সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ভাষা দিবস সংখ্যা

 


আমার একুশে, অনুভবে

[] জগন্ময় মজুমদার 


আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের মফস্বল শহরে সম্ভবত তার আগের বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রথম কলেজ। না, কলেজ নয়, মহাবিদ্যালয়। একই তো, তবু কলেজ বলতে নারাজ কেন, কেন মহাবিদ্যালয় বলবার এতটা আকুতি? তখন ঠিক বুঝিনি। কেন কথার লবজে কলেজ বললে, জিভ কেটে মহাবিদ্যালয় বলতে হয়। প্রশ্নটা ভিতরে ভিতরে বুদবুদ হয়ে আবার কখন ভিতরেই কেটে গেছে। কিন্তু কদিন পরেই সেই বুদবুদ যে এমনভাবে আবার ভেসে উঠবে আমাদের সেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর প্রান্তিক মফস্বলের ছোট্ট শহরের সরোবরে কে জানত! একদম হৈ হৈ ব্যাপার, মহাবিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে শহীদ দিবস পালিত হবে। সেই উপলক্ষে হতে চলেছে এক বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রভাতফেরি দিয়ে শুরু। সারাদিন তারপর বিভিন্ন আলোচনা সভা, বিশিষ্ট বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব যদিও অধিকাংশরাই স্হানীয়, তাঁরা বলবেন। আছে রবীন্দ্র নজরুল সুকান্ত ছাড়াও দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান। আছে আবৃত্তি। অবশ্যি ততদিনে,'আমার ভাই -এর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি', কবি আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত গানটি আমাদের মুখে মুখে ফিরছে। যদিও গানটি আমার কাছে আরো একটি গানের মতোই, এর অন্তর্লীন তাৎপর্য এবং কার্যকারণ, ইতিহাস, সত্যি বলতে তখন পর্যন্ত কিছুই তেমনভাবে জানা ছিল না। বড়োরা গান, আমিও গাই। শহীদ দিবস আবার কী! শহীদ শব্দের অর্থও তেমন বোধগম্য ছিল না। কিন্তু জানতে কতক্ষণ। বিশেষ করে যখন আমার ছোড়দিভাই ঐ মহাবিদ্যালয়ের-ই একজন। ও তখন প্রথমবর্ষ। মানবিক বিভাগের ছাত্রী। অনুষ্ঠানে গান গাইবে - জোর মহড়া চলছে - ঘরে ও বাইরে একা এবং সমবেতভাবে। দেয়াল লেখন এবং পোষ্টারে তখন লালমণিরহাট (বর্তমানে জেলা শহর) আমার জন্মশহর, ইতিমধ্যে লালে লাল হয়ে গেছে। আর যেহেতু আমার পাড়াতেই মহাবিদ্যালয়ের অবস্থান তাই যে কোনো রকম কোলাহলের কল্লোল সহজেই আছড়ে পড়ে আমাদের ঘরের দুয়ারে খুব দ্রুত। ছোড়দি গান গাইবে, বক্তৃতাও না কি দেবে, একটা খসড়া লিখে (মা-বাবার সাহায্যে) আয়নার সামনে হাত নেড়ে তর্জনী উঁচিয়ে সে কি প্রবল উত্তেজনা! যেন স্বয়ং শহীদ রফিক বা জব্বরের মা বা বোন। 

    পিঠোপিঠি ভাইবোন হলে যা হয়। একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা হয়ত আমার সঙ্গে ওর ছিলো। সত্যি কথা বলতে কি একটা অবচেতন সবুজ ঈর্ষা।ইতিমধ্যে জেনেছি আমার জন্মের আগে ঘটে যাওয়া বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম এবং সৌরকরোজ্জল গৌরবের গাথা যা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটে গেছে। ঢাকার রাজপথ সালাম রফিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা চাওয়ার ন্যায্য দাবীতে। তৎকালীন শাসক পাকিস্তান সরকার যা কখনো চায়নি  বরং উল্টে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল Urdu, only urdu shall be the state language - এমনতর বৈমাত্রেয় ভাষ্য। বাঙালি মানবে কেন, মানেওনি,তারুণ্যের মূল ভাষা যদি হয় অস্বীকারের ভাষা, তবে ছাত্র ও যুবসমাজ স্বাভাবিক প্রবণতা থেকেই গর্জে উঠেছিলো এবং তারই পরিণতিতে এই আত্মবলিদান। আমারও ভিতরটা টগবগ করে ওঠে। আমার ছোট্ট হৃদপিণ্ড হঠাৎ যেন বড়ো হয়ে গেল।লিখে ফেলি চরম আবেগে এক দীর্ঘ কবিতা।

