শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

সোমা কুসারীর গল্প 


 

বাইল্যাঙ্গুয়াল

সোমা কুশারী 


"আমাগো দ্যাশের বাড়ি আছিল ঢাকায়। ঐ যে ঢাকার কাছেই পীরপুর ঐ আমাগো দ্যাশ।"
বিরক্তিতে শুভ্রার চোখ কুঁচকে গেল - 

-দূর! বাবা যে কী করে না! লোকটার যদি কোনো সেন্স থাকে! বিরক্তি লুকিয়ে হাসিমুখে বাবাকে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিয়ে বলল-

-বাপি! খেতে বসবে না? চলো এই ব্যাচে বসবে চলো।
মেয়েকে হাত নেড়ে বারন করেই শুভেন্দু আবার শুরু করলেন-

-জানেন, আমার জন্ম অবশ্য অ্যাই দ্যাশে, তবে মায়ে কয় দাদা আর দিদি ঐ দ্যাশেই...
সুবোধবাবু, সম্পর্কে শুভ্রার মামাশ্বশুর মস্ত কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিটিমিটি হাসছেন আর শুভেন্দুকে মন দিয়ে লক্ষ্য করছেন দেখেই শুভ্রা আবার বাবাকে ঠেলল, বাপি চলো না খেয়ে নেবে, বেশ বেলা হয়ে গেছে। তোমার তো শরীরটা ভালো নয় খেয়ে উঠে না হয়...
শুভেন্দু শেষ করতে দিলেন না মেয়েকে, সুবোধের দিকে তাকিয়ে বললেন-
-তর বড্ড বেশি চিন্তা! এই বয়সে আর শরীল কত ভালো থাইকবে কন?

শুভ্রা বিরক্তি গিলে একগাল হেসে বললো, আরে মেজমামা তো আর কালই স্টেটসে ফিরে যাচ্ছেন না! তুমি না হয় আর একদিন...
-কী যে বলস! ওর লগে আবার কন্ দিন দেখা হইবো ঠিক আসে? 
শুভ্রার গাল দুটো অপমানে লাল হয়ে যায়, বাবা যে কেন নিজেকে এত ছোটো করে বুঝতে পারে না শুভ্রা, একে তো ওর শ্বশুরবাড়ীর সবাই ভীষন স্ট্যাটাস কনশাস তাই মেশামেশির লেভেলটাও যথেষ্ট হাইফাই, আর তার মাঝে অস্বীকার করে তো লাভ নেই সেই বেশ একটু কমাগোছের, একে তার বাবার অতি সাধারণ মুদিরদোকান আর নিজে সে একেবারে পাতি বাংলায় অনার্স! নেহাত প্রেমপর্বে শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ার শ্রীজীব ওসব বিষয়ে একটুও গুরুত্ব দেয়নি শুধু ওর রংরূপেই মজেছিলো তাই এত ভালো একটা ফ্যামিলিতে বিয়েটা হয়ে গেছে। না হলে? যাক্ গে পুরোনো কাসুন্দি যত কম ঘাঁটা যায় ততই ভালো। 

ঘর ভর্তি একগাদা লোকের মাঝে বাবার এই বেমক্কা আচরণে শুভ্রার হঠাৎ কেমন একটা চোরা অস্বস্তি হতে থাকে, অবশ্য সেসব কাউকে বুঝতে না দিয়ে দ্রুত দামী সিগ্রীন কাঞ্জীভরমের গোল্ডেন আঁচলটা বিশেষ কায়দায় গুছিয়ে নিয়ে ভীষন আন্তরিক একটা মুখ করে সোফায় বসা দুই মামী শাশুড়ি ননদ আর ছোটো জাকে কিছু একটা নিয়ে নিচু গলায় ফিসফিস করতে দেখে মিষ্টি করে বলে ওঠে-
তোমরাও কী পরের ব্যাচে বসবে পর্না? মাইমা আপনারা?
ছোটোমামি চওড়া হাসি ছড়িয়ে বলেন,
আমাদের নিয়ে একদম ভেবো না শুভ্রা, বেয়াইমশাইয়ের বাঙাল ডায়লেক্ট দারুন এনজয় করছি আমরা!

