শস্য-শ্যামলা গোয়াল ধানের গাঁ

আমাদের সেই বাঁকা নদীটি পিদিম চাঁদের পাড়ে

আমাদের সেই বুকের কথা মায়ের ভাষাই জানত

ধর্ম ছিল না জাত ছিল না মানসকুটিরে লালন

যাপনে স্বপনে মরণেও তাই ভাষায় প্রতিপালন


তুমি রক্তিম সূর্য এঁকেছিলে

আমি রক্তিম জনপদে মাতৃবন্দনা করছিলাম শব্দে


বেয়নেটের এক-একটি খোঁচা মুক্তির গান গাইছিল

রাইফেলের আহত গুলি দেশ গড়ছিল ভাষায়

ঠোঁট নাড়তে চেয়েছিলাম

কন্ঠ উচ্চনাদে প্রতিরোধ চায়

ফ্যাকাশে আলোর চরাচরে এক উজ্জল রশ্মি

কথার বর্ণমালায় শব্দে- শব্দে

বিদীর্ণ করছিল ও-ধারের ভূ-খণ্ড


প্রিয়তমা তোমার উন্মুক্ত করতলে

আজ একশো একটা বাংলাচুমু

তোমার আলোকিত মুখে যে ভাষা উপচে পড়ছে

তা মুঠোয় ভরে বুকের দেরাজে নিলাম

কন্ঠে উগড়ে দেব


তরল তিমিরের পরে


তুমি বলেছিলে উৎসব হবে বড়,

আমি বলেছিলাম কবিতা হোক।

কোথায় কবিতা আর কোথায় উৎসব!

এভাবে মেলালে একটি নির্ভেজাল ছিদ্র

অন্ধকার ডেকে আনে,

কবিও আকন্ঠ মদ্যপানের পর

খিস্তি- খেউড় গাইতে থাকে,

তারপর দূর্দান্ত এক উৎসবের সূচনা হয়।


কবির গায়ে এখন ভুরভুরে

ক্ষমা নয় ক্ষমতার এসেন্স মাখা

হাতে নোটবন্দীর নোটেপাখি

চীৎকার করে বলছে--


উৎসব হবে। কবিতা নয়। ডিহি ভুবনডাঙ্গায়

পলাশবনীতে বার আর বারবিকিউ-তে

প্রমোদ উদ্যান সাজাব।

কবি ও কবিতার কবেই মৃত্যু হয়েছে

যেদিন থেকে পৃথিবীর ছিদ্র গলে গলে

কেবল তরল অন্ধকার চুঁইয়ে পড়ছিল।


এক আসমানে চাঁদ ওঠে। এক আসমানে কৃষ্ণপক্ষ।



 সজ্জ্বল দত্তের কবিতা  


বাল্মীকির কন্ঠহাড়


সিংহাসনে ওপরে-সামনে দশরথ-শত প্রজা 

                                       রাবণ-রাক্ষসকুল 

মাঝে হাওয়া শূন্যস্থান গুঁড়োলঙ্কা শ্রদ্ধাস্থান 

কাহিনীকন্ঠে তরল পারদ বাক্সবারুদ 

                                    দেশলাইকাঠি ভক্তি-

কঠোর সাধনা ভগীরথ 

শান্তি শান্ত সাধুসন্ত দেহমধ্যে পুণ্যভূমি 

                                     হরিদ্বার বারাণসী 

গনগনে ফারেনহাইট হোমযজ্ঞে একশো পাঁচ ।

আড়ালে জঙ্গলে রত্নাকর দস্যু ঠিক সে'সময় এলে

মহাদেব জটা থেকে একমুঠো চুল ছিঁড়ি 

                                       যজ্ঞআগুনে ফেলি 

মহাছন্দে ঋষিব্রহ্ম কবিগানে উজ্জ্বল 

অন্ধমুনিপুত্র একবাণে শব্দভেদ 

জল ছপছপ নদী 

নদ্যৌ....নদ্যা.... 

তারপর স্রোতকথা 

আমার কন্ঠ সেই জলের অনন্তস্রোতে 

                                         উৎস গ্লেসিয়ার 

সিন্ধু বা নীলনদ হরপ্পা মিশরীয় 

লঙ্কায় রঘুবংশে মহাকাব্য মহা কাব্যপথে....

ব্যাধ পাখি মা-নিষাদে একে একে কন্ঠহার 

সোনা থেকে প্ল্যাটিনাম হীরের ঝলক আলো....


সক্কালবেলা যত ধ্যাষ্টামো ভাট বকা ! 

পাড় ভেঙে গঙ্গায় গোটা গ্রাম ঘরবাড়ি 

এখন কোবতেবাজি ... নদ্যৌ নদ্যা ...! 


নদীপথ মোহনায় । 

সিন্ধুর ফেনাবিন্দু পরজন্মে পটোম্যাক 

আহা কালো ! নীল  নদ ! রঙেচঙে কত মুখ !

প্রথমের চুমু পেয়ে তৃতীয়র ক্ষ্যাপাছুট । 

এ' প্রান্তে সরযুধারায় আদি থেকে উত্তর 

সাতকাণ্ড রামগল্প 

সেই শুভ-অশুভ দ্বন্দ্ব আমার 

পুষ্পবৃষ্টি স্বর্গ বালি কাদা মাখামাখি 

ছোট বড় দেব দেবী কই গেল ভেসে ভেসে ? 

এল.ই.ডি সন্ধ্যে আলো লব কুশ খোলাপুঁথি 

পাতা ভরে ইতিহাস "সভ্যতা যুগে যুগে নদীমাতৃক"


এ গেঁড়ে গুডাসসেলে কুথাকার আদিকবি ? 

                                        নদীমাতৃক ? 

                             --শালা রুটিমাতৃক !