লিখেই মা দিদিদের পড়ে শোনাই। ছোড়দিভাই বলল, এখনো মনে পড়ে : চল্ তোকে আমাদের বাংলার স্যারের কাছে নিয়ে যাই।
:কেন?
:যদি স্যার অনুমতি দেন,কবিতাটা তুই শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে পড়বি।
কি জানি কেন আমার কোনো ভয় ডর ছিল না। সদ্য সদ্য 'পাছে লোকে কিছু বলে'- কামিনী রায় পড়েছি।তাছাড়া ছোড়দিভাই যখন আছে আমার আর ভয় কি! সিরাজুল স্যারকে কবিতা দেখালাম। উনি চমকে উঠলেন না, হাসলেন না, কেবল বললেন: তুমি কী এটা নিজে লিখেছো না কেউ সাহায্য করেছে? তাঁর চোখে বিশদ সন্দেহ। আমি অকুতোভয়। বলি: না না আমিই লিখেছি। 
:এই কি প্রথম লিখলে? 
:না,
:তোমার লেখা যদি আরো থাকে দেখাতে পারবে?
:পারবো
:তাহলে ওগুলো নিয়ে তুমি আমার বাসায় কালকে এসো।

যাই। তখন দুপুর। টিনের চালের ঘর। উত্তর বঙ্গের শীত তখনও যায়নি। বাতাবি লেবুফুলের গন্ধের মতো মেদুর আবহ। উনি আমার কয়েকটি ছড়া কবিতা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন এবং আগামী একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে পড়বার অনুমতি দিলেন। 




    সেই আমার প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি - দেখা ও শোনা অতিক্রম করে মরমে প্রবেশ। অনুভব তখনও উপলব্ধির স্তরে যেতে পারেনি। ভাষা নিয়ে ভাসা ভাসা ভালোবাসা। মুখের ভাষা আবার কেউ কেড়ে নিতে পারে না কি? এও কী সম্ভব? ভাষা তো জল হাওয়া মাটি ও মায়ের মতো, প্রকৃতির মতো ওতপ্রোত। রক্ত থেকে জল যেমন আলাদা করা যায় না - চোখ আর চোখের মণি, হাত আর আঙুল, মাথা ও চুলের মতো স্বতঃস্ফূর্ত মা এবং মায়ের দুধ। না,ওই বয়সে এতকিছু ভাবিনি। বরং বিদ্যালয় শুরুর আগে জাতীয় সংগীত গেয়েছি- পাক সার জমিন সাদ বাদ, কিশওয়ারে...ওটাও তো নিছক এক গান।অর্থ বুঝি না। ওটি যে উর্দু ভাষার গান - আমি তো বাঙালি কেন গাইব এমন বোধও ছিলো না। উর্দু ক্লাসও করেছি মৌলভী স্যারের কাছে। কিছুদিন সংস্কৃতও শিখেছি ধর্মক্লাসে পন্ডিত স্যারের কাছে। ইংরেজি তো ছিলই। সত্যি বলতে ভাষা নিয়ে কোনো ছুৎমার্গ ছিল না। ওই বয়সে থাকার কথাও নয়।