শুভ্রার মুখের যাবতীয় আলো যেন কেউ এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিলো, শুভ্রা দাঁতে দাঁত ঘসে মনে মনে বলে ওঠে , তা আর জানি না! এই মজলিশে যদি আবার মিসেস চৌধুরী এসে ভেড়েন তবে আর দেখতে হবে না! শুভ্রার মনের কথাই বোধহয় ওর শাশুড়িমা মানে মিসেস এনাক্ষী চৌধুরী শুনতে পেয়েছিলেন তাই তিনিও টুক করে এসে বসলেন দুই ভাই বৌ আর কনভেন্ট শিক্ষিতা আদরের ছোটো বৌ এর পাশে। মা-ও যে ঠিক এসময় কোথায় গেল!শুভ্রার এখন একমাত্র লক্ষ্য মাকে এই ভিড়ে খুঁজে বার করা। 

শুভ্রার সন্ধানী চোখ বসার ঘর পেরিয়ে দু দুটো সুসজ্জিত ঘর আর একরাশ লোকের মাঝ থেকে যখন আটপৌরে শাড়ী পরা সন্ধ্যাকে আবিস্কার করলো সন্ধ্যা তখন বিগলিত হয়ে শ্রীজীবের বন্ধুদের দৈয়ের ঘোল খাওয়াতে ব্যস্ত। রাগে শুভ্রার ব্রম্ভ্রতালু পর্যন্ত জ্বলে গেল,

- - এরা কী পেয়েছে তাকে? এই বালিগঞ্জের কোটিটাকার ফ্লাটে এসেও কী এরা শুধরোবে না? একজন এটিকেট ফেটিকেটে গুলি মেরে সোফায় পা তুলে বসে "দ্যাশের" বাড়ির ভাষার ক্লাস নিচ্ছেন অন্যজন দু-দুজন মেড সার্ভেন্ট থাকতেও দৈয়ের হাড়ি চেঁছে ঘোল বানাচ্ছেন! রিডিক্যুলাস্! সন্ধ্যা মেয়েকে দেখেই আনন্দে মেতে উঠে বললেন-
-মনা! মন্ রে! এট্টু ঘোল খা না মা! সকাল থেকে কী খাটনিটাই না যাচ্ছে।
সন্ধ্যার কথায় পাত্তা না দিয়ে শুভ্রা মাকে টেনে নিয়ে গেল এক সাইডে, তারপর হিসহিসে গলায় বলল,

কী চাও তোমরা? জামাইয়ের সম্মানটাও রাখবে না? একজন বসে বসে বাঙাল ভাষা শোনাচ্ছে আর তুমি? ঘোল বানাচ্ছ? যাও ঐ লোকটাকে নিয়ে খেতে বসো। আর আমার মাথা খেও না! ছিঃ! ছিঃ! ভাবা যায আমার ছোটমামাশ্বশুরের সামনে বাপি ঐভাবে বসে বাঙাল ভাষা শোনাচ্ছে? জানো উনি কতবড় মানুষ? ইংরেজী ছাড়া এরা নিজেদের মধ্যে পর্যন্ত কথা বলে না আমি-ই বাধ্য হয়ে স্পোকেন ইংলিশের কোর্স করলাম বিয়ের পর না হলে শ্রীজীবের মাথা কাটা যাচ্ছিল সেখানে তোমরা? ছিঃ! ছিঃ!

সন্ধ্যার মুখটা অপমানে মুহূর্তের মধ্যে কালো হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল সত্যিই তিনি আর তার স্বামী এই পরিবেশে কতটা বেমানান! দুই এর এক রমেশ মন্ডল রোডের একফালি ভাড়া বাড়ি আর সামনের রোয়াকে শুভেন্দুর মুদিদোকান। নেহাৎ, মেয়ের রুপে ধরা দিলো এত বড়লোক বাড়ির ইঞ্জিনিয়ার ছেলে না হলে এসব অনুষ্ঠানে তাদের আসার সত্যিই কথা নয়। নিজের ছেলেও এই এককারণে দিদির গৃহপ্রবেশে আসতে চায়নি, বলেছে-

আর্যবিদ্যাপিঠের ছাত্র এই শুভ্রাংশু দত্ত ঐ বড়লোক বাড়ি গিয়ে মরবে নাকি মা? দেখ না, আমার ক্লাস টুয়ের ভাগ্নেকে পর্যন্ত আমি ঐ ইংরেজীর জন্য সমঝে চলি আর ও বাড়িতে তো সব ইংরেজির এক একজন জাহাজ ঐদিয়েই ওরা লোকজনকে মাপে আর আমি ওর মধ্যে গিয়ে নিজের খিল্লি ওড়াবো?