 কবি নিলয় নন্দীর কবিতা 


ভাষাসমগ্র

নিলয় নন্দী


১ 

এইসব মল ক্যাফেটেরিয়া ছেড়ে আলপথে নেমে পড়ি। দুদিকে কড়াইশুঁটির ক্ষেত। ঝুরোমাটি মেখে থাকা ব্যঞ্জনস্বর। ওষ্ঠে রাখি 'ও', তালুতে 'শ'। তুমি 'ওই' বলে ডাকো। বা গভীর তাকালে 'ইশ'। কি অবলীলায় সম্বোধন জুড়ে নাও। নাম ধরে ডাকতেই পারো। এখন ডাকতে নেই বলে আঁচল বিছিয়ে দিলে দিগন্ত জুড়ে। চোখে সরষেফুল দেখি। হৃদয়ে বর্ণপরিচয়। ভালবাসার উঠোনজুড়ে এখনো কেবল খাগের কলম কালির দোয়াত। 


২ 

এসো ফেব্রুয়ারি। মাঘ বলে চিনিনি কখনো। আমার ফেসবুক পেজ এখনো হ্যাকড হয়ে আছে। রাতবিরেতে ইনবক্সে চুমু ছুঁড়ে দিলে আমি বলি, যাবে শহীদ স্মরণে? বোকা বোকা হাসি বা বাংলা খিস্তি শুনে ঘুমিয়েও পড়ি। স্বপ্নে সাজাই ফুল বাহারি পলাশ। সেইসব লাল পাড় মেয়ে দলবেঁধে আসে ফেসবুকে। উইকিপিডিয়া খোঁজে রক্তছাপ প্রোফাইল ছবি। হাইহ্যালো ভেসে এলে আমিও নিরুপায় পাতা উল্টাই বাংলা কবিতার... 


আমাদের ঘষামাজা শেষ। মুছে দিই বাড়তি রফলা, যফলা, রেফ। এখন অভিধান লেখে লাঙলের ফলা। নির্বাচনী বীজ। জোয়ারের রুটি আর স্লেট পেন্সিল, খিদে পেলে অমনিই খাই। পতাকা বদল হলে বদলে যায় পাঠ্যক্রম। সেইসব শিশু পাঠশালা ধুলোমাটি বেঞ্চ তেষ্টাচিত্র এখন দিবস খোঁজে, ভাষার নোঙর। আমি চিরকেলে বোবা, ভাষাটাও ভাসাভাসা বুঝি।


বাদামী বাকল চেঁছে অক্ষরে সার দিই আপাদমস্তক 


৪  

কাঁটাতার পেরোলে বদলে যায় নদীর নাম। বদলে যায় উত্তরপুরুষ। অছিমুদ্দি মিঞার পাঠশালায় পড়ে না বর্ণমালা। আসে জগাইমাধাই।  বিলিতি রাংতা দিশি কলাপাতা, স্থিরতা গুঁড়িয়ে যায়। সরলতম জীবন হেঁটে যায় অক্ষরের বিপরীতে। তোমাকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছি নেইপাখি। তোমাকে নিয়ে পুড়ে যাচ্ছি ভাষাসমগ্র। আঁচলে আশীর্বাদি ধান, মা ডাকেন... পায়রা উড়ে এসে খুঁটে খায় অ আ ক খ। ফেরে কথাকলি ঝুরিবট, ফেরে বেনটেন শ্লেট পেনসিল। শহরের স্কুল থেকে বর্ণমালা ফেরেনি এখনো...


পুনর্জন্ম পেলে সেও বুঝি ফিরে পাবে একুশের দেশ



শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

শাশ্বতী চ্যাটার্জির দুটি কবিতা  



★  আশৈশব

          

এক ফোঁটা মাটির কুমকুম

একচালা প্রতিমা গড়ন

ধুলোয় অসুখ নেই

হাসি অশ্রু এক ছাঁচে ঢেলে রুখু বুক নদীমাতৃক

ভেজা হাতে পিঁড়ি পাতে দুপুরের নারী

মহুল পরাগে নেশা জোনাকি জাগর


একটাই তো মগ্ন একতারা

আউল-বাউলে সুর কেঁদুলির মেলা

মেলা হয়ে ভরা মাসে ভাসান আখর

জংলা পুকুরপাড়ে ক্ষারকাচা ধাপ

সমভূমি হৃদয়েতে স্বপ্নের টিলা...


সাকুল্যের পাঠশালা, 

চোর চোর, আব্বুলিশ, কানামাছি খোঁজ...


একটাই  তো সেলেট পেনসিল!

আঙুল বুলিয়ে ফোটে অ আ ক খ নামের স্বদেশ।


★  স্বাদ 

   

বলা কথায় টান আছে

টেনে আনে, নিয়েও যায়

ঘুমপাড়ানি, নকশীকাঁথা, গাজনের ছক

দৈত্যের কেটলি থেকে জিয়ন কাঠি

কথার সাঁকোর বশে ভোর থেকে চোপর দিন পারাপার করি

মাছরাঙা, প্রজাপতি, গবাদি সংসার 

এইসব গাছ নদী পাখি-জন্ম 

যুক্তাক্ষর ভেঙে জীবন উপায় করে

মুগ্ধবোধ ব্যাকরণে ব্যস্ত বইঘর...


ভেজা মাটি আঙুলে কপালে 

আশ্বাসে আভাসে শুধু মায়ের স্বভাব।

জিভে লেগে থাকা জন্মদিনের স্বাদ

সামান্য জীবনের ভয়ে 

ফেরাব কি ক'রে!?




সোমা কুসারীর গল্প 


 

বাইল্যাঙ্গুয়াল

সোমা কুশারী 


"আমাগো দ্যাশের বাড়ি আছিল ঢাকায়। ঐ যে ঢাকার কাছেই পীরপুর ঐ আমাগো দ্যাশ।"
বিরক্তিতে শুভ্রার চোখ কুঁচকে গেল - 

-দূর! বাবা যে কী করে না! লোকটার যদি কোনো সেন্স থাকে! বিরক্তি লুকিয়ে হাসিমুখে বাবাকে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিয়ে বলল-

-বাপি! খেতে বসবে না? চলো এই ব্যাচে বসবে চলো।
মেয়েকে হাত নেড়ে বারন করেই শুভেন্দু আবার শুরু করলেন-

-জানেন, আমার জন্ম অবশ্য অ্যাই দ্যাশে, তবে মায়ে কয় দাদা আর দিদি ঐ দ্যাশেই...
সুবোধবাবু, সম্পর্কে শুভ্রার মামাশ্বশুর মস্ত কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিটিমিটি হাসছেন আর শুভেন্দুকে মন দিয়ে লক্ষ্য করছেন দেখেই শুভ্রা আবার বাবাকে ঠেলল, বাপি চলো না খেয়ে নেবে, বেশ বেলা হয়ে গেছে। তোমার তো শরীরটা ভালো নয় খেয়ে উঠে না হয়...
শুভেন্দু শেষ করতে দিলেন না মেয়েকে, সুবোধের দিকে তাকিয়ে বললেন-
-তর বড্ড বেশি চিন্তা! এই বয়সে আর শরীল কত ভালো থাইকবে কন?