   ইতিমধ্যে বড়ো হয়েছি কিছুটা বয়সে, জ্ঞানে নয়।বইটই পড়ি যখন যা পাই। এমন কি রান্নাঘরে পড়ে থাকা ঠোঙ্গাটাও বাদ যায় না, যে অভ্যাস পেয়েছি আমি আমার মায়ের কাছ থেকে। তখন তো টিভি বা ফোন ছিল না। রেডিও একটা ছিল বটে। বিশেষ সময় ছাড়া বাজানো হত না। তাও সেটি বড়োদের মর্জিতে চলত- একটু অনুরোধের আসর, খবরটবর এবং নাটক টাটক (তাও সেটি যখন শুরু হোত, ঘুমিয়ে পড়তাম) অবশ্যি ক্রিকেট রিলে শোনার সময় কেউ বাধা দিত না। শুনতাম মাঝে মধ্যে অ্যামেরিকার বাংলা অনুষ্ঠান VOA অর্থাৎ ভয়েস অব অ্যমেরিকা থেকে। মনে মনে কেন জানি উল্লসিত হয়ে উঠতাম, সুদূর অ্যামেরিকা থেকে বাংলায় কথা বলছে কোনো বাঙালি মানুষ? কি এক অদৃশ্য আবেগ-স্পর্শে ভিতরে জেগে উঠত। হয়ত অবচেতনে বাঙালি জাতি সত্তার বোধ!ইতিমধ্যে সিপাহী বিদ্রোহ, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত বা বলিভিয়ার, চিন বা চিলির - সামান্য হোলেও পড়ে ফেলেছি। গ্যারিবল্ডি, মাৎসিনি, আইরিশ বিপ্লবী ডি-ভ্যালেরা, মাও সে তুং এর লং মার্চ, চিনের আফিম যুদ্ধ, সমুদ্র বধূ ইংল্যান্ডের নেলসনের নৌবাহিনীর কাহিনি, স্প্যানিশ ফ্রাঙ্কো সরকারের কথা, জারের অত্যাচার, রুশ বিপ্লব, দুটো বিশ্বযুদ্ধ তো আমাদের ইতিহাসের সিলেবাসেই আছে... পড়ি আর ভাবি। এবং অবাক হই, পৃথিবীর কোথাও তো এমন একটা যুদ্ধ কিংবা আন্দোলন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য হয়নি? অবশ্যই বাঙালি এক্ষেত্রে অনন্য উজ্জ্বল এক ব্যাতিক্রম। 'রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি'- এমন আক্ষেপ রবিঠাকুর যদি ১৯৫২ পর্যন্ত জীবিত থাকতেন নিশ্চয়ই ফিরিয়ে নিতেন তাঁর কথা।

উচ্চমাধ্যমিকের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার যুগপৎ সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য হোল। কেন না কদিন মাত্র ক্লাস করতে না করতে বেজে গেল যুদ্ধের দামামা – বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ। 

    অভিশপ্ত ১৯৭১। ২৫ শে মার্চ। বৃহস্পতিবার। রাত্রি। ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যালীলা ঘটে গেল বাংলার বুকে, রাজধানী ঢাকায়। সেই রাতে পাকবাহিনীর আক্রমণে তিরিশ হাজার বাঙালির মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে সূচনা হোল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। পরবর্তী নয় মাস অর্থাৎ ১৬ ই ডিসেম্বর অব্দি অর্থাৎ যতদিন না পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধার সহায়ক ভারতীয় বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ অরোরার-র কাছে আত্মসমর্পণ করে। আসলে এই সংগ্রামের মূল দাহিকা-শক্তি ছিল তথাকথিত ধর্ম নয়, হিন্দু কি মুসলিম – বাঙালির তীব্র দেশপ্রেম ও জাতীয়তা বোধ। অবশ্যই লঘু কোনো দেশপ্রেম নয়, যার প্রেরণার উৎসে আছে এক ভাষাচেতনা।ভালোবাসার ভাষা– আমরি বাংলাভাষা। 

     বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ভারতে দীর্ঘ শরণার্থী জীবন কাটিয়ে আমি আবার ফিরে আসি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিমধ্যে পুড়ে গেছে বহু কাঠখড়, অনেক মায়ের চোখের জল শুকিয়ে গেছে, অনেক বোনের ইজ্জত লুট হয়ে গেছে, সন্তানহারা অনেক পিতা অন্ধ হয়ে গেছে। না থাক,সে ইতিহাস সবারই জানা। থাকি আমি জগন্নাথ হলে। তখনও জগন্নাথ হলের বিভিন্ন ঘরের দেওয়ালে গুলির দাগ,রক্তের ছিটে, ক্যান্টিনে পোড়া দাগ।
    