সন্ধ্যার চোখ ফেটে জল আসছিলো, কেন যে ছেলেটার কথা শুনলেন না তখন, অবশ্য জামাইয়ের অনুরোধেই আসা নইলে এই ন- বছরে মেয়ের বাড়ি গুনে গুনে কবার এসেছেন বলতে পারবেন। শ্রীজীব-ই জোর দিয়ে বললো,
আপনার মেয়ের নিজস্ব ফ্লাট হলো আর আপনারা যাবেন না?
শুভেন্দু তো একপায়ে খাঁড়া বললেন,

-এ্যই দ্যাশে মাইয়াটা অন্তত একখান নিজের বাড়ি করল। আমাগো তো সব ভাড়া। যাবো নিচ্চয় যাবো।

সন্ধ্যা কী তখন মেয়ের মনোভাব বোঝেননি? বুঝেছিলেন অবশ্যই। সে তো শ্রীজীবের সাথে বিয়ে হওয়া ইস্তক দেখছেন মেয়ে তার বদলে গেছে, অতটুকু ছোট্ট ছ'বছরের নাতিটাকে পর্যন্ত মামাবাড়ি আনতে চায়না ওর নাকি ভাষার সমস্যা হবে। স্কুল থেকে নাকি পই পই করে বলে দেওয়া আছে বাচ্ছার সামনে বাড়ির লোকেরা সবসময় ইংরেজিতে কথা বলবে তবেই নাকি ছেলে ঠিকঠাক ইংরেজিতে কথা বলতে শিখবে। মুদিদোকানী দাদু আর মামা তো সেসব মোটেই পারে না দিদার কথাও তথৈবচ! উল্টে দাদুর ঐ বাঙাল ভাষার দু চারটে লব্জ শিখলে তো চিত্তির।সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি স্বামীকে নিরস্ত করতে ছুটলেন, শ্রীজীবের বন্ধুদের গলা পেলেন---

- আরে মাসিমা! ঘোল আর পাওয়া যাবেনা নাকি? কোথায় পালাচ্ছেন আপনি?
শুভ্রার গলাও পেলেন--
আরে! আপনাদের মিতাদি আর তুলি দেবে ঘোল বানিয়ে। চিন্তা কিসের?

-বাট দ্য টেস্ট অফ্ মাসিমা'স বাটারমিল্ক ইস সো ইয়ামম্-ই...

জামায়ের বন্ধুদের সমবেত হুল্লোর কানে আসতে লাগল সন্ধ্যার। মনে মনে ভাবলেন ঐভাবে আগ বাড়িয়ে দৈয়ের ঘোল করতে যাওয়া কী ভুল হলো? মনা নিশ্চয়ই রাগ করেছে। যতই পেটের মেয়ে হোক মস্ত বড়লোক আর ইংরেজি আদবকায়দা ওলা শিক্ষিত পরিবারে বিয়ে হবার পর থেকেই মেয়েটা যে আগের মতো নেই হাড়ে হাড়ে টের পান। মাসে এক দুবার গাড়ি হাঁকিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়া আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের পয়সার আর সম্মানের গল্প করে যে মেয়েটা তার সাথে সেই ভিতু মৃদুভাষী নিজের অতি সাধারণ মেয়েটাকে খুঁজে পাননা বহুদিন। খুব কষ্ট হয়, মেয়ের বাবা অবশ্য ওসব বোঝে না পূজোয় মেয়ের দেওয়া দামী পান্ট শার্টের পিস আর কারণে অকারণে দেওয়া এটা সেটায় একেবারে মুগ্ধ হয়ে যায়। আর এ নিয়েই ছেলের সাথে বেঁধে যায় লড়াই... শুভ যত বলে

-তুমি অমন করে পাড়ার সব্বাইকে দিদির বাড়ির পয়সার গল্প শোনাও কেন বুঝিনা ভেবেছো? তোমার নাতি যে বাড়িতেও ফট্ ফট্ করে ইংরেজি বলে এতে অত আহ্লাদে গলে পড়ে সক্কলকে বলে বেড়ানোরই বা কী আছে?
শুভেন্দু তত রেগে ওঠেন--

-কবো না? ক্যান? তগো ভয়ে? ইংরেজি রাজার ভাষা বোঝলি? অতটুক্ পোলাপান ফরফর কইরা কইতে পারে শুনাবো না লোগরে? হিংসুট্টা একখান! 