শুভ্রা বিরক্তি গিলে একগাল হেসে বললো, আরে মেজমামা তো আর কালই স্টেটসে ফিরে যাচ্ছেন না! তুমি না হয় আর একদিন...
-কী যে বলস! ওর লগে আবার কন্ দিন দেখা হইবো ঠিক আসে? 
শুভ্রার গাল দুটো অপমানে লাল হয়ে যায়, বাবা যে কেন নিজেকে এত ছোটো করে বুঝতে পারে না শুভ্রা, একে তো ওর শ্বশুরবাড়ীর সবাই ভীষন স্ট্যাটাস কনশাস তাই মেশামেশির লেভেলটাও যথেষ্ট হাইফাই, আর তার মাঝে অস্বীকার করে তো লাভ নেই সেই বেশ একটু কমাগোছের, একে তার বাবার অতি সাধারণ মুদিরদোকান আর নিজে সে একেবারে পাতি বাংলায় অনার্স! নেহাত প্রেমপর্বে শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ার শ্রীজীব ওসব বিষয়ে একটুও গুরুত্ব দেয়নি শুধু ওর রংরূপেই মজেছিলো তাই এত ভালো একটা ফ্যামিলিতে বিয়েটা হয়ে গেছে। না হলে? যাক্ গে পুরোনো কাসুন্দি যত কম ঘাঁটা যায় ততই ভালো। 

ঘর ভর্তি একগাদা লোকের মাঝে বাবার এই বেমক্কা আচরণে শুভ্রার হঠাৎ কেমন একটা চোরা অস্বস্তি হতে থাকে, অবশ্য সেসব কাউকে বুঝতে না দিয়ে দ্রুত দামী সিগ্রীন কাঞ্জীভরমের গোল্ডেন আঁচলটা বিশেষ কায়দায় গুছিয়ে নিয়ে ভীষন আন্তরিক একটা মুখ করে সোফায় বসা দুই মামী শাশুড়ি ননদ আর ছোটো জাকে কিছু একটা নিয়ে নিচু গলায় ফিসফিস করতে দেখে মিষ্টি করে বলে ওঠে-
তোমরাও কী পরের ব্যাচে বসবে পর্না? মাইমা আপনারা?
ছোটোমামি চওড়া হাসি ছড়িয়ে বলেন,
আমাদের নিয়ে একদম ভেবো না শুভ্রা, বেয়াইমশাইয়ের বাঙাল ডায়লেক্ট দারুন এনজয় করছি আমরা!

শুভ্রার মুখের যাবতীয় আলো যেন কেউ এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিলো, শুভ্রা দাঁতে দাঁত ঘসে মনে মনে বলে ওঠে , তা আর জানি না! এই মজলিশে যদি আবার মিসেস চৌধুরী এসে ভেড়েন তবে আর দেখতে হবে না! শুভ্রার মনের কথাই বোধহয় ওর শাশুড়িমা মানে মিসেস এনাক্ষী চৌধুরী শুনতে পেয়েছিলেন তাই তিনিও টুক করে এসে বসলেন দুই ভাই বৌ আর কনভেন্ট শিক্ষিতা আদরের ছোটো বৌ এর পাশে। মা-ও যে ঠিক এসময় কোথায় গেল!শুভ্রার এখন একমাত্র লক্ষ্য মাকে এই ভিড়ে খুঁজে বার করা। 

শুভ্রার সন্ধানী চোখ বসার ঘর পেরিয়ে দু দুটো সুসজ্জিত ঘর আর একরাশ লোকের মাঝ থেকে যখন আটপৌরে শাড়ী পরা সন্ধ্যাকে আবিস্কার করলো সন্ধ্যা তখন বিগলিত হয়ে শ্রীজীবের বন্ধুদের দৈয়ের ঘোল খাওয়াতে ব্যস্ত। রাগে শুভ্রার ব্রম্ভ্রতালু পর্যন্ত জ্বলে গেল,

- - এরা কী পেয়েছে তাকে? এই বালিগঞ্জের কোটিটাকার ফ্লাটে এসেও কী এরা শুধরোবে না? একজন এটিকেট ফেটিকেটে গুলি মেরে সোফায় পা তুলে বসে "দ্যাশের" বাড়ির ভাষার ক্লাস নিচ্ছেন অন্যজন দু-দুজন মেড সার্ভেন্ট থাকতেও দৈয়ের হাড়ি চেঁছে ঘোল বানাচ্ছেন! রিডিক্যুলাস্! সন্ধ্যা মেয়েকে দেখেই আনন্দে মেতে উঠে বললেন-
-মনা! মন্ রে! এট্টু ঘোল খা না মা! সকাল থেকে কী খাটনিটাই না যাচ্ছে।
সন্ধ্যার কথায় পাত্তা না দিয়ে শুভ্রা মাকে টেনে নিয়ে গেল এক সাইডে, তারপর হিসহিসে গলায় বলল,

কী চাও তোমরা? জামাইয়ের সম্মানটাও রাখবে না? একজন বসে বসে বাঙাল ভাষা শোনাচ্ছে আর তুমি? ঘোল বানাচ্ছ? যাও ঐ লোকটাকে নিয়ে খেতে বসো। আর আমার মাথা খেও না! ছিঃ! ছিঃ! ভাবা যায আমার ছোটমামাশ্বশুরের সামনে বাপি ঐভাবে বসে বাঙাল ভাষা শোনাচ্ছে? জানো উনি কতবড় মানুষ? ইংরেজী ছাড়া এরা নিজেদের মধ্যে পর্যন্ত কথা বলে না আমি-ই বাধ্য হয়ে স্পোকেন ইংলিশের কোর্স করলাম বিয়ের পর না হলে শ্রীজীবের মাথা কাটা যাচ্ছিল সেখানে তোমরা? ছিঃ! ছিঃ!