    এর ভেতরেই এসে গেল ফেব্রুয়ারী মাস। একজন বাংলাদেশির চোখে ফেব্রুয়ারী মানেই মাতৃভাষার মাস– শহীদের মাস। এ মাসের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন। আলোচনাচক্র, সেমিনার, দেশাত্মবোধক গানের মহড়া। পথনাটিকা– তার উচ্চকিত উল্লাসধ্বনি। কেউ লিখছে গীতি-আলেখ্য তো কেউ লিখছে শ্রুতিনাটক। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, আমিও একটা লিখেছিলাম, আমাদের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা পরম প্রযত্নে পরিবেশন করেছিল – 'আজ ধান বুনবার দিন'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রমহল চিরকাল-ই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও আছে বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যালের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা।

 দেখতে দেখতে এসে গেল একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাত। ঢাকা মেডিক্যালের সামনে যে বিখ্যাত শহীদ মিনার আছে সেখান থেকে শুরু করে আজিমপুরের কবরস্থান পর্যন্ত দীর্ঘ পিচ রাস্তায় আল্পনা দিতে দিতে চলেছে ঢাকা চারুকারুকলা মহাবিদ্যালয়ের নবীন নবীনা শিল্পীসকল। সে কি উত্তেজনা। সে কি উন্মাদনা। লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে অগণিত মানুষ তখন তাদের সঙ্গী। এই অধম, আমিও। সারা রাত জেগে থাকে ঢাকা শহর। রাস্তার পাশের গাছপালা, বাড়িঘর অন্ধকার কি জানে না।চারিপাশে আলোর ফোয়ারা। কখন এভাবে লাল হয়ে আসে ভোর। যেন শীতের প্রার্থনার অবসানে তেজদীপ্ত বসন্তের উত্তর। হাজারো হাজারো মানুষ, কাতারে কাতারে মানুষ, মানুষের ঢল নামে, শহীদ বেদিতে কে আগে দেবে ফুলের অঞ্জলি। উত্তর থেকে দক্ষিণ থেকে পূর্ব থেকে পশ্চিম থেকে আসছে মানুষ, মিছিলের হাতে প্ল্যাকার্ড,কারো হাতে বাংলাদেশের সবুজ পটভূমিতে লাল সূর্যপতাকা,কারো জামায় আঁকা রবিঠাকুরের গানের কলি,কারো বা নজরুল। ওইতো বুলবুল ললিতকলা অ্যাকাডেমি থেকে একদল শিল্পী এলেন, ওই তো ছায়ানট, ওই তো হিন্দোল। সব যেন গানে গানে সুরে সুরে একাকার। সাদা শাড়ি কালো পাড় একদল এগিয়ে আসছে  রোকেয়া হল থেকে, একদল আসছে  শামসুন্নাহার হল থেকে – আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কী ভুলিতে পারি – গাইতে গাইতে গান। শোক হয়ত এভাবেই একদিন শ্লোক হয় যদি সে শোক সমবেত শোক হয়– মহৎ কোনো আবেগের উৎসার। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মদান সে তো লঘু পালকতুল্য মৃত্যু মাত্র নয়। পর্বতচূড়ার মতো উঁচু তার মৃত্যুঞ্জয় উদ্ভাস।

   একটা কথা আছে যেখানে তিনজন গুজরাটি থাকে,তারা এক সঙ্গে হলে একটা ব্যবসা খোলার কথা ভাবে। যেখানে তিনজন ফরাসী থাকে তারা একসঙ্গে কোথাও না কোথাও সপ্তাহান্তে ঘুরে আসার পরিকল্পনা করে। ঠিক সেরকম যেখানে তিনজন  বাংলাদেশি তরুণ তরুণী থাকে, তারা ভাবে একটা ছোটো সাহিত্য পত্রিকা কিভাবে বের করা যায়।বাঙালির রক্তের ভিতরে আছে এই শিল্পতৃষ্ণা।কবিতা-প্রাণ বাঙালি, সুতরাং সামনে একুশে ফেব্রুয়ারি আসছে অথচ তাদের সংস্থা বা সংঘ থেকে একটা পত্রিকা বের হবে না, মানা যায় না।সেটির নাম ' জাগৃতি ' সংঘ হতে পারে, 'বর্ণিকা' সাহিত্য সংস্থা হতে পারে অথবা 'উদয়ন' কিংবা 'অপরাজিতা '। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল তো আছেই, আছে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের প্রতিভাময় উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রীরাও। ভালো হোক খারাপ হোক, গুণগত মান যাই হোক, হাজারে হাজারে নতুন নতুন পত্রিকা বের হয় সেদিন সকালে। রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে বিক্রিবাটাও কম হয় না।