শুভেন্দুকে বড় হলঘরটাতে সোফায় আসীন দেখতে পেলেন সন্ধ্যা, দেখলেন স্বামী মনের সুখে একখানা গান শোনাচ্ছেন বেয়াই বেয়ানদের, শুভেন্দুর ঐ বাঙাল উচ্চারণ আর চোখ বুজে বিচিত্র মুখভঙ্গি দেখে উপস্থিত সক্কলের মুখে কৌতুক খেলে বেড়াচ্ছে লক্ষ্য করলেন সন্ধ্যা, শ্রীজীবের বন্ধুর স্ত্রীরা কয়েকজন অফিস কলিগ আর নাতির বন্ধুদেরর মা বাবারাও রয়েছে সে ভিড়ে। 

শুভ্রার শাশুড়ি আর মামিশাশুড়িদের মুখে তো স্পষ্ট হাসির ছাপ, দুই ননদ আর জাও মুখ টিপে হাসছে। অথচ, ছোটোমামাশ্বশুর ভদ্রলোক মন দিয়ে গান শুনছেন, আর শুভেন্দু গলা তুলে গাইছেন...

-"অ সুখের ময়না রে...ক্যামনে রাখি জীবন!" 

সন্ধ্যা! অসহায় মুখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন...

-কী হছ্ছে এসব? কী শুরু করলে তুমি?

শুভেন্দু স্ত্রীকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন--আরে চুপ যাও তো! শোনো না গানখান! আরে আব্বাসুদ্দিনের গান... 

সন্ধ্যা, বিরক্তিমেশানো গলায় বেশ জোরেই বলে উঠলেন---
-না! ওঠো তুমি! খেতে চলো!

শুভেন্দু থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন, গিন্নির স্বভাববিরুদ্ধ গলার জোরে কিছু একটা আঁচ করে বললেন 
-ও! আইচ্ছা! আইচ্ছা! চলো!

শুভেন্দুকে উঠতে দেখে শুভ্রার শাশুড়িমা হাঁ হাঁ করে উঠলেন,

-বেয়াইমশাই! উঠলে হবে? আপনিই তো আজ সেন্টার অফ্ এ্যাটারকশান! ভানু ব্যানার্জীর কমিক শো এত তাড়াতাড়ি শেষ করলে হবে? উই আর অল এনজয়িং এ্য লট্।
সন্ধ্যার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে যেতে শুভেন্দু কিন্তু সত্যিই এবার সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন। আর ঠিক তখনই শুভ্রার ছ'বছরের ছেলে আরিয়ান বলে উঠল

-- গ্রানু আর ইউ এ ঘুসপেটি?ফর দিস হোল টাইম ইন হুইচ লাঙ্গুয়েজ ডু ইউ স্পিকিং ইন?এন্ড্য দ্য হরিবোল সঙ্গ.. 

সন্ধ্যার মুখ তুলে তাকাতে লজ্জা করছে, শুভেন্দু নির্বাক শুভ্রা আর শ্রীজীব ও যে কী করবে ঠিক করতে পারছে না... এত লোক! এত নিমন্ত্রিত! আর এর মাঝে...

- না দাদুভাই! তোমার দাদু ওসব ঘুসপেটি টেটি কিচ্ছু নয় গো! তোমার দাদু হলেন একজন খাঁটি মানুষ। আর যে ভাষাটায় উনি এতক্ষণ আমাদের এতকিছু শোনাচ্ছিলেন ওইটেই আমাদের সকলের মায়ের ভাষা! প্রাণের ভাষাও বটে! শুধু আমরা ওঁর মতো মাকে মনের কোনে ধরে রাখতে পারিনি, বুঝলে! 

আরিয়ানের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে শুভ্রার মামাশ্বশুরের বলা কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই পুরো হলঘর জুড়ে কেন যে শ্মশানের নিরবতা নেমে এলো একমাত্র শুভেন্দুই কিছুতেই তা ঠাওর করতে পারলেন না! 





 

1 টি মন্তব্য:

শেষ পর্ব - অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে

"অনন্ত অনন্তকাল ভেসে যেতে যেতে" সজ্জ্বল দত্ত  ৭ .          " And miles to go before I sleep            And miles to go before...