সন্ধ্যার মুখটা অপমানে মুহূর্তের মধ্যে কালো হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল সত্যিই তিনি আর তার স্বামী এই পরিবেশে কতটা বেমানান! দুই এর এক রমেশ মন্ডল রোডের একফালি ভাড়া বাড়ি আর সামনের রোয়াকে শুভেন্দুর মুদিদোকান। নেহাৎ, মেয়ের রুপে ধরা দিলো এত বড়লোক বাড়ির ইঞ্জিনিয়ার ছেলে না হলে এসব অনুষ্ঠানে তাদের আসার সত্যিই কথা নয়। নিজের ছেলেও এই এককারণে দিদির গৃহপ্রবেশে আসতে চায়নি, বলেছে-

আর্যবিদ্যাপিঠের ছাত্র এই শুভ্রাংশু দত্ত ঐ বড়লোক বাড়ি গিয়ে মরবে নাকি মা? দেখ না, আমার ক্লাস টুয়ের ভাগ্নেকে পর্যন্ত আমি ঐ ইংরেজীর জন্য সমঝে চলি আর ও বাড়িতে তো সব ইংরেজির এক একজন জাহাজ ঐদিয়েই ওরা লোকজনকে মাপে আর আমি ওর মধ্যে গিয়ে নিজের খিল্লি ওড়াবো?

সন্ধ্যার চোখ ফেটে জল আসছিলো, কেন যে ছেলেটার কথা শুনলেন না তখন, অবশ্য জামাইয়ের অনুরোধেই আসা নইলে এই ন- বছরে মেয়ের বাড়ি গুনে গুনে কবার এসেছেন বলতে পারবেন। শ্রীজীব-ই জোর দিয়ে বললো,
আপনার মেয়ের নিজস্ব ফ্লাট হলো আর আপনারা যাবেন না?
শুভেন্দু তো একপায়ে খাঁড়া বললেন,

-এ্যই দ্যাশে মাইয়াটা অন্তত একখান নিজের বাড়ি করল। আমাগো তো সব ভাড়া। যাবো নিচ্চয় যাবো।

সন্ধ্যা কী তখন মেয়ের মনোভাব বোঝেননি? বুঝেছিলেন অবশ্যই। সে তো শ্রীজীবের সাথে বিয়ে হওয়া ইস্তক দেখছেন মেয়ে তার বদলে গেছে, অতটুকু ছোট্ট ছ'বছরের নাতিটাকে পর্যন্ত মামাবাড়ি আনতে চায়না ওর নাকি ভাষার সমস্যা হবে। স্কুল থেকে নাকি পই পই করে বলে দেওয়া আছে বাচ্ছার সামনে বাড়ির লোকেরা সবসময় ইংরেজিতে কথা বলবে তবেই নাকি ছেলে ঠিকঠাক ইংরেজিতে কথা বলতে শিখবে। মুদিদোকানী দাদু আর মামা তো সেসব মোটেই পারে না দিদার কথাও তথৈবচ! উল্টে দাদুর ঐ বাঙাল ভাষার দু চারটে লব্জ শিখলে তো চিত্তির।সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি স্বামীকে নিরস্ত করতে ছুটলেন, শ্রীজীবের বন্ধুদের গলা পেলেন---

- আরে মাসিমা! ঘোল আর পাওয়া যাবেনা নাকি? কোথায় পালাচ্ছেন আপনি?
শুভ্রার গলাও পেলেন--
আরে! আপনাদের মিতাদি আর তুলি দেবে ঘোল বানিয়ে। চিন্তা কিসের?

-বাট দ্য টেস্ট অফ্ মাসিমা'স বাটারমিল্ক ইস সো ইয়ামম্-ই...

জামায়ের বন্ধুদের সমবেত হুল্লোর কানে আসতে লাগল সন্ধ্যার। মনে মনে ভাবলেন ঐভাবে আগ বাড়িয়ে দৈয়ের ঘোল করতে যাওয়া কী ভুল হলো? মনা নিশ্চয়ই রাগ করেছে। যতই পেটের মেয়ে হোক মস্ত বড়লোক আর ইংরেজি আদবকায়দা ওলা শিক্ষিত পরিবারে বিয়ে হবার পর থেকেই মেয়েটা যে আগের মতো নেই হাড়ে হাড়ে টের পান। মাসে এক দুবার গাড়ি হাঁকিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়া আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের পয়সার আর সম্মানের গল্প করে যে মেয়েটা তার সাথে সেই ভিতু মৃদুভাষী নিজের অতি সাধারণ মেয়েটাকে খুঁজে পাননা বহুদিন। খুব কষ্ট হয়, মেয়ের বাবা অবশ্য ওসব বোঝে না পূজোয় মেয়ের দেওয়া দামী পান্ট শার্টের পিস আর কারণে অকারণে দেওয়া এটা সেটায় একেবারে মুগ্ধ হয়ে যায়। আর এ নিয়েই ছেলের সাথে বেঁধে যায় লড়াই... শুভ যত বলে

-তুমি অমন করে পাড়ার সব্বাইকে দিদির বাড়ির পয়সার গল্প শোনাও কেন বুঝিনা ভেবেছো? তোমার নাতি যে বাড়িতেও ফট্ ফট্ করে ইংরেজি বলে এতে অত আহ্লাদে গলে পড়ে সক্কলকে বলে বেড়ানোরই বা কী আছে?
শুভেন্দু তত রেগে ওঠেন--

-কবো না? ক্যান? তগো ভয়ে? ইংরেজি রাজার ভাষা বোঝলি? অতটুক্ পোলাপান ফরফর কইরা কইতে পারে শুনাবো না লোগরে? হিংসুট্টা একখান! 