দুপৃষ্ঠার ফোল্ডার থেকে শুরু করে এক ফর্মা দু ফর্মা হয়ে বড়ো থান ইটের মতনও হয় কোনো কোনো পত্রিকা। আর কি সুদৃশ্য প্রচ্ছদ সব, দেখলেই হাতে নিতে ইচ্ছে করে। বেশিটাই নিজেদের আঁকা। যে কোনোদিন হয়ত নিজের জীবনে আর কিছু লেখেনি, সেও হয়ত লিখে ফেললো একটি কবিতা। চেতনায় যার একুশে ফেব্রুয়ারি, সে কি কলমের মতো ভালো ও ধারালো কোনো তরবারি না ছুঁয়ে পারে? অন্তত জীবনে একবার? পারে না। পারে না বলেই বারবার তাকে লিখে যেতে হয়, প্রতিবার। অবশ্যি কোনো কোনো পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলী, অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নেন। যদিও সেগুলির সংখ্যা কম। তারা বরিষ্ঠ লেখক লেখিকাদের লেখা সংগ্রহ করে, অতি যত্নে ছাপে, সঙ্গে থাকে তাদেরও লেখা ও আঁকা। এ যেন বড়োদের সান্নিধ্য সৌরভে থাকার অবচেতন অভিলাষ। সবচেয়ে বড়ো কথা, একুশে ফেব্রুয়ারি যেন সেই সিংহদুয়ার, যাকে পেরুতে হোলে চাই কবিতার চাবি। একুশের শহীদরা যেন আপামর বাঙালির ভিতরে অলক্ষ্যে বাজিয়ে চলেছে আবহমানের একতারা। সেখানে কে নেই চর্যাপদ থেকে লালন, অন্নদামঙ্গল ছুঁয়ে হাশন রাজা,রবিঠাকুর ছুঁয়ে বর্তমানের কনিষ্ঠতম কোনো অচেনা অজানা কবি। এভাবেই নশ্বরতার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকে একটা সুমিষ্টতম ভাষা,একটি শিরদাঁড়া সোজা জাতি,একটা নতুন সূর্যের দেশ।

            কি সব নাম, দু'একটা না বলে পারি না। কেন না আমার সৌভাগ্য আমিও তো কখনো একুশের চেতনা বুকে নিয়ে লিখেছি তখনকার পত্র পত্রিকায়।একবার জগন্নাথ হল থেকে প্রায় ৪৮ ঘন্টার প্রস্তুতিতে বেরিয়েছিল – 'দেখা পেলেম ফাল্গুনে'– কবিতাটা এখন আর আমার সংগ্রহে নেই। লিখেছি 'অঙ্গিকার'-এ, 'জয়তু'তে,'সূর্যতপা'য়। কত সব সুন্দর সুন্দর পত্রিকার নাম 'সাগ্নিক', 'রক্তবলয়', 'বর্তিকা' 'হৃদমাঝারে' ইত্যাদি ইত্যাদি। 'অগ্নিশপথ', 'মুক্তিসোপান' এমনধারা নামও দুর্লক্ষ্য নয়।বলাবাহুল্য সব নামের ভিতরেই আছে এক জোরালো আবেগের উন্মোচন। এবং অবশ্যই একুশের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভাবাবেগ। সব ডাক যেমন ডাক নয়, কিছু ডাকে থাকে আহবান সেরকম একুশে ফেব্রুয়ারি যদি সূচনা সিঁড়ি হয়, স্বাধীনতা সংগ্রাম তবে মুক্তির সোপান। 

   আমার সৌভাগ্য আমি সেই একুশের সিঁড়িতে আমার মতন করে রেখে যাই আমার প্রণাম। আমার চোখের সামনেই সিঁড়ি ক্রমে হয়ে উঠলো স্বাধীনতা সৌধের আলোর সোপান। সোপান শীর্ষে প্রতিদিন একুশের সূর্য ওঠে, গান গায় ভোরের পাখি –আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...



২টি মন্তব্য:

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...