শুভেন্দুকে বড় হলঘরটাতে সোফায় আসীন দেখতে পেলেন সন্ধ্যা, দেখলেন স্বামী মনের সুখে একখানা গান শোনাচ্ছেন বেয়াই বেয়ানদের, শুভেন্দুর ঐ বাঙাল উচ্চারণ আর চোখ বুজে বিচিত্র মুখভঙ্গি দেখে উপস্থিত সক্কলের মুখে কৌতুক খেলে বেড়াচ্ছে লক্ষ্য করলেন সন্ধ্যা, শ্রীজীবের বন্ধুর স্ত্রীরা কয়েকজন অফিস কলিগ আর নাতির বন্ধুদেরর মা বাবারাও রয়েছে সে ভিড়ে। 

শুভ্রার শাশুড়ি আর মামিশাশুড়িদের মুখে তো স্পষ্ট হাসির ছাপ, দুই ননদ আর জাও মুখ টিপে হাসছে। অথচ, ছোটোমামাশ্বশুর ভদ্রলোক মন দিয়ে গান শুনছেন, আর শুভেন্দু গলা তুলে গাইছেন...

-"অ সুখের ময়না রে...ক্যামনে রাখি জীবন!" 

সন্ধ্যা! অসহায় মুখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন...

-কী হছ্ছে এসব? কী শুরু করলে তুমি?

শুভেন্দু স্ত্রীকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন--আরে চুপ যাও তো! শোনো না গানখান! আরে আব্বাসুদ্দিনের গান... 

সন্ধ্যা, বিরক্তিমেশানো গলায় বেশ জোরেই বলে উঠলেন---
-না! ওঠো তুমি! খেতে চলো!

শুভেন্দু থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন, গিন্নির স্বভাববিরুদ্ধ গলার জোরে কিছু একটা আঁচ করে বললেন 
-ও! আইচ্ছা! আইচ্ছা! চলো!

শুভেন্দুকে উঠতে দেখে শুভ্রার শাশুড়িমা হাঁ হাঁ করে উঠলেন,

-বেয়াইমশাই! উঠলে হবে? আপনিই তো আজ সেন্টার অফ্ এ্যাটারকশান! ভানু ব্যানার্জীর কমিক শো এত তাড়াতাড়ি শেষ করলে হবে? উই আর অল এনজয়িং এ্য লট্।
সন্ধ্যার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে যেতে শুভেন্দু কিন্তু সত্যিই এবার সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন। আর ঠিক তখনই শুভ্রার ছ'বছরের ছেলে আরিয়ান বলে উঠল

-- গ্রানু আর ইউ এ ঘুসপেটি?ফর দিস হোল টাইম ইন হুইচ লাঙ্গুয়েজ ডু ইউ স্পিকিং ইন?এন্ড্য দ্য হরিবোল সঙ্গ.. 

সন্ধ্যার মুখ তুলে তাকাতে লজ্জা করছে, শুভেন্দু নির্বাক শুভ্রা আর শ্রীজীব ও যে কী করবে ঠিক করতে পারছে না... এত লোক! এত নিমন্ত্রিত! আর এর মাঝে...

- না দাদুভাই! তোমার দাদু ওসব ঘুসপেটি টেটি কিচ্ছু নয় গো! তোমার দাদু হলেন একজন খাঁটি মানুষ। আর যে ভাষাটায় উনি এতক্ষণ আমাদের এতকিছু শোনাচ্ছিলেন ওইটেই আমাদের সকলের মায়ের ভাষা! প্রাণের ভাষাও বটে! শুধু আমরা ওঁর মতো মাকে মনের কোনে ধরে রাখতে পারিনি, বুঝলে! 

আরিয়ানের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে শুভ্রার মামাশ্বশুরের বলা কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই পুরো হলঘর জুড়ে কেন যে শ্মশানের নিরবতা নেমে এলো একমাত্র শুভেন্দুই কিছুতেই তা ঠাওর করতে পারলেন না! 





 

সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ভাষা দিবস সংখ্যা

 


আমার একুশে, অনুভবে

[] জগন্ময় মজুমদার 


আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের মফস্বল শহরে সম্ভবত তার আগের বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রথম কলেজ। না, কলেজ নয়, মহাবিদ্যালয়। একই তো, তবু কলেজ বলতে নারাজ কেন, কেন মহাবিদ্যালয় বলবার এতটা আকুতি? তখন ঠিক বুঝিনি। কেন কথার লবজে কলেজ বললে, জিভ কেটে মহাবিদ্যালয় বলতে হয়। প্রশ্নটা ভিতরে ভিতরে বুদবুদ হয়ে আবার কখন ভিতরেই কেটে গেছে। কিন্তু কদিন পরেই সেই বুদবুদ যে এমনভাবে আবার ভেসে উঠবে আমাদের সেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর প্রান্তিক মফস্বলের ছোট্ট শহরের সরোবরে কে জানত! একদম হৈ হৈ ব্যাপার, মহাবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে শহীদ দিবস পালিত হবে। সেই উপলক্ষে হতে চলেছে এক বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রভাতফেরি দিয়ে শুরু। সারাদিন তারপর বিভিন্ন আলোচনা সভা, বিশিষ্ট বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব যদিও অধিকাংশরাই স্হানীয়, তাঁরা বলবেন। আছে রবীন্দ্র নজরুল সুকান্ত ছাড়াও দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান। আছে আবৃত্তি। অবশ্যি ততদিনে,'আমার ভাই -এর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি', কবি আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত গানটি আমাদের মুখে মুখে ফিরছে। যদিও গানটি আমার কাছে আরো একটি গানের মতোই, এর অন্তর্লীন তাৎপর্য এবং কার্যকারণ, ইতিহাস, সত্যি বলতে তখন পর্যন্ত কিছুই তেমনভাবে জানা ছিল না। বড়োরা গান, আমিও গাই। শহীদ দিবস আবার কী! শহীদ শব্দের অর্থও তেমন বোধগম্য ছিল না। কিন্তু জানতে কতক্ষণ। বিশেষ করে যখন আমার ছোড়দিভাই ঐ মহাবিদ্যালয়ের-ই একজন। ও তখন প্রথমবর্ষ। মানবিক বিভাগের ছাত্রী। অনুষ্ঠানে গান গাইবে - জোর মহড়া চলছে - ঘরে ও বাইরে একা এবং সমবেতভাবে। দেয়াল লেখন এবং পোষ্টারে তখন লালমণিরহাট (বর্তমানে জেলা শহর) আমার জন্মশহর, ইতিমধ্যে লালে লাল হয়ে গেছে। আর যেহেতু আমার পাড়াতেই মহাবিদ্যালয়ের অবস্থান তাই যে কোনো রকম কোলাহলের কল্লোল সহজেই আছড়ে পড়ে আমাদের ঘরের দুয়ারে খুব দ্রুত। ছোড়দি গান গাইবে, বক্তৃতাও না কি দেবে, একটা খসড়া লিখে (মা-বাবার সাহায্যে) আয়নার সামনে হাত নেড়ে তর্জনী উঁচিয়ে সে কি প্রবল উত্তেজনা! যেন স্বয়ং শহীদ রফিক বা জব্বরের মা বা বোন। 

    পিঠোপিঠি ভাইবোন হলে যা হয়। একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা হয়ত আমার সঙ্গে ওর ছিলো। সত্যি কথা বলতে কি একটা অবচেতন সবুজ ঈর্ষা।ইতিমধ্যে জেনেছি আমার জন্মের আগে ঘটে যাওয়া বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম এবং সৌরকরোজ্জল গৌরবের গাথা যা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটে গেছে। ঢাকার রাজপথ সালাম রফিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা চাওয়ার ন্যায্য দাবীতে। তৎকালীন শাসক পাকিস্তান সরকার যা কখনো চায়নি  বরং উল্টে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল Urdu, only urdu shall be the state language - এমনতর বৈমাত্রেয় ভাষ্য। বাঙালি মানবে কেন, মানেওনি,তারুণ্যের মূল ভাষা যদি হয় অস্বীকারের ভাষা, তবে ছাত্র ও যুবসমাজ স্বাভাবিক প্রবণতা থেকেই গর্জে উঠেছিলো এবং তারই পরিণতিতে এই আত্মবলিদান। আমারও ভিতরটা টগবগ করে ওঠে। আমার ছোট্ট হৃদপিণ্ড হঠাৎ যেন বড়ো হয়ে গেল।লিখে ফেলি চরম আবেগে এক দীর্ঘ কবিতা।

লিখেই মা দিদিদের পড়ে শোনাই। ছোড়দিভাই বলল, এখনো মনে পড়ে : চল্ তোকে আমাদের বাংলার স্যারের কাছে নিয়ে যাই।
:কেন?
:যদি স্যার অনুমতি দেন,কবিতাটা তুই শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে পড়বি।
কি জানি কেন আমার কোনো ভয় ডর ছিল না। সদ্য সদ্য 'পাছে লোকে কিছু বলে'- কামিনী রায় পড়েছি।তাছাড়া ছোড়দিভাই যখন আছে আমার আর ভয় কি! সিরাজুল স্যারকে কবিতা দেখালাম। উনি চমকে উঠলেন না, হাসলেন না, কেবল বললেন: তুমি কী এটা নিজে লিখেছো না কেউ সাহায্য করেছে? তাঁর চোখে বিশদ সন্দেহ। আমি অকুতোভয়। বলি: না না আমিই লিখেছি। 
:এই কি প্রথম লিখলে? 
:না,
:তোমার লেখা যদি আরো থাকে দেখাতে পারবে?
:পারবো
:তাহলে ওগুলো নিয়ে তুমি আমার বাসায় কালকে এসো।

যাই। তখন দুপুর। টিনের চালের ঘর। উত্তর বঙ্গের শীত তখনও যায়নি। বাতাবি লেবুফুলের গন্ধের মতো মেদুর আবহ। উনি আমার কয়েকটি ছড়া কবিতা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন এবং আগামী একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে পড়বার অনুমতি দিলেন। 




    সেই আমার প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি - দেখা ও শোনা অতিক্রম করে মরমে প্রবেশ। অনুভব তখনও উপলব্ধির স্তরে যেতে পারেনি। ভাষা নিয়ে ভাসা ভাসা ভালোবাসা। মুখের ভাষা আবার কেউ কেড়ে নিতে পারে না কি? এও কী সম্ভব? ভাষা তো জল হাওয়া মাটি ও মায়ের মতো, প্রকৃতির মতো ওতপ্রোত। রক্ত থেকে জল যেমন আলাদা করা যায় না - চোখ আর চোখের মণি, হাত আর আঙুল, মাথা ও চুলের মতো স্বতঃস্ফূর্ত মা এবং মায়ের দুধ। না,ওই বয়সে এতকিছু ভাবিনি। বরং বিদ্যালয় শুরুর আগে জাতীয় সংগীত গেয়েছি- পাক সার জমিন সাদ বাদ, কিশওয়ারে...ওটাও তো নিছক এক গান।অর্থ বুঝি না। ওটি যে উর্দু ভাষার গান - আমি তো বাঙালি কেন গাইব এমন বোধও ছিলো না। উর্দু ক্লাসও করেছি মৌলভী স্যারের কাছে। কিছুদিন সংস্কৃতও শিখেছি ধর্মক্লাসে পন্ডিত স্যারের কাছে। ইংরেজি তো ছিলই। সত্যি বলতে ভাষা নিয়ে কোনো ছুৎমার্গ ছিল না। ওই বয়সে থাকার কথাও নয়।

   ইতিমধ্যে বড়ো হয়েছি কিছুটা বয়সে, জ্ঞানে নয়।বইটই পড়ি যখন যা পাই। এমন কি রান্নাঘরে পড়ে থাকা ঠোঙ্গাটাও বাদ যায় না, যে অভ্যাস পেয়েছি আমি আমার মায়ের কাছ থেকে। তখন তো টিভি বা ফোন ছিল না। রেডিও একটা ছিল বটে। বিশেষ সময় ছাড়া বাজানো হত না। তাও সেটি বড়োদের মর্জিতে চলত- একটু অনুরোধের আসর, খবরটবর এবং নাটক টাটক (তাও সেটি যখন শুরু হোত, ঘুমিয়ে পড়তাম) অবশ্যি ক্রিকেট রিলে শোনার সময় কেউ বাধা দিত না। শুনতাম মাঝে মধ্যে অ্যামেরিকার বাংলা অনুষ্ঠান VOA অর্থাৎ ভয়েস অব অ্যমেরিকা থেকে। মনে মনে কেন জানি উল্লসিত হয়ে উঠতাম, সুদূর অ্যামেরিকা থেকে বাংলায় কথা বলছে কোনো বাঙালি মানুষ? কি এক অদৃশ্য আবেগ-স্পর্শে ভিতরে জেগে উঠত। হয়ত অবচেতনে বাঙালি জাতি সত্তার বোধ!ইতিমধ্যে সিপাহী বিদ্রোহ, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত বা বলিভিয়ার, চিন বা চিলির - সামান্য হোলেও পড়ে ফেলেছি। গ্যারিবল্ডি, মাৎসিনি, আইরিশ বিপ্লবী ডি-ভ্যালেরা, মাও সে তুং এর লং মার্চ, চিনের আফিম যুদ্ধ, সমুদ্র বধূ ইংল্যান্ডের নেলসনের নৌবাহিনীর কাহিনি, স্প্যানিশ ফ্রাঙ্কো সরকারের কথা, জারের অত্যাচার, রুশ বিপ্লব, দুটো বিশ্বযুদ্ধ তো আমাদের ইতিহাসের সিলেবাসেই আছে... পড়ি আর ভাবি। এবং অবাক হই, পৃথিবীর কোথাও তো এমন একটা যুদ্ধ কিংবা আন্দোলন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য হয়নি? অবশ্যই বাঙালি এক্ষেত্রে অনন্য উজ্জ্বল এক ব্যাতিক্রম। 'রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি'- এমন আক্ষেপ রবিঠাকুর যদি ১৯৫২ পর্যন্ত জীবিত থাকতেন নিশ্চয়ই ফিরিয়ে নিতেন তাঁর কথা।

উচ্চমাধ্যমিকের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার যুগপৎ সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য হোল। কেন না কদিন মাত্র ক্লাস করতে না করতে বেজে গেল যুদ্ধের দামামা – বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ। 

    অভিশপ্ত ১৯৭১। ২৫ শে মার্চ। বৃহস্পতিবার। রাত্রি। ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যালীলা ঘটে গেল বাংলার বুকে, রাজধানী ঢাকায়। সেই রাতে পাকবাহিনীর আক্রমণে তিরিশ হাজার বাঙালির মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে সূচনা হোল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। পরবর্তী নয় মাস অর্থাৎ ১৬ ই ডিসেম্বর অব্দি অর্থাৎ যতদিন না পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধার সহায়ক ভারতীয় বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ অরোরার-র কাছে আত্মসমর্পণ করে। আসলে এই সংগ্রামের মূল দাহিকা-শক্তি ছিল তথাকথিত ধর্ম নয়, হিন্দু কি মুসলিম – বাঙালির তীব্র দেশপ্রেম ও জাতীয়তা বোধ। অবশ্যই লঘু কোনো দেশপ্রেম নয়, যার প্রেরণার উৎসে আছে এক ভাষাচেতনা।ভালোবাসার ভাষা– আমরি বাংলাভাষা। 

     বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ভারতে দীর্ঘ শরণার্থী জীবন কাটিয়ে আমি আবার ফিরে আসি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিমধ্যে পুড়ে গেছে বহু কাঠখড়, অনেক মায়ের চোখের জল শুকিয়ে গেছে, অনেক বোনের ইজ্জত লুট হয়ে গেছে, সন্তানহারা অনেক পিতা অন্ধ হয়ে গেছে। না থাক,সে ইতিহাস সবারই জানা। থাকি আমি জগন্নাথ হলে। তখনও জগন্নাথ হলের বিভিন্ন ঘরের দেওয়ালে গুলির দাগ,রক্তের ছিটে, ক্যান্টিনে পোড়া দাগ।
    
    এর ভেতরেই এসে গেল ফেব্রুয়ারী মাস। একজন বাংলাদেশির চোখে ফেব্রুয়ারী মানেই মাতৃভাষার মাস– শহীদের মাস। এ মাসের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন। আলোচনাচক্র, সেমিনার, দেশাত্মবোধক গানের মহড়া। পথনাটিকা– তার উচ্চকিত উল্লাসধ্বনি। কেউ লিখছে গীতি-আলেখ্য তো কেউ লিখছে শ্রুতিনাটক। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, আমিও একটা লিখেছিলাম, আমাদের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা পরম প্রযত্নে পরিবেশন করেছিল – 'আজ ধান বুনবার দিন'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রমহল চিরকাল-ই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও আছে বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যালের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা।

 দেখতে দেখতে এসে গেল একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাত। ঢাকা মেডিক্যালের সামনে যে বিখ্যাত শহীদ মিনার আছে সেখান থেকে শুরু করে আজিমপুরের কবরস্থান পর্যন্ত দীর্ঘ পিচ রাস্তায় আল্পনা দিতে দিতে চলেছে ঢাকা চারুকারুকলা মহাবিদ্যালয়ের নবীন নবীনা শিল্পীসকল। সে কি উত্তেজনা। সে কি উন্মাদনা। লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে অগণিত মানুষ তখন তাদের সঙ্গী। এই অধম, আমিও। সারা রাত জেগে থাকে ঢাকা শহর। রাস্তার পাশের গাছপালা, বাড়িঘর অন্ধকার কি জানে না।চারিপাশে আলোর ফোয়ারা। কখন এভাবে লাল হয়ে আসে ভোর। যেন শীতের প্রার্থনার অবসানে তেজদীপ্ত বসন্তের উত্তর। হাজারো হাজারো মানুষ, কাতারে কাতারে মানুষ, মানুষের ঢল নামে, শহীদ বেদিতে কে আগে দেবে ফুলের অঞ্জলি। উত্তর থেকে দক্ষিণ থেকে পূর্ব থেকে পশ্চিম থেকে আসছে মানুষ, মিছিলের হাতে প্ল্যাকার্ড,কারো হাতে বাংলাদেশের সবুজ পটভূমিতে লাল সূর্যপতাকা,কারো জামায় আঁকা রবিঠাকুরের গানের কলি,কারো বা নজরুল। ওইতো বুলবুল ললিতকলা অ্যাকাডেমি থেকে একদল শিল্পী এলেন, ওই তো ছায়ানট, ওই তো হিন্দোল। সব যেন গানে গানে সুরে সুরে একাকার। সাদা শাড়ি কালো পাড় একদল এগিয়ে আসছে  রোকেয়া হল থেকে, একদল আসছে  শামসুন্নাহার হল থেকে – আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কী ভুলিতে পারি – গাইতে গাইতে গান। শোক হয়ত এভাবেই একদিন শ্লোক হয় যদি সে শোক সমবেত শোক হয়– মহৎ কোনো আবেগের উৎসার। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মদান সে তো লঘু পালকতুল্য মৃত্যু মাত্র নয়। পর্বতচূড়ার মতো উঁচু তার মৃত্যুঞ্জয় উদ্ভাস।

   একটা কথা আছে যেখানে তিনজন গুজরাটি থাকে,তারা এক সঙ্গে হলে একটা ব্যবসা খোলার কথা ভাবে। যেখানে তিনজন ফরাসী থাকে তারা একসঙ্গে কোথাও না কোথাও সপ্তাহান্তে ঘুরে আসার পরিকল্পনা করে। ঠিক সেরকম যেখানে তিনজন  বাংলাদেশি তরুণ তরুণী থাকে, তারা ভাবে একটা ছোটো সাহিত্য পত্রিকা কিভাবে বের করা যায়।বাঙালির রক্তের ভিতরে আছে এই শিল্পতৃষ্ণা।কবিতা-প্রাণ বাঙালি, সুতরাং সামনে একুশে ফেব্রুয়ারি আসছে অথচ তাদের সংস্থা বা সংঘ থেকে একটা পত্রিকা বের হবে না, মানা যায় না।সেটির নাম ' জাগৃতি ' সংঘ হতে পারে, 'বর্ণিকা' সাহিত্য সংস্থা হতে পারে অথবা 'উদয়ন' কিংবা 'অপরাজিতা '। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল তো আছেই, আছে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের প্রতিভাময় উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রীরাও। ভালো হোক খারাপ হোক, গুণগত মান যাই হোক, হাজারে হাজারে নতুন নতুন পত্রিকা বের হয় সেদিন সকালে। রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে বিক্রিবাটাও কম হয় না।

দুপৃষ্ঠার ফোল্ডার থেকে শুরু করে এক ফর্মা দু ফর্মা হয়ে বড়ো থান ইটের মতনও হয় কোনো কোনো পত্রিকা। আর কি সুদৃশ্য প্রচ্ছদ সব, দেখলেই হাতে নিতে ইচ্ছে করে। বেশিটাই নিজেদের আঁকা। যে কোনোদিন হয়ত নিজের জীবনে আর কিছু লেখেনি, সেও হয়ত লিখে ফেললো একটি কবিতা। চেতনায় যার একুশে ফেব্রুয়ারি, সে কি কলমের মতো ভালো ও ধারালো কোনো তরবারি না ছুঁয়ে পারে? অন্তত জীবনে একবার? পারে না। পারে না বলেই বারবার তাকে লিখে যেতে হয়, প্রতিবার। অবশ্যি কোনো কোনো পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলী, অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নেন। যদিও সেগুলির সংখ্যা কম। তারা বরিষ্ঠ লেখক লেখিকাদের লেখা সংগ্রহ করে, অতি যত্নে ছাপে, সঙ্গে থাকে তাদেরও লেখা ও আঁকা। এ যেন বড়োদের সান্নিধ্য সৌরভে থাকার অবচেতন অভিলাষ। সবচেয়ে বড়ো কথা, একুশে ফেব্রুয়ারি যেন সেই সিংহদুয়ার, যাকে পেরুতে হোলে চাই কবিতার চাবি। একুশের শহীদরা যেন আপামর বাঙালির ভিতরে অলক্ষ্যে বাজিয়ে চলেছে আবহমানের একতারা। সেখানে কে নেই চর্যাপদ থেকে লালন, অন্নদামঙ্গল ছুঁয়ে হাশন রাজা,রবিঠাকুর ছুঁয়ে বর্তমানের কনিষ্ঠতম কোনো অচেনা অজানা কবি। এভাবেই নশ্বরতার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকে একটা সুমিষ্টতম ভাষা,একটি শিরদাঁড়া সোজা জাতি,একটা নতুন সূর্যের দেশ।

            কি সব নাম, দু'একটা না বলে পারি না। কেন না আমার সৌভাগ্য আমিও তো কখনো একুশের চেতনা বুকে নিয়ে লিখেছি তখনকার পত্র পত্রিকায়।একবার জগন্নাথ হল থেকে প্রায় ৪৮ ঘন্টার প্রস্তুতিতে বেরিয়েছিল – 'দেখা পেলেম ফাল্গুনে'– কবিতাটা এখন আর আমার সংগ্রহে নেই। লিখেছি 'অঙ্গিকার'-এ, 'জয়তু'তে,'সূর্যতপা'য়। কত সব সুন্দর সুন্দর পত্রিকার নাম 'সাগ্নিক', 'রক্তবলয়', 'বর্তিকা' 'হৃদমাঝারে' ইত্যাদি ইত্যাদি। 'অগ্নিশপথ', 'মুক্তিসোপান' এমনধারা নামও দুর্লক্ষ্য নয়।বলাবাহুল্য সব নামের ভিতরেই আছে এক জোরালো আবেগের উন্মোচন। এবং অবশ্যই একুশের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভাবাবেগ। সব ডাক যেমন ডাক নয়, কিছু ডাকে থাকে আহবান সেরকম একুশে ফেব্রুয়ারি যদি সূচনা সিঁড়ি হয়, স্বাধীনতা সংগ্রাম তবে মুক্তির সোপান। 

   আমার সৌভাগ্য আমি সেই একুশের সিঁড়িতে আমার মতন করে রেখে যাই আমার প্রণাম। আমার চোখের সামনেই সিঁড়ি ক্রমে হয়ে উঠলো স্বাধীনতা সৌধের আলোর সোপান। সোপান শীর্ষে প্রতিদিন একুশের সূর্য ওঠে, গান গায় ভোরের পাখি –আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...



শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...